×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৫ এএম

ফরিদ আহমদ দুলাল তিনি ধর্ম ও সংগীতাশ্রয়ী হয়ে সাড়ে তিনশতাধিক গীত রচনা করেন; পাগলপন্থী ভক্তদের ভাষায় যা আওয়াজ নামে খ্যাত ছিলো। তাঁর গুণের কারণে স্থানীয় অধিবাসী হিন্দু-মুসলমান আর আদিবাসীদের মধ্যে করমশাহর নাম ছড়িয়ে পড়ে। করমশাহর অনুসারীরাই একসময় পাগলপন্থী বলে পরিচিতি পায়। পাগলপন্থীরা গেরুয়া বসন পরিধান করতো, সবাই দাঁড়ি-গোঁফ কামিয়ে রাখতো; পাগলপন্থীদের আর এক বৈশিষ্ট্য ছিলো, তারা কখনো পায়ে জুতা-স্যান্ডেল পরতো না, ছাতা মাথায় পথে বেরোতো না। করমশাহর দুই পুত্র, প্রথম পক্ষের ছাপতিশাহ মিয়া আর দ্বিতীয় পক্ষের টিপুশাহ মিয়া। উচ্চাভিলাষী ছাপতিশাহ চাইতেন পূর্বপুরুষের জমিদারী ফিরে পেতে। টিপুশাহ তা চাইতেন না, বরং তিনি তাঁর বাবার আধ্যাত্মিক সাধনাকে ধারণ করতে আর সাধারণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে চাইতেন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে করমশাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ছাপতিশাহর ছেলে খাইশাশাহ মিয়া টিপুর প্রাণ নাশের চেষ্টা করেন। জমিদারদের ষড়যন্ত্র এবং ভাইয়ের চক্রান্তে শালকোণায় টিপুর জীবন শঙ্কার মধ্যে পড়ে; টিপু তখন তাঁর মাকে নিয়ে দুর্গাপুরের কংশ নদীর দক্ষিণে লেটিরকান্দা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। টিপুর মা, যিনি ‘মা সাহেবা’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন; তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে প্রচারিত ছিলো। সুসঙের জমিদারও মা সাহেবা এবং টিপুর ভক্ত ছিলেন। ১৮২০ সালে শেরপুরের জমিদারী ভাগ-বাটোয়ারা হয়। জমিদারদের উত্তরসূরীগণ পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন। অসহায় প্রজাদের উপর মামলার খরচ তোলার জন্য বাড়তি খাজনার চাপ দিতে থাকে জমিদাররা। প্রজারা চাপ সইতে না পেরে ক্রমে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সে সময় শেরপুর, নেত্রকোণা, ঘোষগাঁও পাহাড় ঘেঁষা পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গারো-হাজং-কোচ-ডালু-বানাই-হদিসহ অসংখ্য হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী নিজেদের টিপুর অনুসারী ভাবতো। সাধারণ মানুষ টিপুকে তখন নিজেদের আশ্রয় ভাবতে শুরু করে। বিপন্ন প্রজারা টিপুর শরণাপন্ন হলে, তিনি তাদের পরামর্শ দেন জমিদারের সাথে দেখা করতে। টিপুর কথা মতো প্রজারা জমিদারের সাথে দেখা করে, কিন্তু প্রজারা বেত্রাঘাতে রক্তাক্ত হওয়া ছাড়া কিছুই পায়নি জমিদারের কাছে। রক্তাক্ত প্রজারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে; ১৮২৪-এ প্রজারা ‘কুটুরাকান্দা’ গ্রামে এক সভায় মিলিত হয়, যেখানে তারা টিপুকেও নিয়ে যায়; টিপুর জন্য সেখানে তাঁর সহস্রাধিক ভক্ত জড়ো হয়। টিপুর অনুগামী হয়েও যায় অসংখ্য। ভক্তরা টিপুকেই শেরপুরের জমিদারীর ন্যায্য উত্তরাধিকার বলে দাবি করে এবং সেদিনই তাকে নিজেদের ‘স্বাধীন সুলতান’ ঘোষণা করে। যদিও টিপুর তখন সে বিষয়ে তেমন কোন আগ্রহ বা পরিকল্পনা ছিলো না, কিন্তু প্রজাদের দুরবস্থা এবং ভক্তদের ভালোবাসার চাপে টিপু সরকার ও জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এভাবেই আধ্যাত্মিক গুরু টিপুশাহ অকুতোভয় সমাজবিপ্লবী হয়ে ওঠেন। এরপর পাগলপন্থীরা টিপুর নেতৃত্বে শেরপুর অঞ্চল দখল করে নেয়। পাগলপন্থীরা প্রাচীন গড়জরিপা দূর্গকেন্দ্রিক এক স্বশাসন ও বিচার ব্যবস্থা চালু করে। টিপুর ঘোষণা ছিলো, “চাষীর গোলায় ফসল চাই, আল্লাহর জমির খাজনা নাই!” ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ইচ্ছায় সরকার একাধিকবার টিপুকে গ্রেফতার করে, কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে শেষবারের মতো টিপুকে গ্রেফতার করা হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১৮৫২-তে জেলখানায় বন্দী অবস্থাতেই টিপুর মৃত্যু হয়। টিপুর মৃত্যু হলেও তার ভক্ত-অনুসারীরা তাদের বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে এবং ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত ময়মনসিংহের উত্তর জনপদে পাগলপন্থী বিদ্রোহ চলে; কখনো প্রকাশ্যে কখনো বা গোপনে। পাগলপন্থীদের ধরার জন্য যখন পুলিশি তৎপরতা বেড়ে যায়, তখন বিদ্রোহীরা ফুলবাড়ীয়া, মধুপুর জঙ্গলে আত্মগোপন করে। বিদ্রোহীদের ধরতেই সে সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ চৌকি প্রতিষ্ঠা করা হয়। পুলিশ বাহিনির তৎপরতায় ক্রমান্বয়ে টিপুর অনুসারীরা বন্দী হতে থাকে এবং বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে। আন্দোলন থেমে গেলেও মানুষের মনে জমিদার এবং ইংরেজদের প্রতি যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ তা কিন্তু থেমে যায়নি।” সবুজের দুর্বার আকর্ষণ আমার বিশ্রাম-আহার কেড়ে নিয়েছে যেনো, ওর কেবিন থেকে ফিরে সারাক্ষণ ছটফট করছে মন; বারবার মনে হচ্ছে, কেনো ফিরে এলাম? ওর কাছে থাকাই তো ভালো ছিলো! আবার নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি, “ওর কি আমার প্রতি সামান্য আগ্রহ আছে? অবচেতনেও কি সে আমায় প্রার্থনা করে? যতবার আমি ওর ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছি, ততবার সে আমায় কৌশলে পাশ কেটে গেছে। পারমিতার জন্য সবুজের বুকে কি প্রেম জেগে থাকে সারাক্ষণ? যদি তাই হতো, এ ক’দিনে একবারও তো ওর মুখে শুনলাম না পারমিতার কথা! পারমিতার অঘোষিত অনুপস্থিতি নিয়ে একবারও তো কোন আক্ষেপ শুনলাম না! খেদোক্তি শুনলাম না? পারমিতাই কি ভালোবাসে সবুজকে? না-কি শুধুই রূপের চমক দিয়ে ভোলাতে চায়?” এসব ভাবতে ভাবতে বিকেল হতেই কখন যেনো পৌঁছে যাই সবুজের কেবিনে। কেনো যেনো আমার মনে হচ্ছিলো, আগামীকাল হয়তো রিলিজ করে দেবে ওকে। সবুজ রিলিজ নিয়ে চলে যাবে ভাবতেই বুকটা হুহু করে ওঠে। আমি কবির কেবিনের দরোজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। মগ্ন হয়ে সবুজ কিছু লিখছিলো। এতটাই মগ্ন, আমার উপস্থিতি টেরও পায়নি। আমি কবির মগ্নতা ভাঙতে চাইনি, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। মুখের সামনে থেকে সবুজ খাতাটা বালিশের পাশে নামিয়ে রাখলে আমি কথা বললাম, “কবি কি নতুন কবিতা লিখছে না-কি?” সবুজ ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় দেখলো। মৃদু হেসে বললো, “একটা খসড়া দাঁড় করালাম।” আমি ওর বিছানার কাছে গিয়ে বললাম, “আমায় কি পড়তে দেয়া যায়? সদ্য ভূমিষ্ঠ কবিতার প্রথম পাঠক হবার সুযোগ কি দেয়া যায় আমায়?” আমার কথায় আবার হাসলো কবি, ওর চোখে অনীহার আভাস, “আসলে খসড়া কবিতা না পড়াই ভালো। হয়তো ভালো না-ও লাগতে পারে।” আমি আগ্রহ নিয়ে কবির খেরোখাতার দিকে হাত বাড়ালাম, “ভালো না লাগুক, তবু আমি পড়তে চাই। এ-তো আমার কম বড় সৌভাগ্য নয়, প্রিয় কবির খসড়া কবিতার প্রথম পাঠক হলাম।” এবার কবি সশব্দে হাসলো, “সে-তো তুমি আগেও হয়েছে।” কবি তার খাতার উপর হাত রাখলো, আমিও হাত বাড়ালাম, বললাম, আবার হতে চাই! বারবার হতে চাই!” খাতাটা আমার হাতে চলে এলো; আর কাড়াকাড়ির সুযোগে কবির স্পর্শ এলো বাড়তি পাওনা হয়ে। কী সুন্দর ঝরঝরে হস্তাক্ষর কবির; প্যাচানো অথচ স্পষ্ট। আমি শব্দ করে পড়লাম কবিতাটা।   স্বার্থপর পরিপার্শ্বে   শ্লথগতি-বিষে আত্মহননের পথে হেঁটে যাই দিগন্ত পেরিয়ে বোঝা যায় কোথাও কিনার নাই! জলমগ্ন প্রান্তরে কোথাও নেই কোন বৃক্ষছায়া ঘোলাজলে বিষক্রিয়া কণ্টকাকীর্ণ কাণ্ডে কোথায় মায়া? ভাসিতেছে জলে বিষধর শত সাপ আর আছে আমার আজন্ম সত্য উচ্চারণ-পাপ; স্বার্থান্ধের কাছে প্রকাশ করেছি বুকের সন্তাপ; যদিও কোথাও দীর্ঘ সাঁতারের পর ডাঙার সাক্ষাৎ পাই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীরে তখন জাগে শুধু অনন্ত তৃষ্ণাই অথচ সেখানে ক্ষুধার্ত মাংসাশী হিংস্র প্রাণী ছাড়া কিছু নাই; ‘জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ’ এ আমার অমোঘ নিয়তি আজ তবুও ফোটাই সবার কল্যাণে কাগজের মেকি গন্ধরাজ।   ফুলমালা নিয়ে যারা আসে, শিকারের লোভে জলে ফেলে ছিপ কী করে বুঝি গো সোনা মুখোশের আড়ালে তারাও সরীসৃপ! মধু মুখেতে অন্তরে বিষ, হাসি-কান্না মিলে লীলাবতী মায়া রোদ্দুর দেবার নামে সারাবেলা ফেলে রাখে ছায়া, মওকায় অমৃতচুম্বন দেবার ছলনায় চালায় খঞ্জর সর্বস্ব দেবার ভণিতায় হাসে শুদ্ধ-স্বার্থপর।   কবিতাটা পড়ে আমার মাথা চক্বর খেলো। একবার মনে হলো এ কবিতা পারমিতার বিরুদ্ধে অভিমান করে লেখা, আবার মনে হলো, আমার বিরুদ্ধে লেখা নয় তো? কিছুতেই মেলাতে পারছি না। ভেতরে ভেতরে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। উত্তেচনার বশে বলতে থাকলাম, “কী অর্থ এ কবিতার? কেনো এতো অভিমান? কার বিরুদ্ধে অভিমান? কেনো এই খেদোক্তি? কার বিরুদ্ধে লিখেছো এ কবিতা?” সবুজ কোন উত্তর করলো না, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। উত্তজনায় আমার দু’চোখে জল গড়ালো। আমি সবুজের বিছানা থেকে একটু দূরে বসে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছি। একটু পর সবুজ হাসলো, হেসে আমায় কাছে ডাকলো, “পাহাড়-দুহিতা, কাছে এসো।” আমি কোন কথা না বলে নিঃশব্দে সবুজের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবুজ আমার মাথায় একটা হাত রেখে বললো, “কী আশ্চর্য! পাহাড়-দুহিতার চোখে জল? কেনো? আমার কবিতা পড়ে তুমি কেনো কষ্ট পাচ্ছো? এ কবিতা তো কোনো ব্যক্তিকে আক্রমণ নয়। এ কবিতা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধেও নয়। একটা কথা বুঝতে চেষ্টা করো, কবিতার প্রসাদগুণের অন্যতম হচ্ছে তার নৈর্ব্যক্তিক উপস্থাপনশৈলী। কবিতা যদি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ হয়, তাহলে সে কবিতা কেনো মানুষ পড়বে? আমার ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভব-মান-অভিমান-আনন্দ-বেদনা-দুঃখ-কষ্ট-শোকে তুমি কেনো আন্দোলিত হবে? হ্যাঁ, আন্দোলিত হবে তখন, যখন তোমার মনে হবে কষ্ট-আনন্দ-অভিমান-বেদনাটি তোমারও; আমার প্রতিবাদ-ঘৃণা-দ্রোহ তোমারও; আমার কবিতায় তুমি আন্দোলিত হবে তখন, যখন আমার অপ্রাপ্তির সাথে তোমার অপ্রাপ্তি মিশে একাকার হবে। এ কবিতা আমি সমকালের বিরুদ্ধে লিখেছি, স্বার্থান্ধতার বিরুদ্ধে লিখেছি। ব্যক্তির বিষয়টিকে আমি সামষ্টিক দৃষ্টিতে উপস্থাপন করতে চেয়েছি। এখন কথা হচ্ছে একজন কবির পক্ষে তো ঘরে ঘরে গিয়ে পাঠককে কবিতার বিষয় বুঝিয়ে দেবার সুযোগ নেই; সুতরাং পাঠক তার নিজের মতো করে যা বুঝবেন সেটাই প্রধান; সে ক্ষেত্রে পাঠক যদি কবিতার বিষয় বুঝতে অক্ষম হয়, তাহলে সেই বিশেষ পাঠকের জন্য আমি কবি ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতা থেকে মুক্তির পথ কবিকেই খুঁজে নিতে হবে।” কথাগুলো দম নিয়ে সুস্থিরচিত্তে টানা বলে গেলো কবি। আমি অবাক বিস্ময়ে শুনলাম। কবির কথায় আমি দিশা খুঁজে পেতে চাইলাম; কিন্তু দু’চোখে কেবলই অন্ধকার দেখলাম। “আমি জানি না! তোমার এ কবিতাটা আমায় বুঝিয়ে দাও। কোথায় এ কবিতার নৈর্ব্যক্তিকতা!” আমার কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়লো। সবুজ দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক পাঠককে কবিতা বুঝিয়ে দেয়া কবির দায় নয়; কিন্তু পাঠক যখন কবির কবিতা বুঝতে ব্যর্থ হয়, সে দায় থেকে কবির মুক্তি নেই। আবার এটাও ঠিক, কবি যে কথা ভেবে কবিতা লিখলেন, পাঠক তাকে ভিন্নভাবে ভাবতেই পারেন; এবং বিভিন্ন পাঠক একই কবিতার বিভিন্ন অর্থও করতে পারেন; কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণের লক্ষ্য না করলেই হলো।” কবিতার বিষয়টি আমার কাছে ক্রমশই যেনো জটিল হয়ে পড়ছিলো সবুজের বিস্তৃত ব্যাখ্যায়; কিছুটা অস্থির হয়েই বললাম, “এতো ঘুরিয়ে ব্যাখ্যা করে কেনো আমায় গোলক ধাঁধায় ফেলছো! সরাসরি বলে দাও না, কোন বিবেচনাকে বুকে রেখে এ কবিতাটি লিখেছো তুমি?” সবুজ এবার সামান্য শব্দ করে হাসলো, “কবিতা বিষয়টিই ব্যাখ্যার। মনে রাখতে হবে, যে কাহিনি দেড়শ পৃষ্ঠার উপন্যাসে লেখা হয়, একই গল্প লেখা হয় বিশ লাইনের একটা কবিতায়। সুতরাং কবিতা মূলতই ব্যাখ্যার; তা কবির জন্য যতটা, পাঠকের জন্য ততটাই। কেউ কেউ কবিতা থেকে ‘গতি’টাকে পড়ে আনন্দ আহরণ করেন, কেউ ‘সুর’টাকে উপলব্ধি করে আনন্দ পান, কেউ ‘ছন্দ’টা অনুভব করে আনন্দ পান, কারো হয়তো রসাস্বদনেই আনন্দ; তাদের কবিতার গভীরে না ডুবলেও চলে; আনন্দ পাওয়াটাই সবার কাছে বড়। কিন্তু যদি কেউ কবিতার গূঢ় সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে চায়; তার দহন-খনন ছাড়া বিকল্প কী? তুমি কতটা গভীরে যেতে চাও সেটা তোমার নিজস্ব বিষয়।” সবুজ যেনো কবিতা নিয়ে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। মুখ নিচু করে চোখ বন্ধ করে সে। সবুজকে আমার বড্ড ক্লান্ত মনে হয়। আমি ওর মাথাটা নিজের স্কন্ধে জড়িয়ে নিয়ে চুলে আঙুল চালিয়ে বলি, “আমি তোমার কাছে তোমার ব্যাখ্যাটা জানতে চাই এবং নিজেও বুঝে নিতে চাই কবিতার স্বরূপ।” আমার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার তাড়া তার মধ্যে লক্ষ করলাম না, কিন্তু ধীরে নিজেকে মুক্ত করে নিলো সতর্কতায়।   ॥ ৮ ॥ “মানুষের মন কোনো যন্ত্র নয়, বোতাম টিপলেই চালু হয়ে যায় না, আবার বোতাম টিপলে বন্ধ হয়েও যায় না! তুমি বললে এ্যাটেনশান, আমি এ্যাটেনশান হয়ে গেলাম! তুমি বললে স্ট্যান্ডার্ডইজ, আমি স্ট্যান্ডার্ডইজ হয়ে গেলাম? আমি তেমন যন্ত্রমানব নই। তুমি বললে আর আমি মাইন্ড সেট-আপ বদলে ফেললাম! দয়া করে আমায় তুমি ম্যান্টালি টর্চার করো না! আমাকে আমার গভীরে থাকতে দাও। আমার নিরালোক ভুবন আলোকিত করতে কৃত্রিম আলোর প্রশ্রবণ চাই না কারো কাছে। আমি পাহাড়ের মেয়ে, আমি জানি কী-করে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বাঁচতে হয়। আমার অবহেলিত জনপদ শৈশব থেকেই আমায় শিখিয়েছে, মানুষের প্রতি মানুষ কতটা রূঢ় হতে পারে, কতটা নির্মম হতে পারে, স্বার্থের প্রয়োজনে মানুষ কতটা ক্রুর হতে পারে মানুষের প্রতি, সে আমি শিশুকাল থেকেই জানি। আবার মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা-মমত্বে কতটা স্নেহান্ধ হতে পারে মানুষ, কতটা দয়ার্দ্র হতে পারে, তা-ও আমি শিশুকাল থেকেই দেখে এসেছি।” গভীর আবেগে একটানা কথাগুলো বলতে বলতে আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলো, দু’চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিলো আমি টের পাইনি। সবুজ আমায় কাছে ডেকে ওর খাটে বসালো আদর করে। তারপর মৃদু স্বরে বললো, “পাগল মেয়ে! আমি কি তোমায় খারাপ কিছু বলেছি? বলেছি, যে কোনো পরিস্থিতির জন্য আমাদের মাইন্ড সেট-আপ থাকা প্রয়োজন। মানুষ যখন বলে, তখন শোনে কম, যখন শোনে, তখন বলে কম, আবার যখন কাজে মগ্ন থাকে তখন বলেও কম, শোনেও কম। তুমি আমার জীবনাচার সম্পর্কে ভালো জানো না। আমি বাতাসের বেগে ছুটে চলা মানুষ। উড়নচণ্ডী বলতে পারো, কিন্তু ব্যাগাবন্ড বললে মানবো না। আমি আমার মধ্যে বিচিত্র এক স্বভাব ধারণ করি। অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে আমায় এতোটাই বিচলিত থাকতে হয় যে, স্ব-প্রনোদিত হয়ে আমাকে কখনো মাইন্ড সেটআপ করতে হয় না। বাকুল্যা বাতাস পাওয়া ঘুড়ির মতো আমি অজানার পথে উড়ে যাই, কষ্ট পাবার সময়ই পাই না। কখনো ইচ্ছা থাকলেও আমি আমার জন্য পাওয়া কারো কষ্ট মোচনে পৌঁছে যেতে পারি না তার কাছে; আমি যে বাকুল্যা পাওয়া পথহারা ঘুড়ি। তুমি চাইলেই কেনো বুনো বাতাস মোকাবেলায় ঘুর্ণাবর্তের সমুখে দাঁড়াতে পারবে? এ সত্যটা বিবেচনা করেই তোমাকে বলেছি, মাইন্ড সেট-আপ করে রাখতে। বন্ধু হিসেবে তোমাকে একটু সতর্ক করা কী আমার দায়িত্ব নয়? আমার আজকের কবিতাটির কথাই ধরো, কবিতায় আমি কী বলতে চেয়েছি? পরিপার্শ্বের কঠিন বাস্তবতা, প্রবঞ্চক সময় যখন স্বজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেয়, যখন সামান্য স্বার্থের জন্য সময় পিতৃঘাতী হয়ে ওঠে, তখন আমরা কার উপর আস্থা রাখতে পারি? আত্মরক্ষার্থে জলমগ্ন পিতা তখন কোথায় আশ্রয় নেবে, যখন জলাশয় জুড়ে টহল দিচ্ছে বিষধর সর্পকুল? তখন যদি আত্মসম্মান রক্ষার্থে সময় শ্লথগতি বিষ প্রয়োগে আত্মহননের পথ বেছে নেয়, সে-কি তার অপরাধ? ভাবো ১৯৭৫-এর পর এ কয়েক বছরে আমাদের জীবনে কী ধরনের আত্মঘাতী পরিবর্তন সূচিত হয়েছে? ভাবতে পারো একদশক আগেই যে জনপদের মানুষ আত্মপরিচয়ের সন্ধানে মাত্র নয় মাসে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ উৎসর্গ করার স্পর্ধা দেখাতে পারে; সমস্ত শৌর্যবীর্য-আত্মত্যাগের মহিমা ভুলে আমরা যদি অন্ধকারের দিকেই পা বাড়াই; তা-কি আত্মহননের সমান নয়? আজকের এই বিরুদ্ধ স্রোতে, এই অসহনীয় পরিস্থিতিতে, যারা স্বাধীনতার চেতনাকে বুকে ধারণ করে, তাদের প্রত্যেককে মাইন্ড সেট-আপ করবার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিৎ নয়? এ সত্যটাই তোমাকে বলেছি। সত্যিই তো কোনো এক বিমর্ষ সকালে ঘুম ভাঙলে টের পাবে পৃথিবীতে আলোর স্বল্পতা, আসলে সেদিন সকাল থেকে পূর্ণসূর্যগ্রহণ ছিলো; একদিন হঠাৎ আমায় খুঁজে পাবে না কোথাও; কেউ কিছু বলতেই পারবে না উড়নচণ্ডী কবির খবর। তখনও তোমাকে বাঁচতে হবে, তখনও তোমার দিন কেটে যাবে ব্যস্ততায়; তাই বলি জীবনে সমস্ত পরিস্থিতির জন্য মাইন্ড সেট-আপ করার প্রস্তুতি থাকা উচিৎ।” সবুজ থামে। সবুজের লম্বা কথার পর আমারও ইচ্ছে করে কিছু বলি, “আচ্ছা তুমি এত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে কথা বলো কেনো? পৃথিবীর অনিশ্চিত জীবনে যখন যে পরিস্থিতি সামনে আসে, মানুষ তাকে মোকাবেলা করবেই; আর মোকাবেলা করতে না পারলে আত্মসমর্পণ করবে জীবনের কাছে। কখনো জলোচ্ছ্বাস হবে, সে কথা ভেবে মানুষ আগেই সব গোছগাছ করে রাখে না; জলোচ্ছ্বাসের আভাস পেলেই জাগে, না হয় নিয়তির কাছে হেরে যায়। অবশ্য কখনো জলোচ্ছ্বাস আসবে না জীবনে তেমন নিশ্চিত হলে কেউ, সেটা হবে বোকামি। তুমি বাকুল্যা বাতাসলাগা ঘুড়ি, বাতাস তোমায় যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকেই যাবে; তার মানে তোমার নিজের কোনো ভালোলাগা-মন্দলাগা নেই; সম্পূর্ণ নিয়তি নির্ভর তুমি! আমি তা নই, নিজের ভাগ্য আমি নিজেই রচনা করে নিতে চাই, আর শেষাবধি সংগ্রাম করতে চাই। আগে থেকে মাইন্ডসেট করে নিতে চাই না। মাইন্ডসেটেও সমস্যা আছে; আকাক্সক্ষা পূর্ণ না হলেও কষ্ট, আবার অযাচিত কিছু পেলেও আত্মস্থ করার ঝক্কি। মাইন্ডসেট করি একটাই, জীবনটা পুষ্পোদ্যান নয়, এখানে সতত লড়াইÑপ্রতিদিন বাঁচার সংগ্রাম। তাছাড়া ‘মাইন্ডসেট’ তোমার কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে কেনো? তুমি তো নির্ভারÑনিয়তি-নির্ভর! ‘মাইন্ডসেট’ কিছুতেই তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না।” এতোগুলো কথা বললাম, এবার কিন্তু আমার গলা কাঁপলো না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App