×

মুক্তচিন্তা

হক সাহেবের চরিত্র না অশান্তি উত্তেজনা, কোনটা ইস্যু?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২১, ১২:০১ এএম

সোনারগাঁওয়ের একটি রিসোর্টে নারী নিয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের অবস্থান, ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্তৃক অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকা, খবর পেয়ে হেফাজতের অসংখ্য নেতাকর্মীর সেই রিসোর্টে গিয়ে মারমুখী অবস্থান এবং তাদের নেতাকে নিয়ে যাওয়াÑ একের পর এক এসব নাটকীয় ঘটনা নিয়ে সারাদেশে ছিল তোলপাড়। এ বিষয়ে একাধিক ভিডিও-অডিও নিয়ে চলছে এখন নানা রকম কথাবার্তা। ভাইরাল এসব ভিডিও-অডিওর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমেও। ৩ এপ্রিলের এ ঘটনার কথা পরদিন উঠেছে জাতীয় সংসদেও। এ কাণ্ডের জের ধরে মামুনুল হকের নেতিবাচক সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাসদ নেতা সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জাতীয় সংসদে বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের রিসোর্টে যে নারীসহ ছিলেন, তিনি তার স্ত্রী নন। ওই মহিলা কে, তা তিনি টেলিভিশনে নিজের মুখে স্বীকার করেছেন। তিনি তার স্ত্রী নন। এ বিষয়ে আরো ঘটনা জেনে সবাইকে জানাব। এসব ঘটনা এখন টক অব দ্য সিটি বলা উচিত বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশিদের হট টপিক। মামুনুল হক সিনে এসেছেন বেশিদিন হয়নি। অঘটনঘটনপটিয়সী সমাজে একজন আসে তো একজন যায়। হেফাজত আসার পর থেকে জামায়াতের খবর নেই। বিএনপি মোটামুটি ব্যর্থ রাজনৈতিক দল। হেফাজতের তাণ্ডব অন্তত একটা বিষয় প্রমাণ করে দিয়েছে সংঘবদ্ধ আর ডিটারমিনড হলে সবাই পারে। বিএনপি পারেনি। তাদের প্রধান নেতা একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ছিনিয়ে নেয়া দূরের কথা, তারা একটা বড় শোডাউন বা মিছিলও করতে পারেনি। অথচ মামুনুল হককে কি না ছিনিয়ে নিল তার সমর্থকরা? এটাও অবশ্য মীমাংসিত সত্য কি না জানা মুশকিল। একটা বিষয় পরিষ্কার, মামুনুল হক এমন একটা কাজ করেছেন যা সমাজে এখন প্রায়ই হয় আর হলেও কেউ খবর রাখে না। কিন্তু মামুনুল হক তো কাণ্ডারি। নেতা। নেতা তাও আবার তেমন নেতা, যার নেতৃত্বে স্বাধীনতার ৫০ বছরের দিনটি ছিল বিভীষিকাময়। হেফাজত নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে ঢাকা, গোপালগঞ্জ বা সাতক্ষীরায় কিছু করতে না পারলেও তাদের ঘাঁটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে চালিয়েছিল মহাতাণ্ডব। একদিকে জান নিয়ে টানাটানি আরেকদিকে পুড়েছে সংগীত নিকেতন, ভেঙে ফেলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। এসব নাশকতায় হেফাজতের ডজনাধিক সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। সে রক্তের দাগ না শুকাতেই মামুনুল কি না গেলেন রিলাক্স করতে? তাও আবার দ্বিতীয় স্ত্রী নামের একজনকে নিয়ে। সে মহিলা কে, কী তার পরিচয়Ñ এগুলো কি আসলেই মুখ্য? আমি অন্তত তা মনে করি না। তার নাম যে কোনো কিছু হতে পারে। তিনি রফিক, শফিক, কামাল যে কারো স্ত্রী হতে পারেন। ঘটনা সেখানে না, ঘটনা মামুনুল হককে নিয়ে। যে বিষয়গুলো আমরা জানতে পারব না, জানবও না সেগুলোই বরং বলি। মামুনুল হকের দ্বিতীয় স্ত্রী তো ধর্ম, সমাজ ও আইনসিদ্ধ। তাহলে তাকে নিয়ে হোটেল, মোটেল বা রিসোর্টে যেতে হবে কেন? কেনই বা প্রথম স্ত্রীকে লিখিয়ে-পড়িয়ে দিত হবে, দ্বিতীয় স্ত্রীকে সে জানত এ কথা শিখিয়ে দিতে হবে কেন? আর একটা বিষয় জানা দরকার, যখন মামুনুল হক জানেন তিনি আইনের চোখে চোখে। তার দিকে সরকারি-বেসরকারি চোখ সবসময় পাহারায়, এই কঠিন সময়ে কেন গেলেন ফুর্তি করতে। ঝরে যাওয়া জানমালের প্রতি টান থাক না থাক, নিজের ভালোটা কি তিনি বোঝেন না? যেসব যুবক তাকে ঘেরাও করল, শাস্তি দিতে চাইল, তারাও ছিল সংঘবদ্ধ। এই সংঘবদ্ধ যুবসমাজ হঠাৎ করে নিশ্চয়ই আসেনি। আর এসে হতে যাওয়াটা কি প্রমাণ করল? এটা তো সে ঘটনারই আরেক নজির যেদিন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানার ছিঁড়ে স্টেজ গুঁড়িয়ে ঢাকার রাস্তায় পাওয়ার দেখিয়েছিল হেফাজত। বলাবাহুল্য তারপর থেকে সরকার মুখে যাই বলুক কার্যত চলে গিয়েছিল আপসের লাইনে। আর সে আপসের ফল জমি বণ্টন। হেলিকপ্টারে হুজুরের ঢাকা আগমন। কওমি জননী উপাধি। মামুনুল হক এখন যে কোনো বিরোধী দলের নেতার চেয়ে শক্তিশালী। মূলত লকডাইনে যাওয়া দেশ ও সমাজে শেষ পেরেক ঠিকা ধর্মীয় বক্তা। আজ সরকার যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর আর মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান শেষ করে লকডাউনে যাচ্ছে তখন মামুনুল হক সে যাত্রাকে করলেন প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ মানুষের এক বিশাল অংশ মনে করছে তড়িঘড়ি ঘোষণা নাকি হেফাজত থামানোর কৌশল। সে যাই হোক আমরা দূর থেকে দেখছি নিয়ন্ত্রণহীন এক সমাজ। আমাদের চোখে ধরা পড়ছে ভয়াবহ সব অসঙ্গতি। মামুনুল হকের মতো একজন মানুষের হাতে আজ ধর্ম সমর্পিত। ইসলামের মহত্ত্ব বিশ্বজনীনতাকে আজ আর কেউ মনে রাখে না। কেন উপমহাদেশের দরিদ্র শোষিত মানুষ দলে দলে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তা আজ আর কেউ মনে রাখে না। তার বদলে উঠে এসেছে অন্ধ সব বক্তা আর উন্মাদনা। মামুনুল হকের মূল অপরাধ কি সত্যি পরকীয়া? না কি উসকানি জাগিয়ে স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে উত্তেজনা ছড়িয়ে শান্তি বিনষ্ট করা? সত্য কথা বলার সৎ সাহস নষ্ট হয়ে গেছে জানি। তাই বলে সব বিষয়ে? মামুনুল হককে ধরতে হলে বা তাকে অপরাধী প্রমাণ করতে হলে সঠিক পথটি কেন বেছে নেয়া যাবে না? কী কারণে ছাড়? ছাড় দিতে দিতে দেশ, সমাজ, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র সব আজ হুমকির মুখে। ৫০ বছরের সুবর্ণ দিনটিতে যা ঘটে গিয়েছে তার কাছে যাবতীয় উন্নয়ন আজ ব্যর্থ। এরপরও যদি সত্য স্বীকারে কুণ্ঠা থাকে তাহলে কি সময় ছেড়ে কথা বলবে? লেখাটার শুরুতেই শেখ হাসিনার কথার উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বলে দিয়েছেন সরকার জ্বালাও-পোড়াও এসব সহ্য করবে না। আমি মনে করি পরকীয়ার চেয়ে এটাই হয়ে ওঠা উচিত আসল ঘটনা। মামুনুল হকের চরিত্র বিশ্লেষণ জাতির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। বহু সমস্যায় ক্লান্ত পরিশ্রান্ত জাতি এখন করোনার ভয়ে আছে। লকডাউনে আটকা পড়া দেশ, জাতির এক বিশাল অংশ জানে না কীভাবে চলবে সংসার। কোথা থেকে আসবে টাকা? সামনে আসছে রোজার দিন। খুব স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে জিনিসের দাম। মানুষের নাভিশ্বাস উঠবে। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তদের অনেকেই বলছেন আত্মহনন ছাড়া পথ নেই তাদের। এমন জাতি আসলেই কারো চরিত্র নিয়ে মাথা ঘামায় না। সামাজিক মিডিয়া আর ইন্টারনেটের বেড়াজালে মানুষ জানে না কোনটা সহজিয়া কোনটা পরকীয়া। তার দরকার উদার সমাজ। তার চাই পেটে ভাত। পোশাক মাথার ওপর ছাদ। মামুনুল হকের চরিত্রের চেয়ে তার কাছে দামি ভয়হীন জীবন উত্তেজনাহীন সমাজ আর নির্ভয় একটি দেশ। মামুনুল হকরা তা না চাইলে তাদের দমানোর বিকল্প কোথায় হে সরকার?

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App