×

মুক্তচিন্তা

কে কাকে নাড়ায়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২১, ১২:০১ এএম

ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে মাদ্রাসার ছাত্রদের রাস্তায় নামিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, যাত্রীবাহী বাসে আগুন, ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধ, রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টিসহ সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। বিশেষ করে হেফাজতের ডাকা তিন দিনের কর্মসূচিকে ঘিরে এক ভয়াবহ অরাজকতা সৃষ্টি হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে আসছিলেন হেফাজত নেতারা। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব অনেকটাই পরিকল্পিত বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ব্যাপক ভাঙচুরের পর কেপিআইসহ সরকারি বেশ কিছু স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। এদের ছাড় দিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে। যে কোনো মূল্যে এদের দমন করতে হবে। নির্মূল করতে হবে মৌলবাদের উৎস। এক্ষেত্রে সরকারকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। এর আগে আমরা দেখেছি, বই লেখার ব্যাপারে হেফাজতওয়ালাদের সন্তুষ্ট রাখার বিষয়টি উদ্বেগ ও উল্লেখযোগ্য। স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে তাদের হস্তক্ষেপটা কিন্তু মোটেই আবছা নেই, বেশ স্পষ্টভাবেই নিজেদের জাহির করে ফেলেছে। পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনার যে দাবিগুলো মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল তাদের সবগুলোই মেনে নেয়া হয়েছে। হেফাজত ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়ে এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং হেফাজতিকরণের বিরুদ্ধবাদীদেরকে সতর্ক করে দিতে ছাড়েনি। আইয়ুব-মোনায়েমের অন্ধকার শাসনামলে এ ধরনের পরিবর্তন আনার কোশেস করা হয়েছিল, প্রতিবাদের মুখে কর্তাদের সে অভিপ্রায় ভেস্তে গেছে। সেকালে অত্যন্ত পরিচিত একটি কবিতার দুটি পঙ্ক্তিরÑ ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’Ñ পাকিস্তানি সংস্করণ তৈরি করা হয়েছিল এইভাবে, ‘ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি/ তামাম রোজ আমি যেন নেক হয়ে চলি’। দুর্ধর্ষ কাজটা করেছিলেন বিখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফা। টেকেনি। গোলাম মোস্তফা নজরুল কাব্যের ‘অপ্রয়োজনীয়’ অংশ বাদ দেবার আঞ্জামও করেছিলেন। লোকে হাস্য-পরিহাস করেছে। রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসংগীতের নির্বাসন ঘটানোর সরকারি উদ্যোগও পাল্টা প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করেছে, রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের একটি গানই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। মোনেম খাঁ জসীমউদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতার নাম বদলে নতুন নাম দিয়েছিলেন ‘দাওয়াত’। ডিমকে ‘আন্ডা’ বলার দরুন উৎফুল্ল হয়ে একজন অধ্যাপককে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালকের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছিলেন, এমন জনশ্রুতি আছে। পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি নামে ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা-সংবলিত একটি বই পাঠ্য করা হয়েছিল ক্লাস নাইনে; ছাত্রদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে সেটিকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এখন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের শাসনামলে ওইসব ভূতপ্রেত আবার ফেরত এসেছে। অবিশ্বাস্য সব ঘটনা অবিশ্বাস্য প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়েছে। তথ্যাভিজ্ঞ মহল একটি ঘটনার কথা জানাচ্ছেন। ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এক লিখিত প্রস্তাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে মোট ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজনের কথা বলেছিল। এর মধ্যে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ২টি পাঠ্যবই ছাপা হওয়ার পর নজরে এলো হেফাজতের নির্দেশনা বা দাবি অনুযায়ী দুটি লেখা বাদ পড়েনি। [...] দুই শ্রেণিতে মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকার বই ছাপা হয়ে গেছে। এগুলো গুদামে রেখে ও লেখা দুটো বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপা হলো।’ (সাপ্তাহিক একতা, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭) গুদামে রাখা বইগুলো নাকি রাতের আঁধারে ঢাকার অদূরে নিয়ে বিশাল গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। (এ এন রাশেদা, বাংলাদেশের শিক্ষাধারার বিপজ্জনক গতিপ্রকৃতি, নতুন দিগন্ত, এপ্রিল-জুন ২০১৭) একাত্তরের গণকবরগুলোর কথা মনে পড়ে কি? এই যে ভূতপ্রেতগুলো ফিরে ফিরে আসে, উত্ত্যক্ত করে, এরা কারা? কী এদের পরিচয়? বলা যাবে এরা পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। সেটা বলা হচ্ছেও। বলাটা সহজও বটে। কিন্তু পাকিস্তান নিজেই তো এখন বিলুপ্তির পথে। তার প্রেতাত্মা কি এতই শক্তিশালী যে, দুষ্কর্ম করতে আমাদের দেশ পর্যন্ত চলে আসবে? আসল ব্যাপার অন্য। সেটি হচ্ছে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য। রামপ্রসাদী গান আছে না, যেমনি নাচাও তেমনি নাচি; তোমার কাজ তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি? ব্যাপারটা অবিকল সেই রকমের। তবে পুঁজিবাদ মাতা নয়, পুঁজিবাদ হচ্ছে পিতা। কিন্তু মূল ঘটনা হচ্ছে এই যে, বিশ্ব এখন পুঁজিবাদের হাতের পুতুল; মহা-ক্ষমতাধররাও তার হাতে-ধরা ও হাত-ধরা পুতুলই। তারা অবশ্য জানে না যে, তারা ক্রীড়নকই, ভাবে তারা স্বাধীন, মনে করে তারাই কর্তা। বাংলাদেশ আমরা দাবি করে থাকি যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে আমাদের নবযাত্রার সূত্রপাত। দাবিটা সত্য এবং ওই যাত্রাটা ছিল পুঁজিবাদবিরোধী। পুঁজিবাদী ইংরেজ শাসকরা আমাদের ঘাড়ে তাদের ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল; আমরা নতুন রাষ্ট্রভাষা চাইছিলাম। পুঁজিবাদী পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবিরা চাইছিল উর্দু চাপাবে, আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। উর্দু চাপানোর চেষ্টার পেছনে যুক্তিটা ছিল সামন্তবাদী; বলা হচ্ছিল বাংলার তুলনায় উর্দু বেশি পরিমাণে ইসলামসম্মত। কিন্তু ভাষা-চাপানোর পেছনকার ইচ্ছাটা ছিল পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব কায়েম রাখবার। পাকিস্তান রাষ্ট্রের চৌহদ্দি ভেঙে আমরা সবেগে বেরিয়ে এসেছি; কিন্তু পুঁজিবাদ আমাদেরকে ছাড়েনি। সে আরো শক্তিশালী হয়ে দৌরাত্ম্য করছে, আমাদেরকে ইচ্ছামতো নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। পুঁজিবাদী শাসন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে তিন ধারায় বিভক্ত করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার কাছে আনার কথা মুখে বলছে, কিন্তু হেফাজতিদের চাপের মুখে মূল ধারাকেই বরং মাদ্রাসার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নির্দয়ভাবে। এতে শাসক শ্রেণির কোনো ক্ষতি নেই, কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা এখন আর মূলধারাতে নেই, তারা ইংরেজি ধারাতে চলে গেছে, কিংবা যাওয়ার চেষ্টায় আছে। বঞ্চিত মানুষেরাই মাদ্রাসায় পড়ে; তাদের তুলনায় কম বঞ্চিতরা রয়েছে মূল ধারাতে। মূল ধারা এবং মাদ্রাসার কাছাকাছি চলে এলে বঞ্চিতের সংখ্যা বাড়বে; সুবিধাভোগীদের তাতে অসুবিধা নেই, সুবিধাই আছে, তারা ফুলতে ও ফাঁপতে থাকবে, এখন যেমনটা ফুলছে ও ফাঁপছে। আওয়াজ উঠেছিল হাইকোর্ট এলাকা থেকে একটি স্থাপত্য সরিয়ে ফেলতে হবে। দাবিটা তুলেছে হেফাজতে ইসলাম এবং আওয়ামী ওলামা লীগ, এক সঙ্গে। এই সংযোগটা মোটেই তাৎপর্যহীন নয়। আওয়ামী লীগ বলেনি যে ওলামা লীগ তাদের অঙ্গ সংগঠন নয়। বলবে বলে ভরসাও নেই, কেননা নির্বাচনের একটা আঞ্জাম আছে। সংবিধান বলছে একটা নির্বাচন দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আওয়ামী লীগ মুখে সর্বক্ষণ বলে, কিন্তু সেটা ঠিক কী জিনিস তা বলতে পারে না। কারণ সংবিধানের মূলনীতিতে এখন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ পর্যন্ত চলে এসেছে এবং ওই বোঝা থেকে সংবিধানকে মুক্ত করবার কোনো ইচ্ছা আওয়ামী লীগ সরকারের নেই। আশঙ্কা করার কারণ আছে যে, হেফাজত ও আওয়ামী ওলামা লীগ মিলেমিশে তাদের কণ্ঠকে আরো বুলন্দ করবে এবং পাঠ্যপুস্তকগুলো আরো বেশি সাম্প্রদায়িক হবে, ভাস্কর্য অপসারণ আন্দোলনেরও বিস্তার ঘটতে থাকবে। এসব ঘটনাই ঘটবে যদি প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায়। কিন্তু প্রতিরোধ তো নেই। পাকিস্তান আমলে ছিল, এখন নেই। কারণ কী? মূল কারণটা কিন্তু মোটেই অস্পষ্ট নয়। সেটা হলো এই যে পাকিস্তান আমলে যারা রাষ্ট্রীয় দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করত তাদেরই একাংশ এখন রাষ্ট্রের শাসক হয়ে বসে গেছে আর যারা ওই সুযোগটা এখনো পায়নি তারাও আশায় আছে, কেউ কেউ উচ্ছিষ্টের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। সহজ ও দৃষ্টিগ্রাহ্য একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। ১৯৭০ সালে পূর্বোল্লিখিত পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি বইয়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল তাতে একটা বড় ভূমিকা ছিল মস্কোপন্থি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের এবং ছাত্র-সংগঠনটির তখনকার সভাপতি ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। আন্দোলনের একেবারে সামনের সারিতেই তাকে দেখা যেত। যখন তিনি শিক্ষামন্ত্রী এবং তার মন্ত্রণালয়ই পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতিকরণের জন্য দায়ী। তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। যেন অসহায়। তাই প্রশ্ন জাগেÑ কে কাকে নাড়ায়। লেজ কুকুরকে? না কুকুর লেজকে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App