×

সাময়িকী

বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল মুখ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৬ এএম

বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল মুখ
শিবুকান্তি দাশ আমাদের শিশুসাহিত্যের এক উজ্জ্বল মুখ সুজন বড়ুয়া। তার বিচরণ শিশুসাহিত্যের সব শাখায় হলেও কিশোর কবিতা চর্চার জন্য তিনি দেশে  এবং দেশের বাইরে সর্বাধিক পরিচিত। কিশোর কবিতাই তার খ্যাতির প্রথম সোপান। কিশোর কবিতা চর্চার ধারাটিকে প্রধানত তিনিই বেগবান করেন। ছড়া দিয়েই তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন কিন্তু ছড়া চর্চার মধ্যে বেশিদিন সীমাবদ্ধ থাকেননি। সত্যিকারের একজন লেখক প্রথমত নিজের আনন্দ প্রকাশের জন্যই তো লেখেন। নিজের ভালো লাগাকে দশজনের মাঝে ছড়িয়ে দেন। সবার আনন্দে নিজেও তখন আনন্দিত হয়ে ওঠেন। লেখালেখির জগতে কিছুকাল বিচরণের পরই সুজন বড়ুয়া কবিতার প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ বোধ করতে থাকেন এবং কিশোর কবিতা চর্চায় নিবিষ্ট হন। সম্প্রতি প্রকাশিত তার ‘আমার যত প্রিয় কিশোর কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায় ‘আমার যত প্রিয় কথা’ শিরোনামে সুজন বড়ুয়া নিজের কথা নিজেই বলেছেন এভাবে, ‘সেই ১৯৭৩ সালের জুন মাসে পত্রিকায় প্রথম ছড়া ছাপা হয় আমার। ছড়া লিখতে লিখতেই কখন যে কবিতার বাহুডোরে বন্দি হয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। একটা সময় লক্ষ করলাম আমার ছড়াগুলো আর বিশুদ্ধ ছড়া হচ্ছে না। কবিতাগন্ধী বা কবিতাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম আমার মানসপ্রবণতা কবিতার দিকে। কবিতাই আমাকে বেশি টানে। কবিতা পাঠে প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন।’ সুজন বড়ুয়া কবিতা লেখার যে কথা বলেছেন তা হচ্ছে কিশোর কবিতা। কিশোর কবিতা আজকে একটি স্বীকৃত সাহিত্য মাধ্যম। আগে আমরা জানতাম ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাসের কথা। কিশোরকবিতার কথাটি তেমন শোনা যেত না। পদ্যকে কেউ কেউ ছোটদের কবিতা মনে করত। সেই আশির দশকে সুজন বড়ুয়া প্রথম ১৯৮৫ সালে তার কিশোর কবিতাগ্রন্থ ‘বাড়ির সঙ্গে আড়ি’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাহিত্য মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এরপর তিনি আর থেমে থাকেননি। একের পর এক বেরিয়েছে অসাধারণ, অনবদ্য সব কিশোর কবিতার ঝলমলে বই। ‘আজ সারাদিন আমার স্বাধীনতা (১৯৯১), আলোর পাখির নাম জোনাকি (১৯৯৪), হাওয়ার সাথে হাত মেলাতে (২০০০), পতাকা আমার আয়না (২০০১), বৃষ্টিতে ভেজা রোদ্রের কাঁচ (২০০৪), বুকের ভেতর শাপলা ফোটে’ (২০০৭) ইত্যাদি। কিশোর কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ মিলিয়ে এ পর্যন্ত তার শতাধিক প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে একক কিশোর কবিতাগ্রন্থ বেরিয়েছে ২০টি। তিনি গদ্য কিশোর কবিতাও লিখেছেন। ‘আমি নাকি বড় হচ্ছি’ গ্রন্থটি সুজন বড়ুয়ার একক গদ্য কিশোর কবিতার বই। ২০০৭ সালে বেরিয়েছে তার কিশোর কবিতা সমগ্র এবং ‘শ্রেষ্ঠ কিশোর কবিতা’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। ‘আবৃত্তিযোগ্য কিশোর কবিতা প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। কিশোর কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন অসাধারণ সব কিশোর গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। বেরিয়েছে উপন্যাস সমগ্রও। তার গল্পগুলোতে আমাদের  স্বাধীনতা, স্বদেশপ্রীতি কিশোর মনের ভাবনা, আনন্দ বেদনার কথা উঠে এসেছে। ছোট ছোট বাক্যে তিনি গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যান কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। ‘বন-পাহাড়ে আমি (২০০১), বটের মূলে নদীর কূলে (২০০২), সে আমার ছোট বোন (২০০৯), সবুজ বন্ধুর ছায়া (২০১১), সূর্য ওঠার সময় (২০১২)Ñ এই বইগুলো হচ্ছে উপন্যাস। এক একটা উপন্যাস কি অসাধারণভাবে তিনি লিখেছেন। কী জাদু মেখে দিয়েছেন এসব লেখায়। ‘বন-পাহাড়ে আমি’ উপন্যসের প্রধান নায়ক পাহাড়ের এক হাতি। হাতি চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বইটি না পড়লে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। কি মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছেন পরতে পরতে। এক নিঃশ^াসে এ উপন্যাস পড়েছি আমি। কিছুতেই মাঝখানে রেখে উঠতে পারিনি। ‘বটের মূলে নদীর কূলে’ আরেকটা মন ভরানো উপন্যাস। সেখানেও  গ্রামের সহজ সরল মানুষের জীবনযাপন ও তার বন্ধুতার কথা আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও  সুজন বড়ুয়া দরদ দিয়ে লিখেছেন। কী অসামান্য আবেগ সেখানে।  ‘সূর্য ওঠার সময়’ উপন্যাসটি মুিক্তযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা। সে আমার ছোট বোন’ বইটিও কোমল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটি হৃদয়ছোঁয়া গল্প। সুজন বড়ুয়ার প্রতিটি লেখা অনন্য অসাধারণ। নতুন মাত্রার স্বাদ-গন্ধে ভরা। কবিতাগুলো একেবারে বাংলাদেশের মাটির গন্ধ মাখা। যে মাটিকে আমরা ভালোবাসি মায়ের মতো। মা মাটি দেশ নিয়েই সুজন বড়ুয়ার সব সৃষ্টি কালজয়ী। সম্প্রতি প্রকাশিত সুজন বড়ুযার ‘আমার যত প্রিয় কিশোর কবিতা’ গ্রন্থের প্রিয় কবিতাগুলো এতটাই প্রিয়, যার কয়েকটি কবিতা পাঠকের জন্য উপস্থাপনের লোভ সামলাতে পারছি না। বইয়ের প্রথম কবিতাটি ‘মাগো আমি যুদ্ধে যাবো’- কোথায় আমার ঢাল তলোয়ার, কোথায় ধনুক-তীর? মাগো আমি যুদ্ধে যাবো, সাজবো তিতুমীর। যুদ্ধে গেলে ভয় কী তোমার, ভয় কী বলো মা? আমার সকল বোন তোমাকে দিচ্ছে পাহারা, তোমার যত দুঃখগাথা, তোমার চোখের জল আমার বদল ওরাই দেবে মুছিয়ে অবিরল।   আমার দেবার কী আছে মা! যুদ্ধে দেবো প্রাণ, আর দেবো সব বোনের গলায় তোমার জয়ের গান। একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছেন। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন মাকে নিরাপদ রাখার প্রত্যয়ে। সেই ছবিই কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। কৃষ্ণচূড়া তোমার এ নাম কে দিয়েছে কে? মিশকালো না হয়ে যদি লাল হয়ে ফুটবে, আলতা রঙে এমন যদি সাজবেই বার বার, তোমার কেন কৃষ্ণচূড়া নাম হয়েছে আর? লাল পরাগে ডাল রাঙিয়ে; রাঙিয়ে নিজের মুখ, আমার মাকে কাঁদিয়ে তোমার কেমন বলো সুখ, কি সুখ বলো মায়ের মনে ঝলকে তুলে আজ? ভাই হারানো বোন হারানো আগুন- ছবির ভাঁজ। নিঝাপ পাড়া মেঘলা দুপুর, একলা আমার মা, কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে আর কষ্ট দিয়ো না। (কৃষ্ণচূড়ার কাছে, ১৬ পৃষ্ঠা) কবিতাটিতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে আমাদের ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে বীর শহীদানের বীরত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে।   সুজন বড়ুয়া যে মাধ্যমেই লেখেন না কেন সেটা যেন সোনার আলোয় আলোকিত হয়ে ফুটে উঠেছে। তার রূপ রস ঘ্রাণ পাঠক গ্রহণ করেছেন। তিনি শুধু নিজে লিখে নিজেই বড় হতে চাননি কখনো। চেয়েছেন নবীন তরুণ প্রজন্মের লেখকরাও যেন ভালো লেখেন। যে জন্য তিনিই লিখেছেন, ‘লেখক হবো কেমন করে (২০০২), এসো ছন্দ শিখি ছড়া কবিতা লিখি (২০০৭) এসব বই। বইগুলো তরুণ লেখকদের শুদ্ধতম সাহিত্য চর্চায় পথ দেখায়। সহজ সরল ভাষায়, সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন সার্থক লেখা কীভাবে লিখতে হয়। তিনি লেখালেখির ক্ষেত্রে অনেকটা শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন বইগুলো লিখে। নীরবে সাহিত্যের কত শাখায় কত সূক্ষ্ম কাজ করে যাচ্ছেন তিনি কিন্তু কখনো প্রচার চান না। সব সময় প্রচার থেকে দূরে থেকেছেন। বাংলা শিশুসাহিত্যের বরপুত্র আমীরুল ইসলামের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘শিশুসাহিত্যের আলোছায়া’ গ্রন্থে সুজন বড়ুয়া সম্পর্কে লিখেছেন, ‘একাগ্র মনে, গভীর নিষ্ঠায় সমগ্র জীবন তিনি শিশু-কিশোর সাহিত্যচর্চায় উৎসর্গ করেছেন।  এই অপরিমাণ নিষ্ঠার অসামান্য মূল্য তো আছেই। নিভৃতচারী সুজনদার সাফল্য মানেই নিষ্ঠা ও  একাগ্রতার জয়লাভ। এই বাণিজ্যনির্ভর মিডিয়ার জ্বর- আক্রান্ত সমাজে সজুন বড়ুয়াদের অগ্রযাত্রা দেশে আশাবাদী হয়ে ওঠি। সততার জয় অনিবার্য। সাধনার জয় অবশ্যই। অকারণ প্রচারের প্রতিযোগিতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি। গুটিয়ে রাখেন। প্রচারে কুণ্ঠিতবোধ করেন। এ রকম সজ্জনকর্মী মানুষ এখন আমাদের সমাজে বিরল। কর্মের আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করেন। প্রচারের আলোয় নিজেকে বিক্রি করেন না’। (শিশুসাহিত্যের আলোছায়া, আমীরুল ইসলাম। পৃষ্ঠা- ৪০২) সুজন বড়ুয়া ব্যক্তি জীবনের চালচলনে এতটাই নিয়ম নিষ্ঠ যে, আজকের দিনে তা বিরল। তিনি সব সময় বিনয়ী। তিনি যখন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত হন ২০১৫ সালে, তার কিছুদিন পর ৪ মার্চ, ২০১৬ তারিখে জন্মভূমির জেলা চট্টগ্রামের শিশুসাহিত্যিকরা তাকে বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করেন। তিনি সংবর্ধনার জবাবে বলেন, তার পুরস্কারপ্রাপ্তি মূলত বাংলাদেশের শুভবোধসম্পন্ন সব শিশুসাহিত্যিকেরই জয়। তিনি একা নন, তার সঙ্গে যারা শিশুসাহিত্য চর্চা করেন এবং একটি মূল্যবোধসম্পন্ন, সচেতন ও প্রগতিশীল প্রজন্মের স্বপ্ন দেখেন, তারা সবাই এ পুরস্কার পেয়েছেন। (তথ্য সূত্র- দৈনিক আজাদী।) সুজন বড়ুয়া লেখালেখির জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সুজন বড়ুয়া ১৯৫৯ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ছিলোনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সুধীন্দ্র বিকাশ বড়ুয়া ও মাতা শ্রীমতি খুশী রানী বড়ুয়া। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির প্রকাশনা বিভাগে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে লেখালেখি আর গবেষণা কর্মে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। এই গুণী লেখকের অসন্ন জন্মদিনে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা ও হৃদয়ের গভীরতম উষ্ণ ভালোবাসা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App