×

জাতীয়

বিধিনিষেধ কার্যকর কীভাবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৩০ এএম

বিধিনিষেধ কার্যকর কীভাবে

আগের রেকর্ড ভেঙে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনাসহ লকডাউন দেয়া হলেও সড়কে এর কোনো লক্ষণই নেই। গতকাল রাজধানীর পুরান ঢাকার নবাব ইউসুফ কাঁটারা রোড থেকে তোলা ছবি -ভোরের কাগজ

* সর্বোচ্চ কড়াকড়ির চিন্তা, নতুন নির্দেশনা রবিবার *  সমন্বয়হীনতায় দফায় দফায় শর্ত শিথিল

করোনার সংক্রমণরোধে সরকারের আরোপ করা বিধিনিষেধগুলো অনেকেই মানছেন না। গত ৫ এপ্রিল বিধিনিষেধ আরোপ করার একদিন পর মহানগরগুলোতে গণপরিবহন চলাচল শুরু এবং গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে দোকানপট, শপিংমল খুলে দেয়ার পর বিধিনিষেধ না মানার প্রবণতা আরো বেড়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, করোনার সংক্রমণরোধে সরকারের দেয়া বিধিনিষেধ কার্যকরের কৌশল কী হবে? সব মিলিয়ে বিধিনিষেধ জারি ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব দেখা গেছে। এর ফলে করোনা সংক্রমণরোধে কাক্সিক্ষত সুফলও মিলছে না। তবে সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, করোনার বিস্তার ঠেকাতে নতুন কৌশল নেয়া হবে। সর্বোচ্চ কড়াকড়ি আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী রবিবারই আসছে এ বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, বিধিনিষেধ যেভাবে জারি করা হয়েছে সেখানে আমরা সমন্বয়হীনতার আভাস পেয়েছি। যখনই এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হয় তখন জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শ নিতে হয়; কিন্তু এখানে তা করা হয়নি। তারমতে, আমরা লকডাউনের সঙ্গে পরিচিত এবং আমাদের দেশে লকডাউন থিউরি কাজ করেনি। তারপরও আমরা এই কথিত লকডাউনে কেন গেলাম? আমার মনে হয় হয়, সব মিলিয়ে এখানে একটি নির্বুদ্ধিতা কাজ করেছে। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগেই সরকার বাস, লঞ্চ ভাড়া বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করল। তারপর সরকার লকডাউন দিল। এখন সবাই আন্দোলন করছে আর সরকার খুলে দিচ্ছে। তাহলে কাল থেকে বাসওয়ালারা বলবে তারাও দূরপাল্লার গাড়ি চালাতে চায়। ভেবে-চিন্তে করলে এত অরাজকতা তৈরি হতো না বলে মনে করেন তিনি। এই ঢাবি শিক্ষাবিদের মন্তব্যের যৌক্তিকতা মিলে পরিবহন মালিক সংগঠনের নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহর তার বক্তব্যে বলেন, আন্তঃজেলা গণপরিবহন চালানোর জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে চাপ আসছে। কিন্তু সরকারের নির্দেশ না পেলে তো চালাতে পারব না।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত ৪ এপ্রিল সরকার অবাধ চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ এনে ১১ দফা আদেশ জারি করে। ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত এই বিধিনিষেধের সময় থাকলেও ৬ এপ্রিল থেকেই চলাফেরার জন্য গণপরিবহন চালানোর জন্য দাবি ওঠে। একই সঙ্গে দোকানপাট খুলে দেয়ার জন্যও আন্দোলন শুরু হয়। এরপর সরকার প্রথম দফায় গত ৭ এপ্রিল শুধু দেশের সব মহানগরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালুর অনুমতি দেয়। আর গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আদেশ জারি করে বলা হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে আজ শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে ৫টা- এই সময়ের মধ্যে আগামী ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত শপিংমল ও দোকানপাট খোলা রাখা যাবে। এর ফলে বিধিনিষেধের অন্যতম বড় দুটি অংশ খুলে দেয়া হয়। বিধিনিষেধের ১১ দফার মধ্যে আন্তঃজেলা যাত্রীবাহী গণপরিবহন, ট্রেন ও বিমান যোগাযোগ বন্ধ আছে।

এ রকম পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধের সময় ১১ এপ্রিলের পর আরো বাড়বে কিনা- সে বিষয়টি নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ পর্যালোচনা করলেও কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। শুধু দোকানপাট খোলার কথা জানিয়েছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, বিধিনিষেধের সময় বাড়বে কিনা? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে কিনা তা আগামী ১১ এপ্রিলই জানিয়ে দেয়া হবে।

এদিকে করোনা ভাইরাস মহামারি থেকে মানুষকে বাঁচাতে সামনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস এখন একটা মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে এবং আমরাও সেই ধাক্কাটা দেখতে পাচ্ছি। তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নিলেও ভবিষ্যতে হয়তো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে মানুষকে বাঁচানোর জন্য এবং সেটা আমরা নেব। দেশবাসীকে আজকে এই সভার মাধ্যমে সবাইকে বলব- প্রত্যেকে আপনারা যাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধিটা মেনে চলে সেই ব্যবস্থাটা নেবেন।

বিধিনিষেধ জারির পর থেকে ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, বিপুলসংখ্যক লোক দোকান থেকে পণ্য কিনতে বা আশপাশের চা স্টলে আড্ডা দিতে রাস্তায় নামছেন। এই কয়েক দিনে রাজধানীতে লোকের অবাধ চলাচল, মাঝারি যানজট, কাঁচাবাজারে জনসমাবেশ এবং এমনকি বিক্ষোভ করতেও দেখা গেছে। বিধিনিষেধ উপেক্ষার অস্বস্তিকর চিত্র এমন একসময়ে এসেছে যখন কোভিড সংক্রমণ এবং মৃত্যু উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। গতকালও দেশে ৬ হাজার ৮৫৪ জনের দেহে কোভিড সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে, যা আগের দিনের তুলনায় কম হলেও এ পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে গতকাল।

ঠিক এই অবস্থাকে আমলে নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে শেখ হাসিনা সরকার ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগর এলাকাধিক সড়কে শর্তসাপেক্ষে গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মহানগরে বেশির ভাগ পরিবহন নিষেধাজ্ঞা মানলেও অনেক পরিবহন মানছে না। আবার কেউ কেউ নির্দিষ্ট এলাকা এবং নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে পরিবহন চালাচ্ছে। শর্ত উপেক্ষা করলে সরকার আবারো কঠোর হতে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ার করে দেন ওবায়দুল কাদের। তিনি আবারো সবাইকে শতভাগ মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান।

এদিকে কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে চার দিনের মাথায় শপিংমল, দোকানপাট বন্ধসহ বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে সরকার। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময় এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, আরেকটু পরিকল্পনা করে আগামী রবিবার নাগাদ নতুন করে নির্দেশনা জারি হতে পারে। নিশ্চয় আমাদের ভিন্ন কিছু পরিকল্পনা আছে। প্রধানমন্ত্রী সব বিষয়ে নতুন করে নির্দেশনার কথা ভাবছেন। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কেন দোকানপাট খুলে দেয়া হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েক দিন ধরে দোকান খুলে দিতে মালিক-কর্মচারীরা রাস্তায় বিক্ষোভ করছিলেন। তাদের এই বিক্ষোভ তাদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। একটি অসাধু চক্র সেই বিক্ষোভের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছিল বলে আমরা দেখেছি। এমন পরিস্থিতিতে দোকানপাট, শপিংমল না খুলে দিয়ে উপায় ছিল না। তবে অন্যান্য বিধিনিষেধ আগের মতোই থাকবে। আর দোকান বা শপিংমলে প্রত্যেক ক্রেতা-বিক্রেতার স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেসব কেউ মানছেন কিনা সেটাও মনিটরিং করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকারের তরফ থেকে মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ নানা নির্দেশনা দেয়া হলেও সেসব বিষয়ে মানুষ উদাসীন থেকেই গেছে বরাবরই। সর্বশেষ গত সোমবার থেকে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের কথা বললেও দেখা গেছে ‘লকডাউন’ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে দেখা গেছে মানুষের জটলা। ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গণপরিবহন চলাচল, রাইড শেয়ারিং অ্যাপ বন্ধ ও শপিংমল বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হলেও এসব নির্দেশনার বিরুদ্ধে বড় জমায়েত করে বিক্ষোভও করেছেন মানুষ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কাওসার আফসানা সাংবাদিকদের বলেন, একটি কার্যকর লকডাউন ছাড়া সংক্রমণ প্রতিরোধের আর কোনো বিকল্প নেই। পুলিশ বা আর্মি- যাদের দিয়ে অন্য দেশে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, আমাদের দেশেও তা করতে হবে। ২ সপ্তাহ কঠোর লকডাউন করেন। লকডাউন মানে সব বন্ধ থাকবে। যে কোনো ধরনের জমায়েত বন্ধে কঠোরতার পাশাপাশি লকডাউনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাদের জন্য সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করে আগ্রহী করতে হবে।

আরেকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণের গতি ঠেকাতে লকডাউনই বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি উপায়। তিনি বলেন, ওপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লকডাউন কার্যকর করার উপায় খুঁজতে হবে কর্তৃপক্ষকে। ওপর থেকে ঘোষণা করলাম, বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে করলে হবে না। শুরুর দিকে যা করা হয়েছিল তা এখন করলে হবে না। ব্যবস্থা এটাই যে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন জায়গায় সীমিতকরণ ও কোনো কোনো জায়গা খুলে দেয়া। কিন্তু এটি কার্যকরে মনোযোগী হতে হবে।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এভাবে লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ দিয়ে কাজ করানো কঠিন। সব মিলিয়ে সমন্বয় করতে হবে। পাশাপাশি মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে। তবেই করোনা সংক্রমণ ঠেকানো যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App