×

মুক্তচিন্তা

সর্পের মস্তকে মণি থাকলেও সে কি ভয়ঙ্কর নয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২১, ১২:১২ এএম

গত বিএনপি-জামায়াত সরকারের শাসনামলে বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য সাকা চৌধুরীর একটি উক্তি বেশ আলোচিত হয়েছিল। কুকুরে লেজ নাড়ায়, না লেজ কুকুরকে নাড়ায়। স্বীয় দলের নেতৃত্বের প্রসঙ্গে উক্তিটি করেছিলেন সাকা চৌধুরী। দেশের বর্তমান মহাজোট সরকার কয়েকটি যুগান্তকারী আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশবাসীকে চরম ক্ষুব্ধ ও হতাশার মধ্যে ফেলেছে। এক. হেফাজতে ইসলাম নামক ওয়াহাবী মতবাদের একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ছেড়ে তারা আমাদের শিক্ষাক্রমের মূলধারায় নাক গলিয়ে তাদের দাবি শতভাগ পূরণ করে নিয়েছে। দুই. হেফাজতের আমির তেঁতুল হুজুর খ্যাত শফী আহমেদ নারী নেতৃত্ব ঘৃণাভরে অস্বীকার করে নানা বক্তব্য-বিবৃতি, প্রচার-প্রচারণার পরও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার কোনোরূপ সংস্কার ব্যতিরেকে তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়কে মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। তিন. দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তুলেছে। বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের প্রবেশ মুখে ‘থেমেসিস’ ভাস্কর্যটি সরানোর দাবির প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী সহমতও প্রকাশ করেছেন। চার. পহেলা বৈশাখকে হিন্দুয়ানি উৎসব দাবি করে তা বর্জনের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ওইদিন বিকাল ৫টায় দেশের সব উৎসবস্থল পুলিশ লেলিয়ে বন্ধ করে দেয়। সরকারের এই নতজানু নীতিতে দেশবাসী হতবাক-বিমূঢ়। এসব নতজানুতে হেফাজত আজ সারাদেশ তান্ডব চালানোর সাহস পায়। দেশের মানুষের প্রচলিত ধারণাটি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ দলটি ধর্মনিরপেক্ষ না হলেও অসাম্প্রদায়িক। সেটা ভাবা অসঙ্গতও নয়। কেননা এই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই তিন নীতির ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের মূলনীতি নির্ধারিত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। বাহাত্তরে সংবিধান প্রণয়নের সময় জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত করে শাসনতন্ত্রের চার প্রধান নীতি গ্রহণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ২৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাÑ এই তিন নীতির ওপর ভিত্তি করেই দেশকে গড়ে তোলা হবে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘এই মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তারা সংগ্রাম করেছিলেন আইনের শাসন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার পাশাপাশি শোষণ ও বৈষম্য চিরতরে অবসানের জন্য এবং একমাত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ দেশের সব মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব।’ ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকালে দিল্লির সংবর্ধনা সভায় এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে দেয়া ভাষণে অভিন্ন বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। তিনিও সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সরকারপ্রধান রূপে তিনি পূর্বের অবস্থানে অবিচল থাকতে পারেননি। সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর প্রথম আঘাতটি আসে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় ওআইসি সম্মেলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে। ওআইসি একটি ধর্মভিত্তিক জোট। যার সব সদস্য মুসলিম রাষ্ট্র। যারা ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে না। ওআইসিভুক্ত সর্বাধিক রাষ্ট্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি। বিপরীতে চরম বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে ওই সম্মেলনে হাজির করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার অন্তর্গত ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর প্রথম আঘাতটি এসেছিল। পরবর্তীতে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। অপর সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ আরো এক কদম এগিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তন করেন। বর্তমান সরকার এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করে রাষ্ট্রের ওপর বিশেষ ধর্মের স্থায়ী মোড়ক এঁটে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্থায়ীভাবে নির্মূল করে দিয়েছে। আমাদের স্মরণে নিশ্চয় আছে, ২০০৬ সালের নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে ছয় দফা আপস চুক্তি করেছিল, উদ্দেশ্য অভিন্ন। অর্থাৎ তাদের সমর্থন লাভে ক্ষমতায় যাওয়া। এ নিয়ে প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির প্রমুখ ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গিয়ে জোর প্রতিবাদ করেছিলেন। ক্ষমতার মোহে তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক দলটি একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশে তৎপর হলেও দল ও সরকার সংশ্লিষ্টরা অসাম্প্রদায়িকতার ধোয়া তুলতে দ্বিধা করছেন না। ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে সমর্থন আদায়ে ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের কাছে দোয়া চাইতে যেতে হয়েছিল। তারপরও বদরুল হায়দার চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রার্থীরূপে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আমাদের প্রশ্ন, আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে কৌশল অবলম্বন করায় আদর্শ আর থাকে কীভাবে? আদর্শ বর্জন করে কৌশল গ্রহণকে পৃথকভাবে বিবেচনা করার উপায় কোথায়! তাহলে আদর্শ আর কৌশলকে দুভাবে তিনি দেখছেন কীভাবে? কৌশলের কাছে যদি আদর্শ বিকিয়ে যায় তাহলে আদর্শ বলে তো কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। প্রত্যেক জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক ভাস্কর্য শিল্প ধ্বংসের প্রবণতা এবারই কিন্তু প্রথম নয়। অতীতে শিশু একাডেমির চত্বরে ‘দুরন্ত’ ভাস্কর্যটি রাতের অন্ধকারে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টেও ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছিল। বিগত সেনাশাসিত সরকারের আমলে বিমান বন্দরের সড়ক দ্বীপে ‘লালন’ ভাস্কর্য অপসারণেও এদের মুখ্য ভূমিকা ছিল। প্রশ্ন আসে সরকার হেফাজতকে নাড়ছেÑ না হেফাজত সরকারকে নাড়ছে। এক্ষেত্রে হেফাজতের সাফল্যের পাল্লাটাই ভারী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার সরকারের সাফল্য কোথায়? আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, কর সেবক, সংঘ পরিবারসহ সবাই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশে বলেছিল, ‘তোমার পিতা এক পাকিস্তান তৈরি করেছে, আর তুমি দুই পাকিস্তান তৈরি করতে যাচ্ছ।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী হিন্দু জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমন্ত্রণ জানানো সঙ্গতকারণে দেশবাসী সুনজরে দেখেনি। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করেছে, তাদের নির্দয়ভাবে আক্রান্ত হতে হয়েছে সরকারি দলের ছাত্র-সংগঠন ও পুলিশের দ্বারা। হেফাজতিদের ভূমিকা আক্রমণাত্মক এবং হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড কিন্তু কেবল মোদির আগমনের বিরোধিতা তা কিন্তু নয়। এর পেছনে রয়েছে অভিনব অভিসন্ধি। যার প্রমাণ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। হেফাজতিদের আশকারা দেয়ার মাশুল গুনতে হবে সরকারকেই। আজ দেশজুড়ে যে অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার দায় সরকার কী করে এড়াবে। বাংলায় প্রবচন আছেÑ ‘সর্পের মস্তকে মণি থাকলেও সে কি ভয়ঙ্কর নহে।’ ভোটের রাজনীতির এদের কাছে মণির আশা করার দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App