×

মুক্তচিন্তা

মহামারি ও ষড়যন্ত্র নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২১, ১২:১১ এএম

করোনা আতঙ্ক আমাদের জীবনে নতুন রূপের শক্তিশালী এক বিপর্যস্ততা নিয়ে ফিরে এসেছে। নতুন এই বিপর্যস্ততাকে ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ’ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন। সবার আশঙ্কা ছিল শীতে দ্বিতীয় ঢেউটি আঘাত হানবে। কিন্তু শীতটা তুলনামূলক উপভোগ্য হলেও গরমের শুরু থেকেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণের থাবা আমাদের জীবনে ঘটতে থাকা স্বাভাবিকতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার একদিকে জনজীবনকে যেমন বিপর্যস্ত করে তুলেছে অপরদিকে বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠীর খামখেয়ালিপূর্ণ আচার-আচরণ আমাদের তেমনি শঙ্কিতও করে তুলেছে। এর মধ্যে ব্যবসায়ীদের আচার-আচরণ এবং জেদি মনোভাব আমাদের বিস্মিত করেছে! তারা সামাজিক দূরত্বকে অবজ্ঞা ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি প্রজ্ঞাপনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে রীতিমতো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনেরও ঘোষণা দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও রাজপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও পালন করেছেন। তারা তাদের ‘জীবন’ ও ‘জীবিকা’ বাঁচানোর জন্য এসব কর্মসূচি পালন করছেন বলে জানিয়েছেন। এটি আমাদের সমাজের একটি দিকের দৃশ্যÑ ছোট হোক বড় হোক এটি আমাদের সমাজের মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের তথাকথিত ‘জীবন সংগ্রামে’র দৃশ্য। কিন্তু আমরা যদি শুধু রাজধানী শহরের বিভিন্ন হাসাতালের দিকে একবার চোখ বোলাই তবে সেখানে সাধারণ মানুষের ‘জীবন সংগ্রামে’র ভিন্নতর করুণ ও মর্মান্তিক দৃশ্য ছাড়া ভালো কিছুই দেখতে পাব না। শুধু রাজধানী নয়Ñ আজ পর্যন্ত দেশের ৪৭টি জেলা শহরে নতুন করে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। সেসব জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোতেও একই রকমের চিত্র। চিকিৎসার জন্য সাধারণ মানুষের ছোটাছুটির করুণ ও মর্মান্তিক এরূপ দৃশ্য দেখে অনেকের পক্ষে স্বাভাবিক ও সুস্থ থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। হাসপাতালগুলোর দিকে একবার তাকালে সামান্য চেতনাসম্পন্ন মানুষের পক্ষেও সড়ক অবরোধসহ আন্দোলন তো পরের কথা মানসিকভাবে সুস্থ থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিভিন্ন স্থানে রোগীদের সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে অবশ্যই মনে হবে ‘জীবিকার’ কথা বলে প্রকৃতপক্ষে ‘জীবন’ নিয়ে আমরা কী বিচিত্র ধরনের ছিনিমিনি খেলায়ই না মত্ত হয়ে পড়েছি! বিগত বছরে পহেলা বৈশাখ, ঈদ ও দুর্গাপূজায় আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় করতে পারেননি বলে এবারের আসন্ন পহেলা বৈশাখ ও ঈদের মৌসুমেও ব্যবসায় করতে পারবেন নাÑ তা যেন তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে চাইছেন না। হাসপাতালে করোনা রোগীর স্থান সংকট, অক্সিজেন সংকট, আইসিইউর সংকট! চাপ কমানোর জন্য ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানী শহরে করোনা রোগী না পাঠিয়ে বরং স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জেলা হাসপাতালগুলোতে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। রাজধানীতেই অসুস্থ রোগী নিয়ে স্বজনরা এক হাসপাতাল থেকে হন্যে হয়ে যখন আরেক হাসপাতালে ছুটছেন তখন ব্যবসায়ীদের সড়ক ও রাজপথ অবরোধের দৃশ্য কতটা যে মর্মান্তিক তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেন না। এসব দেখে প্রকৃতপক্ষেই আমরা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই যে, ‘জীবন’ ও ‘জীবিকা’র মধ্যে আসলে কোনটি সর্বাগ্রে বিবেচ্য? একই দেশের ভেতর পরস্পরবিরোধী এরূপ দুটি দৃশ্য আমাদের সত্যিই বিভ্রান্ত ও বিচলিত করে! সুস্থভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি! বিগত বছরের চেয়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এবার দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যাও গত বছরের যে কোনো দিনের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এপ্রিল মাসের প্রথম ৯ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি! এই ৯ দিনে সংক্রমণের সংখ্যাও অর্ধ লক্ষাধিক! দৈনিক মৃত্যু পঞ্চাশের নিচে নেই, এ পর্যন্ত তা ৭৪ স্পর্শ করেছে। কোভিড শনাক্তের দৈনিক সংখ্যা ৭ হাজারের ঘর পেরিয়ে গেছে। আক্রান্ত, শনাক্তের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেইন ৮১ শতাংশের বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকার এই স্ট্রেইন সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রথম ঢেউয়ের করোনা ভাইরাসের চেয়ে এর সংক্রমণ-সক্রিয়তা ৭০ গুণ বেশি! এই যখন পরিস্থিতি তখন আমাদের ব্যবসায়ী সমাজের অবিমৃশ্যকারিতা শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি বয়ে আনবে তা নিয়ে কিছুসংখ্যক মানুষের শঙ্কা থাকলেও ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে লকডাউনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেই দেখা যায়! অবস্থান নিতে দেখা যায় জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধেও! তাই শপিংমলসহ ও বড় বড় দোকানপাট বন্ধ রাখার প্রজ্ঞাপন জারি করার পরও সরকারকে সেসব পুনরায় খুলে দেয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বলা হয়েছে ৯-১৩ এপ্রিল পর্যন্ত শপিংমল ও দোকানপাট ‘কঠোর স্বাস্থ্যবিধি’ মেনে খোলা থাকবে! কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় আমরা বিগত এক বছরের অধিক সময় ধরে পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, কলকারখানায়, সমুদ্রসৈকত কিংবা হোটেল-রিসোর্টে যে ‘দৃশ্য’ দেখছি তা মোটেও আশাপ্রদ বলে কেউ দাবি করতে পারবেন না। উপরন্তু শীতের মৌসুমে করোনার প্রকোপ সামান্য কমে গেলে আমরা যে রকম অস্থির হয়ে প্রমোদ ভ্রমণ ও আনন্দ বিহারে জনসমাগমে যাওয়া শুরু করেছিলাম তাতেই যে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করে বলেছেন। আমরা উপলব্ধি করতে পারছি, স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসহায়ক কর্মীদের মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতিতে হিমশিম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। করোনা শনাক্ত এবং মৃত্যুর হার যদি আর একটি সপ্তাহও ঊর্ধ্বমুখী থাকে তবে সব শ্রেণির স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হবে সন্দেহ নেই। রোগীদের জন্য সাধারণ চিকিৎসা দিতে না পারাও যে স্বাস্থ্যকর্মীদের হতাশ করে তা আমাদের বুঝতে হবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতে সরকার ঘোষিত ১৪ এপ্রিল থেকে ‘৭ দিনের কঠোর লকডাউন’ যেন নিরঙ্কুশ লকডাউনই হয় অনেকে তাই আশা করছেন। ‘জীবন’ বলি কিংবা ‘জীবিকা’ই বলি চারপাশের সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে আসলে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, দেশে করোনা বলে কোনো মহামারি আছে! প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০ জন মানুষের মৃত্যুও আমাদের কিছুই বোঝাতে পারছে না! আশ্চর্য সব অজুহাতে মানুষ অনবরত স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে চলেছে। সাধারণ একটি মাস্ক পরাকে কেন্দ্র করে দেশের প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের সাড়ে ১৭ কোটি রকমের অজুহাত! লকডাউন ভঙ্গ করে আমরা জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে না হয় বাইরে এলাম কিন্তু একটি মাস্ক ব্যবহার করব তার জন্য কত রকমের ফাঁকিবাজি, তার ইয়ত্তা নেই! যেখানে মাস্ককেই করোনা প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এখন পর্যন্ত স্বীকার করা হয়েছে তবু মাস্কের প্রতি মানুষের সীমাহীন উদাসীনতায় আমরা বিস্মিত হই। সরকারকেও খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে কিংবা প্রজ্ঞাপন জারি করতে দেখা যায় না। তাই একদিন লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে পরের দিন তা আবার সংশোধন করতে দেখা যায়। এতে লকডাউন সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে আরো ‘ঢিলেঢালা’ মনোভাব সক্রিয় হয়ে ওঠে! সরকারকে আরেকটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। করোনার সমান্তরালেই সক্রিয় হচ্ছে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র একটি গোষ্ঠী সরকারবিরোধী স্পষ্ট অবস্থান নেয়। সরকারবিরোধী এই অবস্থানের পশ্চাতে বাম-ডান ও বিএনপির মদদ থাকলেও ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সক্রিয়তাই বেশি দৃশ্যমান। হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীর নৈরাজ্য সৃষ্টি ও তাণ্ডব আমরা দেখেছি, বিশ্ববাসী দেখেছে। এরপর মামুনুলের রিসোর্টকাণ্ডকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদিতার নমুনাও আমরা দেখেছি। ধর্মান্ধতা ও সরকারবিরোধী অবস্থানের কারণে এদের মধ্য থেকে যৌক্তিক ও মানবিক আচরণের সার্বিক বিলুপ্তি ঘটেছে! সবশেষ ফরিদপুরের সালথায় লকডাউন মানা ও না-মানাকে কেন্দ্র করে যে তাণ্ডব আমরা দেখলাম তা হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সোনারগাঁওয়ে সংঘটিত নৈরাজ্য ও তাণ্ডবেরই যেন ‘ফটোকপি’ মাত্র! অর্থাৎ ভাঙচুর, নৈরাজ্য সৃষ্টি ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় সর্বত্রই কারা সম্পৃক্ত তা বিভিন্ন স্থানে একইরূপ ঘটনার পুনরাবর্তনের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেছে। প্রগতিশীলতার চিহ্নবাহী বিভিন্ন সংস্থা ও স্থাপনাগুলো ছিল ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত সংগীত শিক্ষালয়, প্রেস ক্লাব, গণগ্রন্থাগার, ভূমি অফিস, থানা, রেলওয়ে স্টেশন, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তাঁরই ভাস্কর্য ভাঙচুরে ধর্মান্ধদের উল্লাস ক্ষমতা দখলের ইঙ্গিতই বহন করে। করোনাকালেও ক্ষমতালোভী এই গোষ্ঠীটি সরকারি প্রজ্ঞাপনের তোয়াক্কা না করে নানাভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতেই মনোযোগী হয়েছেন। যে কোনো অজুহাতে এই গোষ্ঠীটি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে তৎপর রয়েছে এবং একটা না একটা অঘটন ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায়ও সক্রিয় আছে। দেশে স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু পরিবেশ সুরক্ষায় তাই সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রণয়নে এখনো একটি মহল তৎপর তা হেফাজতের ডাকা হরতালের আগের দিন বিএনপির জনৈক নেত্রীর ফোনালাপেও স্পষ্ট হয়েছে। সরকারবিরোধী যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে চলমান এই করোনা যুদ্ধের সময়েও ভিন্ন কৌশলে সতর্ক ও সক্রিয় ভূমিকায় থাকতে হবে। করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে যেমন সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে তেমনি মহামারির মধ্যেও সরকারবিরোধী সব ষড়যন্ত্র নস্যাতের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, উন্নয়নের প্রবহমানতাকে কেউ যেন কোনোভাবেই রুদ্ধ করতে না পারে। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App