×

সাময়িকী

সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৮ এএম

সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ
তপন বাগচী বাংলাদেশের ফোকলোরচর্চায় শামসুজ্জামান খান এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। আধুনিক ফোকলোরচর্চায় পথিকৃৎ তিনি। বাংলাদেশের ফোকলোরকে বিশ^পরিমণ্ডলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির অনেক উপকরণই আজ বিশ^প্রেক্ষাপটে স্বকীয় মর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসবের পেছনের তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা আজ সুবিদিত। কেবল ফোকলোর নয়, প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি মীর মশাররফ হোসেন ও মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছেন। বাঙালির মনীষাকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে তার অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই কারো। ফোকলোরচিন্তার পাশাপাশি তার সমাজচিন্তা ও বঙ্গবন্ধুচিন্তা সমগুরুত্বে আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশে জাতীয় জাদুঘর ও বাংলা একাডেমির মতো তিনটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের তিনি মহাপরিচালক হিসেবে দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। সেখোন থেকে বাংলা একাডেমির সভাপতি পদ অলঙ্কৃত করেন। এই পদে থেকেই তিনি অতিমারির কবলে পড়ে নশ^র দেহ ত্যাগ করেন। এই প্রবীণ প্রাজ্ঞ ও মনীষীতুল্য ব্যক্তির মূল্যায়নে ব্রতী হয়েছেন আমাদের দেশের অগ্রসারির সুধীজনেরা। তাদের মূল্যায়ন ও মন্তব্য থেকে আমরা শামসুজ্জামান-মানস অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে পারি। ব্যক্তিমানুষ বড় না হলেও তার কাজকেও কেউ সহজে গুরুত্ব দিতে চায় না। আমরা জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কাছ থেকে জানতে পারি শামসুজ্জামান খানের ব্যক্তিচরিত্র সম্পর্কে। তিনি বলেছেন. ‘ব্যক্তিগত আচরণের ক্ষেত্রে শামসুজ্জামান খান স্বল্পভাষী, মৃদুকণ্ঠ এবং বিনয়ী। আমি তার মধ্যে কখনো পাণ্ডিত্যের অভিমান বা ঔদ্ধত্য লক্ষ করিনি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আনিসুজ্জামানকে। প্রথমে প্রফেসর ইমেরিটাস ও পরে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার প্রিয় ছাত্র সম্পর্কে যে মূল্যায়ন জানিয়েছেন তা এমন, ‘মীর মশাররফ হোসেন বা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী বা বিশ শতকের অন্যান্য সাহিত্যিক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রথমেই সে জ্ঞাত তথ্যের বাইরে অনুসন্ধান করেছে এবং সৌভাগ্যক্রমে নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছে। তার ভিত্তিতে এরপর সে তৈরি করেছে নতুন ভাষ্য। বিবি কুলসুম বা এছলামাবাদীর আত্মজীবনীর পুনরুদ্ধার যেমন তার কৃতিত্ব, তেমনি তার থিত্তিতে মশাররফ হোসেন ও এছলামাবাদীর জীবন ও রচনা সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যাদান আমাদের জ্ঞানের জগৎকে সম্প্রসারিত করেছে।’ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য বিশ^জিৎ ঘোষও এ সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। তিনি বলেন, ‘লোকসংস্কৃতিকে আধুনিক দৃষ্টিকোণে আবিষ্কার ও সে সম্পর্কে গবেষণায় আমাদের দেশে তিনি পালন করেছেন পথিকৃতের ভূমিকা। লোকসংস্কৃতির বাইরে অন্য যে বিষয়টির প্রতি শামসুজ্জামান খানের গভীর আগ্রহ, তা হচ্ছে মীর মশাররফ হোসেন ব্যক্তিজীবন ও তার সাহিত্যকর্ম। শামসুজ্জামান খানের গবেষণায়র মাধ্যমেই আমরা মীর মশাররফের ব্যক্তিজীবনের নানা অজানা তথ্যের সন্ধান পেয়েছি, তার নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলেই আমরা পেয়েছি মশাররফ হোসেনের অনেক না-জানা সাহিত্যকর্ম।’ শামসুজ্জামান খান অনেক প্রতিভাকে খুঁজে এনে যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। এটিও একজন মানুষের কম কৃতিত্ব নয়। সেই কৃতিত্বের কথা শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন এই সময়ের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক যতীন সরকার। তার বিনীয় আত্মভাষ্য থেকে জানা যায়, ‘পরিশীলিত নাগরিক মানুষদের সমাজে আমি একেবারেই বেমানান। সেই অকৃতী আমাকেই কিনা রাজধানীর সারস্বত মহলে ও গুণীজ্ঞানীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে কী উদগ্র আগ্রহই না শামসুজ্জামান প্রকাশ করেছেন। বলতে গেলে, প্রতিনিয়ত তিরস্কার করে করেই তিনি আমাকে লেখক ও গ্রন্থকার বানিয়ে তুলেছেন। এবং তার তিরস্কারই আমাকে এমন সব পুরস্কার এনে দিয়েছে, যেগুলো কোনোমতেই আমার প্রাপ্য নয়।’ শামসুজ্জামান খান প্রাবন্ধিক হলেও কবিদের সঙ্গে রয়েছে চসমৎকার সখ্য। ষাটের দশকের খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে তিন-তিনটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হতে পারার বিরল সৌভাগ্য একমাত্র তারই হলো। এই ঘটনাটি একই সঙ্গে যেমন তার সৌভাগ্যের স্মারক, তেমনি একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তার যোগ্যতার পরিচয়ও বহন করে বটে!’ ষাটের আরেক খ্যাতিমান কবি মহাদেব সাহার ভাষ্যÑ‘শামসুজ্জামান খান লোকজীবন, লোকসংস্কৃতি ও লোককলার গবেষক এবং ইতিহাসমনস্ক ও বিজ্ঞানদৃষ্টিসম্পন্ন সমাজনিরীক্ষক। ইতিাহসচর্চা তার চেতনাকে আরো শাণিত করেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন, সেকুলার ও আধুনিক মানুষ। কুসংস্কার ও গোঁড়ামি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনো।’ ষাটের আরেক জনপ্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী দীর্ঘদিন তার সহকর্মী ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন তার সফরসঙ্গী হওয়ার অভিজ্ঞতার কথাÑ ‘... একটি হাদিস শুনেছিলাম, এক মিলাদ শরিফে; হুজুর বলেেিছলেন, একটি মানুষকে যদি চিনতে চাও, তার সঙ্গে সফর কর। যাত্রার সঙ্গী হিসেবে শামসুজ্জামান খান সাহেব অতুলনীয়। বিরক্তিকর মুহূর্তগুলো তার কথার ছটায় পেট ও চোয়াল ব্যথা করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। আবার কে খেয়েছে, ঘুমানোর জায়গা পেল কিনা, যে কাজের জন্য যাওয়া সেটাও ঠিক-ঠাক আছে কিনা এসবের ব্যাপারে তীক্ষè নজর রাখাÑ না, তুলনা হয় না এই মানুষটির।’ শিল্পী হাশেম খান তার দীর্ঘদিনের বন্ধু। ‘বন্ধু জামান’ সম্বোধনে তার আন্তরিক মূল্যায়ন এমন, ‘সেই প্রথম দিনের পরিচয় থেকেই দেখেছি তোমার ব্যবহারে একটি চমৎকার বৈশিষ্ট্যÑ সহজ সরল ব্যবহারে অতি অল্প সময়েই তুমি মানুষকে কাছে টানতে পার। আর কাছে টানার প্রধান গুণটি হলো তোমার অমায়িক হাসি। বিস্ময়কর হলেও সত্যি প্রথম পরিচয়ের পর থেকে আজ ৫৪ বছর পর্যন্ত তোমার চারিত্রিক এই অমায়িক ব্যবহার ও কাছে টানার হাসিটি যথাযথ ও অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছ।’ লেখক শামসুজ্জামান খানকে মূল্যায়ন করেছেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা  হোসেন। বাংলা একাডেমিতে তার সহকর্মী থাকার সময়ে নানান সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করে তিনি তিনি জানান, ‘পড়তে ভালবাসি তার ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে রচিত প্রবন্ধ। তার আর একটি যে বই আমার প্রিয় তা হলো ‘মুক্তবুদ্ধি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমকাল’। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। জ্ঞানের চর্চা করেন মুক্তবুদ্ধির বোধে। তার সহজ অনুধাবনে জীবনবোধ ব্যাপ্ত হয়ে থাকে আলোর শিখায়। তার চিন্তায় মানুষ এবং মানুষের জন্য জায়গা সংকুচিত হয়ে আসে না।’ শাহরিয়ার কবির ছিলেন জগন্নাথ কলেজে শামসুজ্জামান খানের প্রত্যক্ষ ছাত্র। শিক্ষক শামসুজ্জামান খানের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনিÑ‘শিক্ষকদের আমরা বলি মানুষ গড়ার কারিগর। অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান অন্যত্র যত গুরুত্বপূর্ণ কাজই করুক না কেন আমার কাছে তার বড় পরিচয় শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষকতা জীবনে অসংখ্য আলোকিত মানুষ তিনি সৃষ্টি করেছেন। এই হাজারো মানুষের সারিতে নগণ্য আমিও একজন।’ শামসুজ্জামান খান ‘দিনলিপি’ নিয়ে মূল্যায়ন করেছেন কবি আবুবকর সিদ্দিক। তিনি জানিয়েছেন তার মুগ্ধতার কথা, বিস্ময়ের কথা।Ñ ‘শামসুজ্জামান খানের ‘দিনলিপি’ পড়ে যতখানি না সমৃদ্ধ হয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্মিত হয়েছি, মূল লেখকের বাস্তব পরিচিতি ছাপিয়ে ওঠা অন্য এক দেশ-সমাজ-রাজনীতি বিষয়ে ডিটেইল সচেতনতা, নিজের নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শবোধের প্রতি অটল দায়বদ্ধতা ও অকপট আত্মপ্রকাশের নিদর্শনে। সেই চির অম্লান স্মিত হাসি ও মিতভাষী সৌজন্যের গভীরে এতক স্পষ্টবাদী ও খরচেতন প্রত্যয়ী ব্যক্তিত্বেও নিরাপদ অস্তিত্ব; এই আশ্চর্য আবিষ্কারে আমি সত্যি বিস্মিত।’ একই কর্ম নিয়ে আলোচনা সূত্রে তরুণকবি পিয়াস মজিদের মূল্যায়ন এমনÑ ‘ব্যক্তির সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব করে মহাকাল। তবে শামসুজ্জামান খানের মতো স্বল্পসংখ্যক মানুষই এমন মহত্তর আত্মজিজ্ঞাসায় তাড়িত। ইতিহাসের বিশ^াসযোগ্য অবয়ব তৈরিতে এখন আত্মজীবনী, দিনলিপি, স্মৃতিকথা ইত্যাদিও গুরুত্ব সুগ্রথি তথ্যমালার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। শামসুজ্জামান খানের আলোচ্য দিনলিপিও ব্যক্তির অন্তর্ভেদী উন্মোচনের সমান্তরালে উদ্ঘাটন করে চলে ইতিহাসের আলো-ছায়াময় অধ্যায়ের বিস্তৃত পরিসর।’ কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই লেখেন, ‘বাঙালি মুসলমান সমাজ এবং তার বিভিন্ন অনুষঙ্গ শামসুজ্জামান খানের বিশ্লেষণের বিষয় হয়েছে একাধিক প্রবন্ধে। এমনকি তিনি যখন কোনো মুসলিম মনীষীর চিন্তা-ভাবনা ও কাজ নিয়ে আলোচনা করেছেন তখন সেসব সমাজের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটেই উপস্থাপিত হয়েছে। মনে-প্রাণে এবং চিন্তাচেতনায় অসাম্প্রদায়িক প্রবন্ধকার হওয়ার জন্য মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতার প্রভাব প্রমাণ করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে। এটি গবেষক-লেখক হিসেবে তার প্রবণতার একটি উল্লেখযোগ্য দিক।’ একই পরিচয় পাওয়া যায় বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনোর বক্তব্যেÑ ‘অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার মানুষ। তার গবেষণা কাজ থেকেই বোঝা যায় যে তিনি কেবল অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদীই নন, তিনি সাম্যভিত্তিক সমাজেও বিশ্বাসী। তার প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনার মধ্যে ফুটে উঠেছে।’ শামসুজ্জামান খানের ফোকলোরচর্চায় বিস্তৃত পরিচয় দিয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লালনবিদ আবুল আহসান চৌধুরী। তার মূল্যায়নে জানা যায়Ñ ‘যারা নিরন্তর শ্রম ও নিষ্ঠায় ফোকলোরচর্চায় যুক্ত, তাদের অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেও বলতে হয়, বাংলাদেশে আধুনিক ফোকলোরচর্চায় যে শূন্যতা, তা পূরণের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যাদের আছে বলে মনে করা যায়, নিঃসন্দেহে শামসুজ্জামান খান তাদের মধ্যে অগ্রণী এবং যোগ্য ও মেধাবী।’ ফোকলোরচর্চার পরিচয় নিয়ে অন্যরকম মূল্যায়ন রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক মাহবুবুল হকের। তিনি বলেন, ‘... সাম্প্রতিক বিশ্বের ফোকলোরচর্চার ধারার সঙ্গে বাংলাদেশের ফোকলোরচর্চাকে সম্পর্কিত করার ক্ষেত্রে জামানভাইয়ের অবদান অসামান্য। বলতে গেলে এক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। বর্তমান বিশ্বের প্রথম কাতারের ফোকলোরবিদদের নিয়ে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের কর্মশালার আয়োজন করে তিনি বাংলাদেশেওে ফোকলোরচর্চার উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। তার বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের ফোকলোরচর্চা তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত দিক থেকে বৈশ্বিক চিন্তাধারার সঙ্গে যোগসূত্র রচনায় অনেকখানি এগিয়ে গেছে।’ ফোকলোরচর্চা নিয়েই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বলেছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক মফিদুল হক। তার ভাষায়Ñ‘শামসুজ্জামান খান বাঙালির চেতনার নিরিখে বাংলাদেশের রাষ্ট্রাদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনন্য অবদান রচনা করে চলেছেন লোকায়ত সম্পদের রূপদর্শন ও বৈশিষ্ট্যবিচারে তার শাণিত সমগ্রদৃষ্টি দ্বারা। এ ক্ষেত্রে ফোকলোর হয়েছে তার বিবেচনার কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু তিনি নিছক ফোকলোরবিদ নন, তিনি তার অধ্যয়ন ও উপলব্ধিকে মিলিয়ে নিতে পারেন সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন-জিজ্ঞাসার সঙ্গে এবং তার দর্শন ও কর্মেও মধ্য দিয়ে ফোকলোর হয়ে ওঠে জাতির স্বরূপ অন্বেষার বড় অবলম্বন ও সহায়।’ সালাহউদ্দীন আইয়ুব বলেন, ‘শামসুজ্জামান খানের কৃতিত্ব হলো সনাতন বিষয়ের ফ্রেম বদলে ফেলা : আলোকপাতের পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটানো। স্বভাবতই তার পদ্ধতি তুলনামূলক; বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে যা ঘটেছে, পৃথিবীর অন্য জায়গার ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যে তার তুলনা সম্ভবপর, তা তিনি দক্ষতার সঙ্গে উত্থাপন করেছেন।’ বাংলা ভাষার খ্যাতিমান ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন জানিয়েছেন শামসুজ্জামান খানের বঙ্গবন্ধুপ্রেমের কথা। তার ভাষায়Ñ‘জামান ভাইকে আমি একজন নিখাত অকৃত্রিম বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক হিসেবে জানি। পুরনো দিনের আলোকচিত্রেও আমি তরুণ শামসুজ্জামান খানকে দেখেছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমির অল্প কজন কর্মকর্তাকে নিয়ে মহাপরিচালক মযহারুল ইসলাম গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। ওই দলে উপপরিচালক জামান ভাইও ছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ ও প্রাসঙ্গিক কথকতা’ নামে একটি বইও লিখেছেন জামান ভাই। সেই জামান ভাইকে আমি যখন ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের অন্যতম কুশীলব হিসেবে আবিষ্কার করি তখন আর বিস্মিত হই না।’ আরেকটি পরিচয় উঠে এসেছে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহারের বিশ্লেষণে, ‘বাংলা সন নিয়ে তার লেখা ‘বাংলা সন ও তার ঐতিহ্য’ (১৯৯৪) বইয়ের মধ্য দিয়ে বিস্তারিতভাবে এর ইতিহাস আমাদের সামনে আসছে। এর উত্তরোত্তর তথ্যাদিও তিনি হালনাগাদ করে চলেছেন প্রতিনিয়িত দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকার পাতায়। বাংলা নববর্ষের সূত্রে বাঙালির লোকজীবনের সঙ্গে এর নাগরিক সম্পর্কও নির্ণয় করে চলেছেন তিনি।’ অনেক গুণী মানুষ তার মূল্যায়ন করেছেন। আরো অনেকেই করবেন। বছর চারকে আগে নদিয়ার ‘কথাকৃতি’ পত্রিকা আমাকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা বের করতে চাইল। সম্পাদক নীলাদ্রি শেখর সরকারের ইচ্ছা, তাতে যেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের একটা আশীর্বাণী পায়। সম্পাদকের আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিলাম তার হাতে। তিনি বললেন পরের দিন যোগাযোগ করতে। পরের দিন দেখা করতে গেলে একটি খাম ধরিয়ে দিলেন, তাতে লেখা- ‘তপনকে শুভেচ্ছা। কবিতা লেখার পাশাপাশি তপন বাগচী প্রবন্ধ, ছড়া ও গান লেখে। সম্প্রতি সে গান লিখছে। বাংলাদেশের ফোকলোরচর্চায় তার অবদান রয়েছে। বিশেষত ‘যাত্রাগান’ নিয়ে তার গবেষণাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। লোকসংগীত নিয়েও তার কিছু প্রবন্ধ রয়েছে। সে বাংলা একাডেমিতে কাজ করে। যুগপৎ সৃজনশীল ও মননশীল এই লেখকের ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে যারা অনুষ্ঠান ও পত্রিকা প্রকাশের আয়োজন করেছে, আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। তপন বাগচীর ৫০তম জন্মদিনে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল।’ এটি ছাপা হয় কথাকৃতিতে। সম্পাদকের পাঠানো সৌজন্য কপি হাতে পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘আরে তোমার ওপর ৬৩৪ পৃষ্ঠার পত্রিকা বেরিয়েছে। খুবই আনন্দের খবর। কিন্তু আেেগ বুঝতে পারলে তো একটা বড় লেখা দিতে পারতাম’। এই হচ্ছে শামসুজ্জামান খানের সৌজন্যপরায়ণতা, তরুণদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে উদারতা। আমরা জানি সমকাল কোনো প্রতিভারই সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে না। কিন্তু সাম্প্রতিক এসব মূল্যায়নে একজন শামসুজ্জামান খানের যে পরিচয় আমরা পাই, তাতে একটু অতিশয়োক্তি মনে হয় না। বরং বলতে পারি তার সামগ্রিক রচনা ও কর্মের যথাযথ মূল্যায়নের অবকাশ আরো রয়ে গেছে। কারণ তিনি চলমান নদীর মতো এখনো প্রবাহিত, এখনো সমান সক্রিয় রয়েছেন সৃষ্টিতে। পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নে সুযোগ এলে আমরা বুঝতে পারবো, একজন শামসুজ্জমান খান তার সময়ের তুলনায় অনেকখানি এগিয়ে, সমাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি অনেকের চেয়ে অগ্রণী মানুষ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App