×

মুক্তচিন্তা

বিষণ্নতায় আবাহন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২১, ১২:১১ এএম

বিষণ্নতায় আবাহন
রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই শুরু করি। কারণ বৈশাখের আবাহন করতে গিয়ে যে গানটি বাঙালি জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, সেটির প্রথম কলি হলো : এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। বৈশাখকে তিনি দেখেছেন তাপস-রূপে- যে তার ‘নিশ্বাস বায়ে’ মুমূর্ষুকে উড়িয়ে দেয়। পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর করে দেয়। জীবনে হাসির সঙ্গে কান্না আছে, সুখের সঙ্গে দুঃখ আছে, আনন্দের সঙ্গে আছে বেদনা। দুটোকেই গ্রহণ করতে হবে। না চাইলেও অনভিপ্রেত হলেও বরণ করতে হবে দুঃখকে। তবে বেদনার মধ্য দিয়ে চলা, দুঃখের দহান জ¦লাÑ এ যেন অগ্নিস্নান। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ একটি গানে বলেছেন : যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক। মুছে গ্লানি, ঘুচে যাক জরা অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। শুচি হতে গেলে অগ্নিস্নান করতে হবে। এবারের পহেলা বৈশাখ এসেছে বিষণ্নতার মধ্য দিয়ে। কোভিড-১৯ বা করোনার মারণাঘাতে আমরা হারিয়েছি, হারাচ্ছি দেশ ও বিশ্বের অনেক মানুষকে। যারা প্রিয়জন, তাদের জন্য যেমন, তেমনি যারা অপরিচিত বিশ^বাসী, তাদের জন্যও চোখের কোণে জল আসে! প্রতিদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃতের তালিকা। অতি সম্প্রতি আমরা হারালাম আমাদের প্রিয়জন সংগীত জগতের দুই দিকপালকে- একজন আমার প্রিয়বন্ধু প্রখ্যাত শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, আরেকজন রবীন্দ্রসংগীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র মিতা হক। হারালাম সাংবাদিক-সাহিত্যিক হাসান শাহরিয়ারকে। অমোচনীয় এ বেদনাÑ অপ্রতিরোধ্য ও হাহাকার। এ বিষণ্নতার মধ্যে আবাহন করতে হচ্ছে পহেলা বৈশাখ, ১৪২৮কে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বহিরাঙ্গনে বরণের কোনো বিশেষ আয়োজন করার কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়নি করোনা-সংক্রমণের শঙ্কায়। ঘরোয়াভাবে পালনেও আছে প্রতিবন্ধকতা। কোথায় বসব, কতজনকে ডাকব, যাদের ডাকব, তারা আসবেন কি না! বিশ^ ঐতিহ্যে পরিণত চারুকলা অনুষদ থেকে সকলে মিলে পহেলা বৈশাখের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাও খুব সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ওতে কি আর মন ভরে! আর পহেলা বৈশাখের ব্রাহ্মমুহূর্ত থেকে রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনে বৈশাখী অনুষ্ঠান- যে অনুষ্ঠান আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছেÑ যে অনুষ্ঠানে না গেলে পহেলা বৈশাখের উদযাপনই যেন ম্লন হয়ে যায়- নিজের কাছেই নিজে বেদনার্ত থাকতে হয়। শুধু ছায়ানটই নয়, শিশু-কিশোরদের সংগঠন খেলাঘরসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন পহেলা বৈশাখে নানা আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে থাকে। এবার ঘরোয়াভাবে কতটুকু হবে, তা জানি না, তবে যতটুকু হবে, তাতে যে প্রাণ ভরবে না, তা নিশ্চিত। আজ (১২-০৪-২০২১) সকালে যখন এ খেলা লিখছি, তখন হকার দৈনিক পত্রিকা ‘ভোরের কাগজ’ দিয়ে গেল। প্রথম পৃষ্ঠায় দেখলাম, বিগত ২৪ ঘণ্টায় ৭৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এ বেদনা দুঃসহ! আরো পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্বের যে বিধি, তা মানছেন তা। সরকার যে ছুটি ঘোষণা করেছে, তা ঘরে থাকার জন্য। মেলামেশা না করার জন্য। আর আমরা একে ‘ঈদ’ বা উৎসবের ছুটির আমেজে নিয়েছি। গণপরিবহন বন্ধ থাকবে বলে আগেভাগেই বাড়ি চলে যাচ্ছি- যানবাহনে ভিড় করে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি গায়ে না লাগিয়ে। অথচ এ ছুটি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সংক্রমণ কমানো- সংক্রমিত না করা এবং সংক্রমিত না হওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা তা মানছি কই? কোনো কোনো সংগঠন সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে চাইছে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে সংক্রমণ হ্রাস করার জন্য। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার বিষয়টি যে আত্মঘাতী! এতে সরকারের কী হবে! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার ফলে যদি কেউ করোনা-সংক্রমিত হয়, আর তা যদি ছড়িয়ে যায়, তাহলে তার দায় কে নেবে! সরকারের লকডাউনের ঘোষণা তো জনগণের দিকে তাকিয়ে। কেবল কারখানা চলবে, তা-ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে অনন্যোপায় হয়ে। আমাদের মনে হয়, কারখানাও এক সপ্তাহ বন্ধ রাখলে ক্ষতির পরিমাণ কী হবে তা বিবেচনায় নিয়েও বৃহত্তর স্বার্থে কারখানা বন্ধ রাখা যায় কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। জীবনের জন্য জীবিকা, আবার জীবিকার ওপর নির্ভর করে জীবন! এর মধ্যে ভারসাম্য এনে সুচিন্তিত সিদ্ধান্তই গ্রহণীয়। আমাদের পরামর্শ, উচ্চমাত্রার সংক্রমণের এই দুঃসময়ে লকডাউন সর্বাত্মক হোক। পরে ওভারটাইম করে, প্রাণপণ খেটে, সে ক্ষতি পূরণে সচেষ্ট হবো আমরা। যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে চান, তাদের করোনা সংক্রমণের বিষয়টি ভেবে দেখতে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। ভেবে দেখতে বলি : সরকার দলীয় বা রাজনৈতিক স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। কারণ লকডাউন থাকলে সরকারেরই ক্ষতি। সরকারের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড এতে ব্যাহত হবে। এ সত্য উপলব্ধিতে রেখেও লকডাউনের যে সিদ্ধান্ত সরকার নিচ্ছে, তা জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা ভেবেই নিচ্ছে, এ কথা আমাদের সবাইকে চিন্তা ও আচরণের মধ্যে রাখা আবশ্যক বলে শুধু মনে করি না, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। জনসমাগম জনসংক্রমণের অন্যতম উপায়, এ সত্য যেন আমরা আমাদের হৃদয়ে জাগিয়ে রাখি এবং আমাদের আচরণে তার প্রতিফলন ঘটাই। পহেলা বৈশাখ লোকজীবনেও এক উৎসব ও উদযাপনের বিষয়Ñ ব্যবসায়ীদের জন্য এটি ‘হালখাতা’ করে পুরাতন হিসাব নবায়ন করে মিষ্টিমুখ করানোর দিনও বটে। পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ, একে অস্বীকার করা মানে বাঙালিত্বকেই অস্বীকার করা। বাংলাদেশের মানুষেরা ধর্মপ্রাণ, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ ধর্মান্ধ নয়। যারা পহেলা বৈশাখের এ বাঙালি সংস্কৃতিকে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন, তাদের চিন্তা একদেশদর্শী। ধর্মের সঙ্গে, ধর্মবিশ^াসের সঙ্গে পহেলা বৈশাখ উদযাপন সাংঘর্ষিত নয়। নানা রকমের উৎসব অনুষ্ঠান আমরা উদযাপন করি, যেগুলোর মধ্যে কিছু অনুষ্ঠান ধর্মীয়। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রীতি অনুসারে সেগুলো পালন করে থাকেন। যেমন- মুসলিমদের ঈদ, হিন্দুদের দুর্গাপূজা, বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা, খ্রিস্টানদেন বড়দিন, আদিবাসী বা উপজাতীয় লোকদের নানা উৎসব অনুষ্ঠান ইত্যাদি। কিছু অনুষ্ঠান জাতীয় যেগুলো বাঙালি জাতিগতভাবে পালন করে থাকেন, যেমনÑ পহেলা বৈশাখ। কিছু রাষ্ট্রীয়, যেমনÑ স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি- ভাষা শহীদ দিবস ইত্যাদি। পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় অনুষ্ঠান। জাতিগতভাবে আমরা বাঙালিরা এ উৎসব উদযাপন করে আসছি। করে যাবÑ তা যে আঙ্গিকেই হোক। বৎসরের প্রথম দিনটি ভালো কাটুকÑ এ অভিপ্রায়ে বাঙালিরা সাধ্যমতো ভালো খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও করে থাকেন। পান্তাভাত আর ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার রেওয়াজ সেই অভিপ্রায় থেকে উদ্ভূত। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ও পহেলা বৈশাখ উদযাপনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়েও ঘটে জাতীয় সংস্কৃতির প্রকাশ ও বিকাশ। গ্রাম-বাংলায় বসে বৈশাখী মেলা। হয় ঘোড়দৌড় বা গরুর সাথে দড়ি দিয়ে মই বেঁধে গরুর দৌড়- আর কত কী! যেভাবেই হোক পহেলা বৈশাখ উদযাপন আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ, আমাদের জীবনের অঙ্গ। সবশেষে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি : আজ চলে গেলে কাল কী হবে না- হবে নাহি জানে কেহ, আজিকার প্রীতিসুখ রবে কি না- রবে আজিকার স্নেহ। যতটুকু আলো আছে   কাল নিবে যায় পাছে, অন্ধকারে ঢেকে যায় গেহ- আজ এসো নববর্ষ দিনে যতটুকু আছে তাই দেহো। (‘নববর্ষে’, ‘চিত্রা’) নিরঞ্জন অধিকারী  : অধ্যাপক, সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App