×

মুক্তচিন্তা

লকডাউন চলুক, মানুষকেই মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৮ এএম

বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের আজ ৪০৭তম দিন। করোনায় আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা হিসাব করা আমাদের যাপিত জীবনে দৈনন্দিন অথচ নির্মম এক কর্মসূচির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন এই হিসাবের অঙ্ক কষতে কষতে কী বেদনার্ততার সঙ্গেই না আমরা ১০ হাজারের সংখ্যাটি হিসাব করে ইতোমধ্যে পেছনে ফেলে চলে এসেছি! গত এক বছরে আমাদের দেশের ১০ হাজারের বেশি মানুুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার মধ্যে এই এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনেই মৃত্যুবরণ করেছেন ১ হাজারের বেশি মানুষ! আর ১৫ দিনে আক্রান্তের সংখ্যাও ৫০ হাজারের বেশি। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি গত বছরের মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত আমরা নানা ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত অনেক প্রথিতযশা ও মেধাবী ব্যক্তিত্বকে মহামারি করোনার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয় ও মৃত্যুবরণ করতে দেখলাম। মৃত্যুর এ মিছিল দেখে হতাশায় আর আফসোসে জর্জরিত হলাম। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী অনেকের জীবনসংগ্রাম পর্যবেক্ষণ করে এও স্পষ্ট বুঝেছি যে, জাতির জন্য তাদের অবদান রাখা শুরু হয়েছিল মাত্র! তাই দুঃখের সঙ্গে অসময়ে মৃত্যুবরণ করায় আমরা তাদের জন্য সর্বান্তকরণে শোকগাথা উচ্চারণ করেছি। কিন্তু এও বুঝেছি যে, আমাদের অসহায় শোকগাথা উচ্চারণে কেবল নিজেকেই প্রবোধ দেয়া মাত্র, কোনো রকমে কেবল নিজেকেই সান্ত্বনা দেয়া! কয়েক দিন ধরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদের দেশে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা একশ ছুঁই-ছুঁই করে গত শুক্রবার তা ১০০ অতিক্রম করেছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরু থেকে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে ঊর্ধ্বমুখী গাণিতিক সংখ্যাকেও প্রতিনিয়ত অতিক্রম করেছে। দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা টানা কয়েক দিন ৭ থেকে সাড়ে ৭ হাজারের ঘরে ছিল। গত দুই তিন দিন সংক্রমণ শনাক্ত ৫ হাজারের ঘরে থাকলেও এই দুই-তিন দিন পরীক্ষার সংখ্যা অনেক ছিল কম। কিন্তু শতকরা হারে বিবেচনা করতে গেলে বলতেই হয় আমাদের দেশে সংক্রমণ প্রবণতাও মৃত্যু হারের মতোই ঊর্ধ্বমুখী। বলার অপেক্ষা রাখে না, মৃত্যুর সংখ্যা আমাদের নতুন করে চিন্তা ও আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এসব মৃত্যু আমাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবেও বিপর্যস্ত করে তুলছে। করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে অনেকে বিখ্যাত এবং জাতীয় বীর হলেও এতদিন তারা ছিলেন ব্যক্তিগত নৈকট্য থেকে দূরবর্তী জগতের মানুুষ। কিন্তু সম্প্রতি মৃত্যুর সেই থাবা ব্যক্তিগত আত্মীয়তার সীমান্তরেখার ভেতর মহল পর্যন্ত চলে আসায় আরো গভীর এক বিমর্ষ বোধ প্রতিনিয়ত আমাদের আচ্ছন্ন করে তুলছে। মুঠোফোন থেকে প্রিয় মানুষগুলোর নাম ও নম্বর মুছে ফেলা যে কী কষ্ট ও বেদনার তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানেন না। এখন আমাদের অনেকের জীবনই প্রিয় মানুষের বিয়োগ ব্যথার চিরন্তন সেই অভিজ্ঞতায় জারিত ও জর্জরিত হয়ে উঠেছে। সরকার ঘোষিত ‘সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন’ গত তিন দিন অনেকটাই সফল হয়েছে বলে কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরও হয়েছে। তবে আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষের কৌতুকপ্রিয়তা দেখেও আমরা বিস্ময় প্রকাশ না করে পারি না। লকডাউন স্বচক্ষে দেখার জন্যও কোথাও কোথাও ভিড় জমেছে বলে কয়েকটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে! এই ভিড় থেকে যে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে না তাও বলা যাবে না। বরং মানুষের ভিড় থেকেই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। এই বৈজ্ঞানিক সত্যই আজ প্রতিষ্ঠিত। তাই ভিড় তথা জনসমাগম এড়াতেই লকডাউনের পরিকল্পনা। আমাদের জীবনযাপনের অনুষঙ্গে দেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবার মান এবং হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকা প্রয়োজন। মনে রাখতে আমাদের হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যাসংখ্যাই সীমিত। এর ওপর করোনা রোগীদের জন্য বরাদ্দ শয্যাসংখ্যাও রোগীর সংখ্যার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। হাসপাতালগুলোতে হাই-ফ্লো অক্সিজেন সুবিধাসহ বিশেষ শয্যাও তেমন নেই। আইসিইউ এবং আইসিইউ সংশ্লিষ্ট দক্ষ জনবলের সংখ্যাও ততোধিক সীমিত। বর্তমানে দৈনিক শনাক্ত ৫ থেকে সাড়ে ৭ হাজার রোগী সামাল দিতেই যখন হাসপাতালগুলোর হিমশিম অবস্থা তখন আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে আমাদের উদাসীনতা বা স্বেচ্ছাচারিতায় দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা যদি আরো বৃদ্ধি পায় তবে স্বাস্থ্যসেবার সামগ্রিক খাতটিকে স্বাভাবিক রাখাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। শীত মৌসুমে গত বছরের চেয়ে সংক্রমণ হার কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় আমরা মানুষের চলাচলের স্বেচ্ছাচারিতা দেখেছি। সেই স্বেচ্ছাচারিতার ফলও আমরা এপ্রিলের শুরু থেকে পুনরায় ভোগ করছি। এ মাসে ৫০-এর নিচে নামেনি দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা। উপরন্তু গত শুক্রবার থেকে তা একশ অতিক্রম করেছে! সেদিন মৃত্যু হয়েছে ১০১ জনের! করোনা শনাক্তের ৪০৭তম দিনে এসে আমরা একটি বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভ করেছি যে ছোট, বড়, মাঝারি সব মাপের ব্যবসায়ীদের প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য ইঙ্গিতের ওপরই লকডাউনের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সাধারণ লকডাউনের সময় দোকানপাট ও মার্কেট খুলে দেয়ার জন্য আমরা ব্যবসায়ীদের আন্দোলন করতে দেখেছি! দেখেছি সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি দিতেও! এই চিত্রের বিপরীতে ছিল করোনাক্রান্ত অসুস্থ রোগীকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে স্বজনদের ছুটে চলার দৃশ্যও। আবার বর্তমান ‘সর্বাত্মক কঠোর লকডাউনে’র সময় আমরা গার্মেন্টস শিল্পমালিকদের পূর্বপ্রতিশ্রুত শ্রমিকদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করতে দেখিনি। ফলে লকডাউনের মধ্যে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে দেখলাম! বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতে এসে শিল্পমালিকরা জোর দিয়ে বলছিলেন ৯০ শতাংশের বেশি শ্রমিক সংশ্লিষ্ট কারখানার আশপাশেই বসবাস করেন। তাদের এ কথা যে কত বড় ঢাহা মিথ্যা ও প্রবঞ্চনামূলক তা ‘সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন’ শুরুর দিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকদের অসহায়তাদৃষ্টে স্পষ্ট হয়েছে! লকডাউন চলছে। চলুক। তবে এর মধ্যে মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরা যারা অনেকটা প্রায় ঘরে বসে অফিস করেই বেতন বোনাস পাই তারা মনে করি এত মানুষ রাস্তায় বের হন কেন? কেনই বা মানুষ লকডাউন মেনে চলতে চান না। আবার অন্যদিকে লকডাউনকে উপেক্ষা যারা ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দঁাঁড়ান তারা যে সাধ করে ঘরের বাইরে যান না তাও খুবই স্পষ্ট। জীবিকা না হলে জীবন বাঁচবে না। তাই তারা জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হন। ফলে লকডাউন কিছুটা হলেও শিথিল হয়ে যায়। কিছু মানুষের অহেতুক অজুহাতেও লকডাউন শিথিল হয়ে যায়। গত বছর সর্বত্র না হলেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন নিরন্ন মানুষের সন্ধান করে খাদ্য সহায়তাসহ নিত্যপণ্যসামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। তাই রিকশাচালক, দিনমজুর ও কর্মহীনদের ঘরের বাইরে তুলনামূলক কম দেখা গেছে। কিন্তু এ বছর প্রথম এক সপ্তাহ সাধারণ লকডাউন এবং পরের সপ্তাহের ‘সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন’ শুরু হলেও কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠন এখনো খাদ্য সহায়তা নিয়ে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের কাছে এগিয়ে এসেছে বলে আমাদের নজরে পড়েনি। রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এবং বিশেষ করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মেয়র বা স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারদের নেতৃত্বে জনগণকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন সৃষ্টিশীল পরিকল্পনাও করতে হবে। তাদের পরিকল্পনার সঙ্গে জনগণকে আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনা প্রতিরোধের এখন পর্যন্ত কার্যকরি প্রধান তিনটি অনুষঙ্গÑ ‘ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা’ প্রভৃতি মানুষকে অভ্যস্ত করাতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বাজায় রাখার জন্য লকডাউনের বিকল্প নেই। আবার লকডাউনকে সফল করতে হলে ব্যাপক জনসমর্থন প্রয়োজন। ব্যাপক জনসমর্থন তখনই পাওয়া সম্ভব যখন সবার খাদ্য ও নিত্যপণ্যের চাহিদা নিশ্চিত হবে। সুতরাং খাদ্য ও নিত্যপণ্যের চাহিদা নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করতে হবে। এর বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, ৭ দিনের লকডাউন থেকে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কোনো উপকার আসবে না। সে ক্ষেত্রে লকডাউনকে অন্ততপক্ষে ১৪ দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে। আর লকডাউনের সময় বৃদ্ধি মানেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করা অনেকটাই বাধ্যতামূলক। এ বিষয়ে শিল্পপতি, রাজনৈতিক কর্মী তথা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আন্তরিক হলে একটি সফল লকডাউন আমরা পেলেও পেতে পারি! যেহেতু এ বিষয়ে আমাদের কিছুটা হলেও পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে তাই পুনরায় কয়েক দিনের জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের কর্মীরা যেন অসহায় দুস্থদের পাশে দাঁড়াতে পারেন সে জন্য সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। লকডাউন ব্যর্থ হলে সংক্রমণের হার যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি বৃদ্ধি পাবে মৃত্যুর সংখ্যাও। কারণ এটি ঠিক যে, জনসমাগমের মাধ্যমেই করোনার বেশি বিস্তার ঘটে থাকে। কোনোক্রমেই যেন এবারের ‘সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন’ ব্যর্থ না হয় সেদিকে সবার অংশগ্রহণমূলক সক্রিয়তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাব বলে আশা করছি। মৃত্যুর মিছিল যেন আর দীর্ঘতর না হয় সেজন্য যার যার অবস্থান থেকে সবাই এই অতিমারির মোকাবিলা করবেন তাও আমাদের প্রত্যাশা। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App