×

মুক্তচিন্তা

মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২১, ১২:০১ এএম

আজ চৈত্রের শেষ দিন, বিদায় নিচ্ছে ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। রাত পোহালেই সুপ্রভাত, নববর্ষ, ১৪২৮-এর আগমন ঘটবে। আগে রমনার বটমূলে শিল্পীরা গেয়ে উঠতেন, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো...’। এবার তা হবে না। নববর্ষের আগমনী বার্তা সুরে ছন্দে, নতুন সাজে, কোলাহলে ঢাকাসহ সারাদেশ নববর্ষকে বরণ করার আনন্দে মেতে উঠতে পারবে না। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হামলে পড়েছে আমাদের ওপর। তাই নববর্ষের সাজ এবার তেমন চোখে পড়বে না। গোটা ১৪২৭ বঙ্গাব্দই গেল আমাদের করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে। গেলবার ১৪২৭কে বরণেও তাই ছিল করোনার বাধা। ঘর থেকে তখন কেউ বের হতে পারেনি। ঘরে বসেই টিভির পর্দায় নতুন বছরকে নিয়ে প্রচারিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হলো। নতুন বছরের কাপড়চোপড়ও গতবার কেনা যায়নি। যারা পোশাকের পসরা সাজিয়ে দোকান প্রস্তুত করেছিল, তাদের প্রায় সবারই মাথায় বজ্রপাত পড়েছিল। আচমকা করোনার ঢেউ সেইসব ব্যবসায়ীকে অনেকটাই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা বের হতে সাহস পাইনি করোনার আক্রমণে ভীত হয়ে। ঘরে খুব বেশি রান্নাবান্নাও হয়নি। নতুন বছরের নতুন নতুন খাওয়ার আইটেম অনেকের পরিবারেই হয়ে আসছিল। কিন্তু ১৪২৭ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে তা খুব একটা হয়নি। বছরটাকে খুব সাদামাটাভাবেই বরণ করে নিতে হলো। চারদিকে তখন করোনার ভীতি, মানুষের চাপা আতঙ্ক, পোশাক বিক্রেতাদের হাহাকার দেখতে হয়েছিল। অনেকেই করোনার সেই ধাক্কায় নববর্ষের পোশাক বেচাকেনার জায়গা থেকে ছিটকে পড়েছিল। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নববর্ষ উপলক্ষে আরো যেসব কারুশিল্পী প্রস্তুতি নিয়েছিল, তাদেরও মাথায় বজ্রপাত ঘটেছিল। নববর্ষের আনন্দ এভাবেই মøান হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যাশা ছিল হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই করোনা বিদায় নেবে, মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে, যার যত গ্লানি জড়ো হয়েছিল তা মুছে যাবে, সর্বোপরি মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনেই ফিরে আসবে। ১৪২৭ যখন বিদায় নেবে তখন সেই নববর্ষের নিরানন্দের দৃশ্যপট একেবারেই থাকবে না। কিন্তু মানুষের সব আশা-ভরসাই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। করোনা গেল না বরং দ্বিতীয় ঢেউ আরো তাণ্ডব নিয়ে ফিরে এলো। এরই মধ্যে ১৪২৭ বঙ্গাব্দে অতিপরিচিত অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। অনেক পরিবার প্রিয়জনকে হারিয়ে বছরটি শোকে কাটাচ্ছে। অনেকের পরিবার উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে কতটা অসহায়ভাবে জীবনযাপন করছে তা আমাদের হয়তো জানা নেই। এই এক বছরে আমরা হারিয়েছি অনেক জ্ঞানী, গুণী, কৃতী এবং জাতীয়ভাবে আমাদের আলোকিত করা মানুষজনকে। করোনার কারণেই এসব গুণী মানুষ স্বল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। করোনা না ঘটলে তারা হয়তো বেঁচে থাকার আরো সময় পেতেন, আমরা তাদের পেতাম, পরিবারগুলোও আপনজনদের এত তাড়াতাড়ি হারাত না। করোনা আক্ষরিক অর্থেই মানুষকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। কত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেঁচে আসলেও স্বাভাবিক সুস্থতার জীবন এখনো ফিরে পায়নি। নানা জটিল শারীরিক, মানসিক এবং নানামাত্রিক সমস্যায় ভুগছেন। নতুন ঢেউয়ের আক্রমণ শুরু হলে মৃত্যুর মিছিল যেমন বড় হতে থাকে, সংক্রমণের হার, চিকিৎসার অভাব প্রকট হতে থাকে। নতুন ধরনের ভাইরাস মানুষকে স্বল্প সময়ের মধ্যেই কাবু করে ফেলছে, হাসপাতালে হাসপাতালে অক্সিজেনের হাহাকার, বেড সংকুলান তীব্রতর হচ্ছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আক্রান্ত রোগী অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করতে থাকেন, তা পেতে বিলম্ব হলে পরিবারের সদস্যদের হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে আইসিউ বা অক্সিজেনের খোঁজে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। এই সময় ঢাকা শহরে সবচেয়ে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে করোনায় আক্রান্ত রোগীর জন্য একটি বেড পাওয়া, বেড পেলেও অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়লে সেটি পাওয়া, সেটি পাওয়া গেলেও আইসিউর প্রয়োজন পড়লেও সেটির নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। চিকিৎসকরা পালা করে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের সহযোগীরা রাত-দিন রোগীদের সেবায় রত আছেন। তারপরও রোগী কেবলই বাড়ছে, হাসপাতালের ওপর চাপও বাড়ছে, নতুন নতুন জায়গায় চিকিৎসাসেবা দানের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও সামাল দেয়া যাচ্ছে না। কারণ এবারের করোনার ধরনটি অনেক বেশি সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পন্ন। সে কারণে ঘনবসতি পূর্ণ এই ঢাকা শহরে অসংখ্য মানুষ করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউকালে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে এক ধরনের আতঙ্ক চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কে কখন করোনায় আক্রান্ত হন তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। করোনার কারণে মানুষের অন্যান্য চিকিৎসাও দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনেকেই হাসপাতালে এখন যেতে ভয় পাচ্ছেন। আবার কারো সর্দি, কাশি, জ্বর হলেই গোটা পরিবার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসা নেয়ার জন্য এসব রোগীরও ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া বেশ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি কারো সামান্য চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে তাহলেও তাকে কোভিড ১৯-এর টেস্ট করাতে হচ্ছে। এ শুধু বিড়ম্বনাই নয়, অর্থকড়িরও বেশ চাপ পড়ে। বস্তুত গোটা বছরটিই করোনার আতঙ্কের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কেটেছে। কেবলমাত্র দুই-আড়াই মাস আগে সংক্রমণ প্রবণতা হ্রাস পাওয়ার লক্ষণ দেখে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ কমতে বসেছে, তাই অনেক মানুষই পর্যটনকেন্দ্রসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে-বেড়াতে কিংবা জমে থাকা কাজের সমাধানে ছুটে গেছেন। তখন চারদিকে করোনায় বন্দি জীবন থেকে ছাড়া পাওয়া মানুষের আনন্দ-উৎসব দেখতে ভালোই লাগছিল। অনেক উৎসব, সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে-শাদি ঘটা করে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। বিদেশ থেকে অনেকেই দেশে বেড়াতে আসছিলেন। চারদিকে উৎসবের আমেজ দেখতে ভালোই লাগছিল। যদিও বহু আগেই সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা এবং বিশেষজ্ঞরা মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মাস্কের বালাই নেই, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নমুনা নেই, হাত ধোয়ার কথা ভুলেই যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়তে থাকে। নানা ধরনের সভা-সমাবেশ, ধর্মীয় সভা, রাজনৈতিক কর্মসূচি, সামাজিক অনুষ্ঠান বেড়ে চলতেই থাকে। মানুষের মধ্যে খুব দ্রুতই যেন করোনা বিদায়ের আনন্দের একটি পরিবেশ লক্ষ করা যেতে থাকে। মনে হচ্ছিল এক ধরনের সন্তুষ্টি বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই ফিরে এসেছে। কিন্তু করোনার হয়তো তা ভালো লাগেনি। স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ করে চলার অপরাধে করোনা আমাদের শাস্তি দেয়ার সুযোগ পেল। সে কারণেই মাস দেড়েক আগেই করোনা সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকল। আমরা এই প্রবণতাকেও পাত্তা দিতে চাইলাম না। আমরা আমাদের মতোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলাম। ফলে করোনার সংক্রমণ এই চৈত্র মাসের বেজায় উত্তপ্তের দিনগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। চৈত্রের মাঝামাঝিতে এসে বোঝা গেল আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের নিচে হাবুডুবু খেতে যাচ্ছি। সরকার নানা বিধি-বিধান জারি করল সত্য, কিন্তু তা মানার কোনো প্রবণতা দেখা যায়নি। ফলে চৈত্রের এই শেষ দিনগুলোতে আমরা নিশ্চিত হয়ে গেলাম করোনার প্রকোপ থেকে আমাদের মুক্তি সহসা ঘটছে না। বছরটা আমাদের শুরুতে যতটা খারাপ ছিল, শেষ মুহূর্তের আশাবাদী হওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও বছরের শেষ দিনগুলো আমাদের কাটছে বড্ড করোনাতঙ্কে। বছরের শুরুতে যতসব মঙ্গল কামনা ছিল তা শেষ মুহূর্তে এসেও আমাদের কারণে বাস্তবে রূপ নিতে পারল না। চৈত্রসংক্রান্তিতে আমরা পুরনো বছরের গ্লানি মুছে দেয়ার আশা সেভাবে করতে পারছি না। আমাদের জাতীয় জীবনের করোনার যে দুর্দশায় আমরা নিপতিত হলাম সেটিও ঘুচে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাত পোহালে আমরা নতুন বছরের (১৪২৮) বৈশাখে বরণ করার মানসিক প্রস্তুতিই আমাদের এবার আর নেই। কোথাও নববর্ষের সেই আনন্দ, কোলাহল আর শোভাযাত্রা হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তিকে মনে রেখে প্রতীকীভাবে একটি মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষদের ভেতরেই প্রদর্শন করতে যাচ্ছে। এই আমাদের সবার হয়ে কয়েকজনের প্রতীকী পালন। তাতে কি মন ভরবে আমাদের? তারপরও ১৪২৮ বঙ্গাব্দ- তোমাকে স্বাগতম। তুমি আসছ, এসো। যদি পারো করোনাকে এ বছর বিদায় করার মতো জাতীয় জাগরণ এবং সচেতনতা তৈরির মনোভাব গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখো। বাংলাদেশের আর সব নৃ-জাতি গোষ্ঠীগুলোরও পুরনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমনের সঙ্গে আমাদেরও মিলিত কণ্ঠ হোকÑ ‘তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥’

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App