×

মুক্তচিন্তা

মুজিবনগর সরকারের সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২১, ১২:০২ এএম

মুজিবনগর সরকারের সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার

বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফার ভিত্তিতে ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সুতরাং সংসদীয় প্রথা অনুযায়ী খুব স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন এবং এর প্রধান শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদানের কথা থাকা সত্ত্বেও মূলত পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনায় পাকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের ডাকা অধিবেশন অনাকাক্সিক্ষতভাবে মুলতবি ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে মার্চ মাসব্যাপী আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকের নামে প্রহসন এবং তদানীন্তন পূর্ববাংলার মানুষ তথা বাঙালি জাতিকে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে জাহাজে অস্ত্র সরবরাহ এবং জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর গভীর চক্রান্ত সহজেই উপলব্ধি করে জাতিকে জাতীয়তাবাদী চেতনা তথা ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। তার আহ্বানে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান তথা পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি শাসনযন্ত্র সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে ব্যাপক সাড়া দিয়ে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ক্ষমতায় আরোহণ না করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙালি জাতির মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার নির্দেশেই সমগ্র দেশ ও জাতি পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি নর-নারী-শিশুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়। অপারেশন সার্চলাইট সংগঠিত হওয়ার সময় ’৭১-এর ২৫ মার্চ গভীর রাতে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাত তথা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তদানীন্তন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মূলত সেদিন থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ বিশ^ মানচিত্রে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করে। পরদিন ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমানকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করানো হয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা শুরু হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ তার বাসভবন ত্যাগ করে আত্মরক্ষা ও সরকার গঠনের পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় ফরিদপুরের রাজবাড়ী এবং কুষ্টিয়া হয়ে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান। ৩১ মার্চ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে মেহেরপুরের তদানীন্তন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর সহায়তায় সীমান্ত অতিক্রম করেন। পশ্চিম বাংলা সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর প্রধান গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমেদ ও আমীর-উল ইসলামকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। গোলক মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী প্রধান কে এফ রুস্তমজী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তদানীন্তন পূর্ববাংলার পরিস্থিতি এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ও অদম্য স্পৃহা সম্পর্কে অবহিত হন। জনাব তাজউদ্দীন মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করার এবং সেখানে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে আহ্বান জানালে জানানো হয় যে, এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে হবে। দিল্লির ঊর্ধ্বতন মহলে যোগাযোগ সাপেক্ষে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামকে খবর পাঠানোর পর তারা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করে সাহায্য-সহযোগিতার আহ্বান জানানোর সময় তাজউদ্দীন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বোঝাতে সক্ষম হন যে, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু সেই সরকারের রাষ্ট্রপতি, এছাড়া যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছেন তারা প্রত্যেকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য। পাশাপাশি তিনি নিজেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করেন। বৈঠককালে ইন্দিরা গান্ধী আশ্বাস প্রদান করেন যে, বাংলাদেশকে যথাসময়ে তারা স্বীকৃতি প্রদান করবেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে তাজউদ্দীন আহমদ তদানীন্তন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ (এমএনএ ও এমপিএ) সদস্যদের মেহেরপুর মহকুমার সীমান্তে অধিবেশনে যোগদানের আহ্বান জানান। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সদস্য করা হয় যথাক্রমে এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। ১১ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি করা হয় এম এ জি ওসমানীকে। ১১ এপ্রিল বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেতারযোগে তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন। পূর্বঘোষণা অনুসারে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় আমবাগানে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিশ^সম্প্রদায় তথা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের প্রতি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বিপ্লবী মুজিবনগর সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সূচনা ঘটে। এই সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মাত্র ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে যৌথ বা মিত্রবাহিনীর কাছে দুর্ধর্ষ দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা সম্পন্ন হয়। বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম ত্যাগ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ ২৩ বছরের স্বাধিকার আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ লাভ এবং তাদের নিজস্ব আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল আনয়নের লক্ষ্যে জাতিকে আজ ৭১-এর চেতনায় উগ্র জঙ্গিবাদমুক্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও জাতি গঠনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এটিই হোক স্বাধীনতা এবং মুজিবনগর দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার।

হাসান-উজ-জামান : ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ (মুসপ)। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App