×

মুক্তচিন্তা

লকডাউনের সঙ্গে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২১, ১২:১০ এএম

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। আগের চেয়ে যার ভয়াবহতা মারাত্মক ও বেশি শক্তিশালী। এমনটাই বলা হচ্ছে। বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। সংক্রমণের মাত্রা তরতর করে বৃদ্ধি পাওয়া এবং মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এমন বলা ও বুঝা যেন সত্য হয়ে উঠছে সম্ভবত। শুধু বাংলাদেশে নয় বিশে^র অনেক দেশেই সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এই বেড়ে যাওয়া এমন এক সময়ে যখন করোনারোধে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিতে শুরু করেছে মানুষ। দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের পর বেঁচে যাওয়ার এক ধরনের স্বপ্নের বিভোরতা এসেছে তাদের। কেন এই বেড়ে যাওয়া? সঠিক উত্তর দেয়া কঠিন। করোনা ভাইরাস এখনো গবেষণাধীন। ক্ষণে ক্ষণে রূপ, বৈশিষ্ট্য বদলে চলা এই ভাইরাস মানুষের মেধা, জ্ঞানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে বারবার। তাই বলে মানুষ তার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকছে না। মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিশে^র বড় বড় ওষুধ কোম্পানি, গবেষক ও চিকিৎসকরা। তবে যে ক্ষেত্রে মানব জাতির সতর্কতা নেই তা হলো, করোনার সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। তাই আপাত দৃষ্টিতে বলা যায় যে, করোনা ভাইরাসকে মানুষের একটা সময়ে এসে বেশি গুরুত্ব না দেয়া এবং এই গুরুত্ব না দেয়ার ফলেই তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেনি। আর এ কারণেই সংক্রমণ বেড়ে গেছে বলে অনেকে মনে করছেন। সংক্রমণের ১৩তম মাসে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪৬টি জেলাই সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে।গত বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশের মানুষের ভেতর করোনা ভীতি ও আতঙ্ক যে পরিমাণ ছিল তা যেন এই বছরের মার্চে অনুপস্থিত। কারণ কী? বাংলাদেশ কি করোনামুক্ত তবে? মোটেও তা নয়, ছিল না। হতে পারে করোনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা বদলেছে। আর এই ধারণা বদলে যাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এক ধরনের উদাসীনতা কাজ করেছে বলে অনেকেই মনে করেন। সাধারণত প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন, যখন সাইক্লোন আসে তখন কিন্তু সাইক্লোন দুর্বল না হওয়া পর্যন্ত, তার গতিপথ পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত বিপদ সংকেত দেয়া থাকে এবং তা অবিরতভাবে প্রচার করা হয়। সেইসঙ্গে জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া হয়। কিন্তু করোনার মতো প্রলয়ঙ্করী এক অতিমারি সাইক্লোনে তেমন বিপদ সংকেত জনগণের সামনে অব্যাহতভাবে দেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। হালকা-পাতলাভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রচার-প্রচারণা যেন জনগণের ভয়কে হালকা-পাতলা করে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ক্রমশ শান্ত হয়ে আসা আর উদ্বিগ্নহীন এই আচরণ হয়তো সাধারণ জনগণকে বুঝতে সহায়তা করেছে যে, এখন আর করোনার ভয় নেই। করোনাকে জয় করা সম্ভব হয়েছে। ভ্যাকসিন নিতে জনগণকে যতটা উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে সেই অনুপাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টিতে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়নি বলে কেউ কেউ মনে করছেন। প্রতিটি সেক্টরের স্বাভাবিক কাজকর্ম জনমনকে করোনার ভীতি থেকে কিছুটা হলেও দূরে রেখেছে। প্রায় করোনামুক্তি ঘটে গেছে বাংলাদেশে আকারে-ইঙ্গিতে এমন আচরণ প্রদর্শনও করোনাভীতি কমে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে। গেল বছরের লকডাউন ছিল কড়া শাসনে। এবারের লকডাউন কঠোর বিধি দিয়ে দেয়া হলেও কড়া হয়নি। ভ্রাম্যমাণ আদালতে মাস্ক না পরার দোষে পথচারী, যাত্রীদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হলেও অতিরিক্ত যাত্রীবাহী কোনো গণপরিবহন মালিকের কাছ থেকে জরিমানা আদায় কিংবা এই অপরাধে তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে বলে জানা সম্ভব হয়নি। বরং ৫ এপ্রিল থেকে বেঁধে দেয়া ৭ দিনের লকডাউনের তৃতীয় দিনে শহরে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। লকডাউন ঘোষণার প্রারম্ভে বলা হয়েছিল যে, শিল্প-কলকারখানায় সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ চলবে। কিন্তু তখন বলা হয়নি যে, যেসব প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে সেসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তার সব স্টাফের স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদে প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসবেন এবং পৌঁছে দেবেন। প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এবং শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান ঠিক রাখবার জন্য লকডাউনের মধ্যে গণপরিবহন চলাচলে অনুমতি দেয়া হয়েছে, নাকি গণপরিবহন মালিকদের ব্যবসা সচল রাখতে এই অনুমতি দেয়া হয়েছে জনমনে কিন্তু এই নিয়ে প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। যেখানে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এই বছরের এই সময়ে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে সেখানে এমন শিথিল সিদ্ধান্ত কেন? খুব স্বাভাবিক যে অধিকাংশ মানুষকে কাজ করে বেঁচে থাকতে হয়। অধিকাংশ মানুষই শ্রমজীবী। কাজ না করলে তাদের পরিবারে রান্নার চুলা জ¦লে ওঠে না। করোনার লম্বা সময়ে অবস্থানের দারুণ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে এমন অনেক পরিবারে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। তারা বাঁচবে কী করে, তাদের বেঁচে থাকবার অবলম্বন কী হবে, সহায়-সম্বলহীন মানুষগুলোকে কী করে বাঁচিয়ে রাখা যায় এমন একটি ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ কোন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে আদতে, বলা মুশকিল। সহজ কিস্তিতে লোন দেয়া, অনুদান ও প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা হয়েছে। ত্রাণ বিতরণ নিয়ে কেচ্ছাকাহিনীর পরও ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা সেই সংবাদ দৃশ্যমান হয়নি। সম্ভবত সেই কারণে বেঁচে থাকার প্রশ্নে পরনির্ভরশীলতার বেষ্টনী থেকে নিজেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষ নিজের দুটি পা আর দুটি হাতকে ব্যবহার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন যে, বেঁচে থাকার অতীত অভিজ্ঞতার কারণে শ্রমজীবী মানুষের করোনা ভীতি দিন দিন কমে গেছে, কমে যাচ্ছে। টিভিতে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে বলতে দেখলাম যে, করোনায় পরিবার নিয়ে না খেয়ে মারা যাবার চেয়ে করোনায় না হয় মরে যাই! এই ব্যক্তি কিন্তু স্বার্থপরের মতো নিজের কথা বলেননি, বরং তিনি পরিবারের সব সদস্যের কথা ভেবেই বলেছেন। এ ঘটনা লেখায় উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এই নয় যে, করোনার এই মহাসংকটে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক নিয়মে চলা শুরু হোক সেটাকে বুঝাচ্ছি কিংবা দাবি করছি। বলতে চাইছি যে, জনগণ কীভাবে নিজের অস্তিত্ব স্বস্তিকর উপায়ে সুরক্ষিত করবে সেই সুষ্ঠু পরিকল্পনা কোথায়? ঘরে মানুষ বসে থাকলে তার আহার কোথা থেকে আসবে? জনগণ কিন্তু ত্রাণ চায় না, বেঁচে থাকার জন্য কাজের একটা নিরাপদ পরিবেশ চায়। বেঁচে থাকার ইস্যুই কিন্তু তাকে বেপরোয়া করে তোলে। ১৩ মাসে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন এবং নতুনভাবে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সুষ্ঠু কোনো চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ করতে পেরেছিলেন কিনা, প্রশ্ন থেকে যায়। আর ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন’ কথাটা যেন দিন দিন লিফলেট, ব্যানার, ন্যাশনাল ডায়লগ, বিজ্ঞাপনসর্বস্ব হয়ে উঠেছিল। মাঠ পর্যায়ে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ ছিল কিনা সেই প্রশ্নও থেকে যায়। এ বছরের লকডাউন পরিকল্পনায় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান খোলা এবং যেসব প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে তাতে স্টাফ উপস্থিতির হার বেঁধে দেয়া হলো। অপরদিকে গণপরিবহন বন্ধ রেখে বইমেলা ও বেশ ক’টি আয়োজন চালু রাখা হলো। ঘরে থাকতে বলা এবং প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে বারণ করার বিষয়গুলো যেন উল্লিখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে গেল। পরিশেষে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। লকডাউনের আগের দিন। ব্যাংকে গেছি। গ্রাহক আর বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রচণ্ড ভিড়। ব্যাংক থেকে বের হওয়া কিংবা ঢোকার কোনো সুযোগ যেন নেই। মানুষগুলো এভাবে দলা পাকিয়ে আছে যে, দলা থেকে মুক্ত হলেই আর ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া যাবে না ভাব এমন। ব্যাংক ব্যবস্থাপক নিজে বেশ ক’বার সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাঁড়াতে ও ধৈর্য ধরতে বললেন। কে শোনে কার কথা। ব্যাংক থেকে বের হওয়ার সময় বিরক্ত প্রকাশ করে বললাম, আমরা নিজেরা যদি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান না করি, স্বাস্থ্যবিধি না মানি তাহলে তো বিপদ শুধু নিজের নয়, সবারই! পেছন থেকে পোশাকে পরিপাটি একজন পুরুষ জবাব দিলেন, এই কথা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে বলেন। পুরুষটির কথায় হোঁচট খেলাম। ব্যাংকের ভেতর কর্মরত ১৫-২০ জন স্টাফ লেনদেন ও আনুষঙ্গিক কাজে ব্যস্ত, এতগুলো গ্রাহকের সেবা দিতে ক্লান্ত, সেখানে গ্রাহকদের স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়ে তারা কী ভূমিকা রাখতে পারেন অনুরোধ প্রকাশ করা ছাড়া! আমরা আদতে কী চাই, কী করি দিন দিন যেন সেটা বুঝার শক্তি হারিয়ে ফেলছি। আর দোষারোপের সংস্কৃতিই বড় সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। করোনা কতদিন পৃথিবীতে আছে কেউ কিন্তু বলতে পারবে না। করোনাকে সঙ্গে করেই তাই জীবনযাত্রার নিরাপদ পরিকল্পনা চাই জাতীয় পর্যায় থেকে। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে সেন্ট্রালি অক্সিজেন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক। স্বাস্থ্যসেবার খাত আরো উন্নত করা হোক। গভীর ও নিবিড় মনিটরিং চালু করা হোক। স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App