×

সাময়িকী

মাহফুজামঙ্গলের কবি মজিদ মাহমুদ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৭ এএম

মাহফুজামঙ্গলের কবি মজিদ মাহমুদ
মামুন মুস্তাফা গ্রন্থটি বহুল পঠিত, বেশ আলোচিত। অনেক সমালোচকই গ্রন্থটির ব্যবচ্ছেদ করেছেন নানা ভাবে, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। এটি এতটাই পাঠক-নন্দিত যে, শেষাবধি গ্রন্থটি সীমানা ছাড়িয়ে পরদেশেও জায়গা করে নিয়েছে অন্য ভাষায়, ভিন্ন আঙ্গিকে। হ্যাঁ, আমি বলছি কবি মজিদ মাহমুদ প্রণীত কবিতাগ্রন্থ মাহফুজামঙ্গল প্রসঙ্গে। এখন এ কাব্যের তিরিশ বছর পূর্ণ হবার পথে মজিদ মাহমুদের মাহফুজামঙ্গল’কে আবারো, বিশেষত আজকের পাঠকের কাছে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় রত এ কাব্যের অনুরাগীরা। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রশ্ন জাগে, ‘মাহফুজা’ আসলে কে? কে এই কন্যাজায়াজননী? নাকি শুধুই সে মানসপ্রিয়া? কোন সে রমণীÑ যে কিনা এতদিন ধরে পাঠক-হৃদয়ে দুন্দুভি বাজিয়ে চলেছেন! অথচ এই মানসসুন্দরী কবির হৃদয়অন্তর খুঁড়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন শিল্পের সঙ্গমে। আর তাই ‘মাহফুজা’ হয়ে ওঠেন মানবসম্বন্ধীয় থেকে ঐশ্বরিক দেবতা; যেখানে কবির প্রার্থনা ছুঁয়ে যায় তসবির দানার সঙ্গে। সেই এবাদতের কথা নাইবা বললাম এখানে, কিন্তু যদি বলিÑ ‘এখনো কি তোমার মনে আছে মাহফুজা/সেইসব জাগরণের দিন/প্রতিটি গাছ ও পানি নির্মাণের আগে/প্রথম হয়েছিল তোমার সূচনা’। এর ভেতর দিয়ে কবি শরীরী মাহফুজাকে মেটাফোর চিত্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্বপ্রকৃতিতে ছড়িয়ে দেন। যে মনোজলোকে প্রেমিকপ্রবর মানুষ আবিষ্কার করে তার বিশ্বরূপী সর্বংসহা মানসপ্রিয়াকে। আমরা সাধারণত প্রতীক এবং রূপক-কে এক করে দেখি। কার্যত প্রতীক ও রূপকে পার্থক্য আছে বেশ। সেই সূক্ষ্ম চিন্তার দর্শনে মাহফুজামঙ্গল রূপক আকারে ধরা দেয় আমাদের কাছে। আর এখানেই কবির বিজ্ঞান মনস্কতা ধরা পড়ে পাঠকের অনুধ্যানে। মাতৃগর্ভে যেভাবে শিশু পানির ওপর ভাসে, সেভাবেই তিনি মানবজীবনকে জগতে ভাসমান শিলাস্তরে প্রত্যক্ষ করেন। আর ওখানেই তিনি আবিষ্কার করেন প্রেমিকা ও দয়িতা ‘মাহফুজা’ও কীভাবে বিশ্ব পুঁজিবাদের শিকার : তোমার তো সব ছিল মাহফুজা তোমার এক্সপেনসিভ পানের জন্য জমা আছে পেট্রো-ডলার তোমার আছে বেগিন ব্রেজনেভ রিগান (তোমারই মানুষ, মাহফুজামঙ্গল) অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, সংসারযাপনেও কবি কতটা ক্ষতবিক্ষত! বিশ্ব পুঁজিবাদের নখরে ছিন্নভিন্ন। মাহফুজার ভালোবাসা তাই দলিতমথিত। কিন্তু মাহফুজা কি ভালোবাসতে পেরেছিল কখনো? এ প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে গেছে। শুধু কবির ভালোবাসাই মাহফুজাকে অনন্য করে তোলে বিশ্ব চরাচরে। যেন ‘মাহফুজা’ই ভালোবাসতে শিখিয়েছে মানুষকে। তাই সহজেই কবি বলতে পারেনÑ ‘একাত্তরের কালো রাত্রি এখনো আমার বুকের ওপর ধরে আছে ছুরি/তবু তোমাকে ভুলিনি মাহফুজা’ (মাহফুজা, মাহফুজামঙ্গল)। এও এক উজ্জীবনের কথা। যে উজ্জীবনের ভেতরে আনন্দ-বেদনা, আঘাত-পাল্টা আঘাত, আবেগ-উত্তাপÑ সব অন্তর্বেদনা ফুটে ওঠে এক ‘মাহফুজা’র মধ্যে। রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, পারিবরিক, এমনকি বৈশ্বিক কালান্তর জায়গা করে নিয়েছে এক ‘মাহফুজা’র শরীরে। সুতরাং ‘নাম’ কবিতাটি এরই শাশ^ত রূপÑ ‘ওরা যখন আমার নাম ধরে ডাকে/আমি কেবলই শুনতে পাই মাহফুজা’। আর ‘আদ্যাক্ষর’, ‘ইচ্ছের সন্তান’, ‘অস্তিত্ব’ এরই ধারাবাহিকতা। সাধারণ দৃষ্টিতে মাহফুজামঙ্গল কাব্যে অতীত ঐতিহ্য চেতনার উদ্বোধন ঘটেছে বলে মনে হলেও আধুনিক কালের জীবনবোধ ও কালের চিন্তনকে কবি মজিদ মাহমুদ অস্বীকার যে করেননি বা করতে পারেননি তা সহজেই অনুমেয়। এবং এ কথারই সারনির্যাস হিসেবে বইয়ের ফ্ল্যাপের কয়েকটি কথায় টের পাই Ñ ‘উত্তর-উপনিবেশ ও উত্তরাধুনিক পাঠপ্রপঞ্চের ভেতর এর বিষয় ও অঙ্গশৈলী হারিয়ে যায় না। ব্যক্তি ও জাতীয় মানুষের ব্যথা বেদনা, বাঙালি-মানসের বাঙালি হয়ে ওঠা এবং অতীত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারিত্ব ধারণের মাধ্যমে এ গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে একের ভেতরে বহু স্বরের প্রকাশ।’ সুতরাং মাহফুজামঙ্গল আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিকবির দয়িতারূপী মানসপ্রিয়া হয়ে উঠলেও কবি এর শরীরীকাঠামোয় নির্মাণ করেছেন বিশ্বমানুষের যাপিত জীবনের স্বকাল সংকট। অনেক সমালোচকই মাহফুজামঙ্গল-এর সঙ্গে ফরহাদ মজহারের ‘এবাদতনামা’ কিংবা জাকির তালুকদারের ‘কুরসিনামা’র মিল খুঁজে পেয়েছেন। সেসব ছিল বহিরঙ্গে, তথা আপাতদৃষ্টিতে উপরিভাষা; মূলত এর অন্তর্গত টান আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিনে’র সঙ্গে। ‘সোনালি কাবিন’ নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন মিথস্ত্রিয়ার দলিল। বাস্তবতা এবং সমস্যার যাঁতাকলে জীবন-মৃত্যু-প্রেম ওই শ্রেণির জন্য নিয়ম-বিরোধী ও মূল্যবোধ-বিরোধী বিষয় হয়ে উঠেছে। তা থেকে বিযুক্ত নয় মজিদ মাহমুদের মাহফুজামঙ্গল। বরং এ কাব্যের পূর্বখণ্ড, উত্তরখণ্ড এবং যুদ্ধমঙ্গলÑ এই ত্রিবেণীর সঙ্গমে বিশুষ্ক নাগরিকতায় দীর্ণ অথচ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সূত্রে মেটাফরালজিক্যাল রূপকের নান্দনিক ব্যবহারে এ কাব্যের গোপন সত্য ও সৌন্দর্য পারস্পরিকতায় অভিনব হয়ে উঠেছে। বিশেষত কবি মজিদ মাহমুদের শব্দ চয়ন ও এর ব্যবহার এবং আহ্নিক জীবনের চিরন্তন বিষয়ের উন্মোচনে শ্রেণিদ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে বিশ্বপরিব্যাপ্ত আন্তর্জাতিক মানুষের জনপদ ও তার সম্ভাবনা মৌলিকত্ব লাভ করে মাহফুজামঙ্গল-এর অন্তর্বয়নে। কবি যে উৎসের সন্ধান করেছেন তাঁর এ কাব্যে, তা ছিল এক কথায় জীবন, জীবন এবং জীবন। জীবনের উত্থানপতনে সংসারসমুদ্রের দাঁড় টেনে সেখানে আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নকে সমীকৃত করতে গিয়ে কবি টের পান জীবন ও শিল্পের সংজ্ঞার্থ পরিণতি। এমনকি আত্মবিচ্ছিন্নতা ও সত্তাবিচ্ছিন্নতার আউটসাইডার বোধ থেকে মুক্তিলাভের আকাক্সক্ষাও পরিব্যাপ্ত হয়েছে মাহফুজামঙ্গল-এর কবিতাগুলোতে। সামনে দিকচিহ্নহীন সময়ের এক মহাগর্ভ। তথাপি জীবন ও শিল্পের জন্য নিগূঢ় মহাকালের কাছে দর্শনসঞ্জাত অস্তিত্বের প্রশ্নে সচেষ্ট কবি। সংসারের বন্ধুর যাত্রাপথে জীবনের বহুমাত্রিক অনুভবের তীব্রতা নিয়ে জীবনকে সততার সঙ্গে অনুধাবনের একটি বিচার বিশ্লেষণের যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছেন কবি। সেই জীবন-জিজ্ঞাসা এবং তার সর্বমুখী অন্বেষা মাহফুজামঙ্গল-এর আধুনিকতাকে প্রকাশ করেছে। এই আধুনিকতা ব্যক্তিত্ববাদী আমিত্বের জয়গানের ভিতর দিয়ে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাজ-রাষ্ট্র এবং লোকাচার ও সংস্কৃতিকে প্রচ্ছন্ন করে তুলেছে। এই সবকিছুর সমাধান কবি দিয়েছেন এ কাব্যের শেষ  কবিতায় : তুমি একাকী দাঁড়িয়ে আছ বিধ্বস্ত সমর প্রান্তরে আমিও আজ হৃতসর্বস্ব ভিক্ষুকের বেশে অথচ তুমি ছিলে মহারানি ভিক্টোরিয়া আর আমি মহীসুরের টিপু সুলতান তবু কেউ আজ পরাস্ত নইÑসন্ধি তো যুদ্ধের নিয়মে। (সন্ধি, মাহফুজামঙ্গল) কবির এই সন্ধি সমরযুদ্ধের পাশাপাশি জীবনযুদ্ধেরও। দেশে দেশে, ব্যক্তি পর্যায়ে, স্বামী-স্ত্রীর, প্রেমিক-প্রেমিকার, রাজা-প্রজার, বিশ্বরাজনীতির কূটকৌশলের সঙ্গে; সর্বোপরি ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গেও। তাই অনেকে একে তুলনা করেছেন ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিক্যবাদের সাথে। কিন্তু মোটেও তা নয়, বরং এ কাব্যের তিন পর্বের মধ্য দিয়ে কবি মজিদ মাহমুদ তাঁর মানসপ্রিয়া ‘মাহফুজা’কে মানবিক চেতনার সমারোহে লৌকিক ও অলৌকিকতায় বিশ্লেষণ করেছেন। যেখানে প্রেম, দ্বেষ, আনন্দ ও বেদনার মুহুর্মুহু করতালির ভেতরে পৃথিবীতে বিরাজমান সকল ধর্মের মানুষের সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় সাধন ঘটেছে। আর তাই তো ‘মাহফুজা’ শুধু একা কবির নয়, ‘মাহফুজা’ হয়ে উঠেছে বিশ্ব-মানুষের, বিশ্ব-শোষণনীতির বিরুদ্ধে মানবতার। এখানেই কবি মজিদ মাহমুদের সার্থকতা। জন্মদিনে শ্রদ্ধা কবির প্রতি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App