×

সাময়িকী

বাংলাসাহিত্যে হরিনাথের অবদান মূল্যায়ন জরুরি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২১, ১২:১০ এএম

বাংলাসাহিত্যে হরিনাথের অবদান মূল্যায়ন জরুরি
আবুল আহসান চৌধুরী উনিশ শতকে বাঙালিসমাজ এক অভিনব আত্মবিকাশ ও প্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করে। মূলত জাগৃতির এই চাঞ্চল্য কলকাতা মহানগরী-কেন্দ্রিক হলেও সময়ান্তরে দূর-মফস্বলে এর কিছু প্রভাব পড়েছিল। ইংরেজি শিক্ষা ও প্রতীচ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা, স্বাজাত্যবোধ ও স্বদেশচিন্তা, সমাজ-সংস্কার ও সমাজ-উন্নয়ন প্রচেষ্টা, সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা ও সংবাদ সাময়িকপত্রের প্রকাশনা, কিছু বিলম্বে হলেও ক্রমশ এ সবকিছুর হাওয়া এসে লেগেছিল নিস্তরঙ্গ মফস্বলে। এই পটভূমিকায় গ্রামীণ সমাজে এক-দুইজন নিঃস্বার্থ-নির্ভীক-কর্মিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনতে পেয়ে নতুন যুগের পক্ষে এক সাহসী ভূমিকা পালন করেন। চিন্তায় ও কর্মে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬) ছিলেন এই গ্রামীণ-এলিটদের একজন প্রধান প্রতিনিধি। কাঙাল হরিনাথের জন্ম বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত কুমারখালীর মজুমদার-বংশের এক দরিদ্র-শাখায়। তার জন্মের তারিখ ৫ শ্রাবণ ১২৪০ (১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ)। এই পরিবারের বিত্ত বা বংশকৌলীন্য ছিল না। শৈশবেই হরিনাথ জনক-জননীকে হারান। অপরিসীম দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে তার জীবন শুরু। অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়ের অভাব তাঁকে শৈশবেই ‘কাঙাল’ করেছিল। পরাশ্রয়ে-পরান্নে প্রতিপালিত অনুগৃহীত হরিনাথের ক্ষুণিবৃত্তি নিবারণের উপকরণ ছিল ‘পান্তাভাত, জামিরের পাতা, আর লবণ’। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হরিনাথকে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে। অভিভাবকত্বের অভাব আর দারিদ্র্যের কারণে হরিনাথের উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ সম্ভব হয়নি। স্থানীয় পাঠশালা ও কুমারখালীতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি স্কুলে তিনি কিছুকাল বিদ্যাচর্চা করেন। কিন্তু ‘অন্নবস্ত্রের ক্লেশ ও পুস্তকাদির অসদ্ভাবে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অসম্পূর্ণই থেকে যায়। বিদ্যাশিক্ষার প্রতি তার আগ্রহ এতোই প্রবল ছিল যে তিনি পুস্তক ভিক্ষা করে, কখনো তা নকল করে, আবার কখনো অবসর সময়ে সতীর্থদের পুস্তক পাঠ করে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের অভাব মেটাতেন। এরপর গ্রামে লেখাপড়া শেখার সুযোগ-সুবিধা এবং অন্নসংস্থানের কোনো উপায় না থাকায় হরিনাথ বিদ্যাশিক্ষার আকাক্সক্ষা নিয়ে কলকাতায় যান। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিফল মনে তিনি আবার গ্রামে ফিরে আসেন। হরিনাথের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের উদ্যোগ ও প্রয়াসের এখানেই সমাপ্তি। এরপর বিভিন্ন সূত্রে ও নিজের প্রচেষ্টায় হরিনাথের কিছু বিদ্যাচর্চা হয়। এ বিষয়ে তিনি ব্রাহ্মসমাজের কাছে বিশেষ ঋণী। তার ভাষাশিক্ষার জন্য কবি ঈশ্বর গুপ্তের (১৮১২-১৮৫৯) ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রের দানও কম নয়। “কোনোদিন কোনো বিদ্যালয়ে লেখাপড়া না শিখেও, কাঙাল হরিনাথ অদ্বিতীয় সাহিত্যিক ও অশেষ শাস্ত্রজ্ঞ হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে স্বশিক্ষিত এই সাহিত্য-সাধক সম্পর্কে এই মন্তব্য অযথার্থ বা অসঙ্গত নয়।’ দুই. বিদ্যাশিক্ষা অসমাপ্ত রেখে নিতান্ত বালক-বয়সেই হরিনাথকে জীবিকার অন্বেষণ করতে হয়। প্রথম জীবনে তিনি কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে দৈনিক দু’পয়সা বেতনে চাকরিতে বহাল হন। এরপর ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিসীর কাজে যোগ দেন। কিন্তু রায়তপ্রেমী ও সত্যনিষ্ঠ হরিনাথের পক্ষে এখানেও বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। নীলকুঠির এই স্বল্পকালীন কর্মজীবনে হরিনাথ রায়তপ্রজার ওপর কুঠিয়ালদের পীড়ন-অত্যাচার-শোষণের স্বরূপ প্রত্যক্ষের সুযোগ লাভ করেন এবং তা প্রতিকারের চিন্তা তখন থেকেই তার মনে জাগে। উত্তরকালে সাময়িকপত্র প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর এই আকাক্সক্ষা পূরণ হয়। নিজে যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করতে পারেননি বলে লোকশিক্ষার প্রতি হরিনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল। তাই নিজে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে নির্বাচন করেছেন, উদ্যোগী হয়েছেন বিদ্যালয় স্থাপনে, নারীশিক্ষা প্রসারে আত্মনিয়োগের পাশাপাশি মনোযোগী হয়েছেন বিদ্যালয়-পাঠ্য পুস্তক রচনায়। গ্রামের শিশু-কিশোরদের বিদ্যাশিক্ষার জন্য তিনি ১৮৫৪ সালের ১৩ জানুয়ারি কুমারখালীতে একটি বাংলা পাঠশালা স্থাপন করে সেখানে বিনা বেতনে শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন যথার্থ লোকশিক্ষক। গ্রামের বখাটে, দুশ্চরিত্র ও গুণ্ডা-প্রকৃতির বালক-কিশোররাও হরিনাথের সাহচর্যে সংশোধনের ও প্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করে। বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনা হরিনাথের শিক্ষাকার্যক্রমের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ যখন নারী-প্রগতি ও স্ত্রীশিক্ষার বিপক্ষে, হরিনাথের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার গুরু কবি ঈশ্বর গুপ্তও যখন এর বিরোধী ছিলেন, তখন সেই তামসিক সময়ে সুদূর পল্লী কুমারখালীতে হরিনাথ স্ত্রীশিক্ষার ব্রত গ্রহণ করেছেন, এই প্রয়াস যুগের প্রেক্ষাপটে যথেষ্টই ব্যতিক্রমী ঘটনা। হরিনাথ ১৮৬০ সালে তার বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে নিজেই শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। স্ত্রী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার সপক্ষে দ্বিধাহীনভাবেই তিনি স্পষ্ট মত প্রকাশ করেছেন। তার ‘বিজয়-বসন্ত’ উপাখ্যানে প্রসঙ্গক্রমে আলাপচারিতার সূত্রে স্ত্রী শিক্ষার সমর্থনে এই ধারণা ব্যক্ত হয়েছে যে : “অনেকেই বিবেচনা করিবেন, স্ত্রীজাতি বিদ্যাশিক্ষা করিলেই দুশ্চরিত্রা হয়। এমন কি দেশে এরূপ প্রথা অদ্যাপি প্রচলিত আছে যে, তাহারা স্ত্রীলোকের বিদ্যাশিক্ষা অতি গর্হিত বিবেচনা করেন; কিন্তু এ কেবল তাঁহাদিগের বুঝিবার ভ্রান্তি, যে স্ত্রী আপনা-আপনি আপনাকে রক্ষা করে, সেই সুরক্ষিতা। নতুবা মূক করিয়া গৃহে বদ্ধ করিলে, তাহাতে সুরক্ষিত হওয়া দূরে থাক, বরং মহানর্থের মূল হইয়া ওঠে।” শিক্ষক হিসেবে হরিনাথ অত্যন্ত সফল ও সার্থক ছিলেন। শিক্ষক হরিনাথের কৃতি সম্পর্কে তাঁর প্রিয়-শিষ্য জলধর সেন (১৮৬০-১৯৩৯) মন্তব্য করেছেন : “আমরা হরিনাথের ছাত্র, শিক্ষকতাকার্যে কেশ পরিপক্ব হইয়া আসিল, অনেক স্থানে এ পর্যন্ত অনেক শিক্ষক দেখিয়াছি কিন্তু হরিনাথের ন্যায় শিক্ষাদানে নিপুণ, ক্ষমতাশালী শিক্ষক এ পর্যন্ত একজনও দেখিলাম না। কিরূপভাবে শিক্ষা দিলে এক নতুন বিষয়ও বালক-বালিকাগণের মনে দৃঢ়রূপে অঙ্কিত হইতে পারে এবং তাহা সহজে তাহাদের আয়ত্ত হয়, তাহা তিনি অতি উত্তম জানিতেন। ইয়ুরোপ প্রভৃতি দেশ হইলে তিনি শিক্ষক-শ্রেষ্ঠ স্পেনসারের সমান সম্মান এবং খ্যাতিলাভ করিতে পারিতেন।” মাতৃভাষার প্রতি তাঁর সপ্রেম অনুরক্তির পরিচয় নানাভাবে পাওয়া যায়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ধারণায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। মাতৃভাষার চর্চা জাতীয় উন্নতির সঙ্গে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, হরিনাথ এই মত দৃঢ়ভাবে পোষণ করতেন। গ্রামবার্তা’য় তাই তিনি লিখেছেন : “যতদিন বঙ্গসন্তান মাতৃভাষা উপেক্ষা করিয়া পরভাষার পক্ষপাতী থাকিবেন, যতদিন মাতৃভাষা ঘৃণা করিয়া বৈদেশিক ভাষানুশীলনে সময় ক্ষেপণ করিবেন, ততদিন বঙ্গের কোনো আশা আমরা করি না, ততদিন জাতীয় উন্নতির কোনো সম্ভাবনা দেখি না। যাহাতে দেশে মাতৃভাষার চর্চা দিন ২ বৃদ্ধি পায়, যাহাতে মাতৃভাষা আদরের সামগ্রী, যত্নের ধন বলিয়া লোকের প্রতীতি জন্মে, যাহাতে সকলে বদ্ধপরিকর হইয়া মাতৃভাষার দীনবেশ ঘুচাইতে সমর্থ হয়েন, বিবিধ রত্নে মাতৃভাষাকে অলঙ্কৃতা করিতে কৃতসংকল্প হয়েন, সে বিষয়ে চেষ্টা করা প্রত্যেক বঙ্গসন্তানের অবশ্য কর্ত্তব্য কর্ম্ম।” সামগ্রিক পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লোকশিক্ষক হরিনাথের শিক্ষাচিন্তা ছিল লোকহিতব্রতে উদ্বুদ্ধ, ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং প্রকৃত বিদ্যাচর্চার আদর্শের উপর স্থাপিত। হরিনাথের সক্রিয় কর্মজীবনের শেষ-স্বাক্ষর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা প্রকাশ (১ বৈশাখ ১২৭০/এপ্রিল ১৮৬৩)। এই পত্রিকা পরিচালনার কারণেই তিনি শিক্ষকতার কর্মত্যাগ করেন। পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে তিনি পাঠ্যপুস্তকাদি বিক্রয়ের পুস্তকালয় স্থাপন করেন, কিন্তু পুস্তক-বিপণির সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে তার। পুস্তকালয়ের আয় ক্রমে হ্রাস পায়। এই সময়ে গ্রামবার্ত্তার জন্য চরম ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। উপার্জনের নির্দিষ্ট উৎস না থাকায় তার চরম অর্থ-সংকট দেখা দেয় এবং এই দুরবস্থার ফলে আক্ষরিক অর্থেই তিনি প্রায় ‘কাঙাল’ হয়ে পড়েন। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে মোট প্রায় ২২ বছর চলেছিল। এই পত্রিকা প্রকাশনার প্রয়োজনে তিনি ১২৮০ সালের প্রথমদিকে কুমারখালীতে ‘মথুরানাথ যন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার অভাবে আশ্বিন ১২৯২ গ্রামবার্তার প্রকাশনা চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে ‘গ্রামবার্তা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা হিসেবে স্বীকৃত, যা কৃষক-প্রজা-রায়ত শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যশ্রেণির স্বার্থের অনুকূলে যুগোপযোগী একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। তিন. হরিনাথ বিশুদ্ধ শিল্প-প্রেরণায় সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ হননি। মূলত ‘সুনীতি’, ‘ধর্মভাব’ ও ‘লোকশিক্ষার প্রয়োজনেই তিনি লেখনী ধারণ করেন। তার রচনা এক অর্থে লোক-শিক্ষারই বাহন। তবুও তার ‘বিজয়-বসন্ত’ ও ‘বাউল গীতাবলি’ এবং কিছু সামাজিক প্রবন্ধ বাংলাসাহিত্যে বিশেষ মর্যাদালাভের অধিকারী। হরিনাথের সাহিত্যবোধের উন্মেষ ঘটে গ্রামীণ-সংস্কৃতির সংস্পর্শে। লৌকিক পঁচালি, কবিগান, কীর্তনÑ এ সবের অভিজ্ঞতা ছিল তার কাব্য-রচনার প্রেরণা ও সহায়ক। প্রকৃতপক্ষে, ‘বাল্যকালে কবির গান শুনিতে শুনিতে বা কাঙালের কথাতেই বলি গিলিতে গিলিতে’ অশিক্ষিত বালক হরিনাথের কবিত্বশক্তির স্ফুর্তি হয়। গ্রাম্যরুচি-শাসিত এই লৌকিক সংস্কৃতির ধারা হরিনাথ-মানসকে প্রথম জীবনে প্রভাবিত করলেও উত্তরকালে তিনি এই রুচিকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। সাহিত্যচর্চার আদিপর্বে হরিনাথ ঈশ্বর গুপ্তের প্রেরণায় ও তার অনুকরণে কবিতা রচনা আরম্ভ করেন। গুপ্তকবির ‘উপদেশ’ ও ‘সহায়তায়’ হরিনাথ ক্রমশ ‘সুলেখক’ হয়ে ওঠেন। এইদিক দিয়ে বিচার করলে ঈশ্বর গুপ্তকে হরিনাথের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ‘গুরু’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। কাঙাল হরিনাথ গদ্য-পদ্য মিলিয়ে প্রায় ৪০ খানা গ্রন্থ রচনা করেন। অবশ্য এর মধ্যে সবই যে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল তা নয়। কয়েকটি গ্রন্থ ধারাবাহিক সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়, আবার কয়েকটি পাণ্ডুলিপি আকারে অপ্রকাশিতই ছিল। এছাড়া তাঁর অগ্রন্থিত বিচ্ছিন্ন রচনার সংখ্যাও কম নয়। ‘প্রভাকর’ ‘গ্রামবার্ত্তা’ ও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় স্বনামে-বেনামে-ছদ্মনামে কাঙালের অনেক রচনা প্রকাশিত হয়। কিন্তু হরিনাথের এসব গ্রন্থ ও রচনা বর্তমানে অতি-দুষ্প্রাপ্য। কাঙাল হরিনাথের সামাজিক চিন্তামূলক রচনার মধ্যে আছে ‘মনুজ’, ‘ভারতোদ্ধার’, ‘সেবা ও সেবাপরাধ’, ‘ঠানদিদির বৈঠক’। হরিনাথের এই চারটি রচনাই ‘হীন’ ছদ্মনামে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’য় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। ‘মনুজ’ তার আত্মবোধ ও প্রচ্ছন্ন সমাজচেতনার কাব্য-ভাষা। ভারতের সার্বিক উন্নয়নের অন্তরায় এবং তা দূরীকরণের পন্থা নিয়ে হরিনাথ আলোচনা করেছেন ‘ভারতোদ্ধার’ শীর্ষক রচনায়। “যথোচিত সেবাকার্য নির্বাহ করাই মনুষ্যজাতির জন্মগ্রহণের ও উন্নতির হেতু এবং সেবাপরাধই অবনতির নিদান”Ñ ‘হরিনাথের ‘সেব্য ও সেবাপরাধ’ রচনার এ-ই হলো মূল প্রতিপাদ্য। তার সমাজচিন্তার সবচেয়ে সার্থক পরিচয় আছে ‘ঠানদিদির বৈঠক’ নামীয় রচনায়। কৌতুক-ব্যঙ্গের সহযোগে গল্পচ্ছলে নানা সামাজিক-ধর্মীয়-রাষ্ট্রীয় বিষয় সম্পর্কে এখানে স্বাধীন মতামত বিবৃত হয়েছে। এছাড়া গ্রামবার্ত্তায় প্রকাশিত অস্বাক্ষরিত কিংবা ছদ্মনামে রচিত অনেক নিবন্ধ, উপসম্পাদকীয় ও সম্পাদকীয় রচনায় সমকালীন জীবন ও জনমত, গভীর সমাজচেতনা ও শিল্পবোধের পরিচয় আছে। এ প্রসঙ্গে একজন সমালোচক মন্তব্য করেছেন, “শুধু নির্যাতিত প্রজাপক্ষ সমর্থনের জন্যই নয়, যুক্তি-তথ্য ও উপস্থাপনার বলিষ্ঠতায় হরিনাথের এ বিষয়ক একাধিক লেখা উচ্চাঙ্গের প্রবন্ধসাহিত্য বলে গণ্য হতে পারে। এই সামাজিক রচনাগুলোয় সমাজমনস্ক হরিনাথের স্বদেশচিন্তা, স্বাজাত্যবোধ ও সমাজকল্যাণ চেতনার পরিচয় মেলে। তার বক্তব্যের ঋজুতা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতাও এখানে বিশেষ লক্ষ্যযোগ্য।” সাহিত্য-রসাশ্রিত, রচনার মধ্যে ‘বিজয়-বসন্ত’, ‘চিত্তচপলা’ ও ‘প্রেম-প্রমীলা’Ñ এই তিনখানি উপন্যাসধর্মী রচনার কথাও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের এক নামি পরিবারের গৃহবিবাদ উপলক্ষ করে হরিনাথ ‘চিত্তচপলা’ উপন্যাস রচনা করেন। প্রেম-প্রমীলা’ উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে ভাগ্যবিড়ম্বিত পরিচয়হীন রাজপুত্র প্রেম ও রাজকুমারী প্রমীলার মধ্যে। সংস্কৃতবহুল ভাষায় রচিত এই উপাখ্যানের কাহিনীতে রূপকথার প্রভাব লক্ষণীয়। এই পর্যায়ে ‘বিজয়-বসন্ত’ই হরিনাথের সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি। যৌবনে রচিত এই উপাখ্যানটি তার শিল্প-শক্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। জানা যায়, ‘বিজয়-বসন্তের কুড়িটির অধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। “নিতান্ত শিশুপাঠ্যবর্ণ পরিচয়দি ভিন্ন অন্য কোনো বাঙ্গলা গ্রন্থের এরূপ বহুলপ্রচার” হয়নি এবং “পল্লীবাসী সাহিত্য-সেবকের কোনও গ্রন্থই এরূপ সমাদর লাভ করে নাই”। গ্রন্থটির নামকরণে হরিনাথের অকালপ্রয়াত দুই পুত্র বিজয় ও বসন্তের স্মৃতি জড়িত। হরিনাথের ব্যাপক পরিচিতি ও লোকপ্রিয়তার মূলে আছে তার বাউলগান। তার। জীবনদর্শন, অধ্যাত্ম-ভাবনা ও মরমি-মানসের পরিচয় বিধৃত রয়েছে এইসব গানে। নিরন্তর অনুশীলনের মাধ্যমে কাঙাল বাউলগানের একটি স্বতন্ত্র কাব্য-ভাষা ও ‘ঘরানা’ নির্মাণ করতে সক্ষম হন। সমকালীন সাক্ষ্যে জানা যায়, বৃহত্তর বঙ্গ “হরিনাথের বাউল-সঙ্গীতের পবিত্র স্রোতে প্লাবিত” হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বিষয়-বৈচিত্র্য, ভাব-গভীরতা ও শিল্পচেতনায় কাঙালের বাউলগান সঙ্গীত-সাহিত্যের মর্যাদালাভে সক্ষম হয়। হরিনাথ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না, ছিলেন না নাগরিক-রুচির বৈদগ্ধে শাসিত। ইংরেজি না জানার কারণে বিশ্বসাহিত্য ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের আস্বাদ থেকে মূলত বঞ্চিতই ছিলেন। লৌকিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও বঙ্গবিদ্যার স্বল্প পুঁজি সেই স্থান পূরণ করেছিল বলে বাঙালিজীবনের ধর্ম-সংস্কৃতির পরিচয়ই মূলত প্রতিফলিত হয়েছে তার রচনায়। নাগরিক-রুচি সম্পূর্ণ তৃপ্ত করতে না পারলেও হরিনাথের রচনা বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজের আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে একাত্ম ছিল। তাঁর সাহিত্যকর্মের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একজন সমালোচক মন্তব্য করেছেন : “অনেকে জানেন, হরিনাথ কতগুলা ন্যাড়া বাউলের গান বাঁধিয়া গিয়াছেন মাত্র! সেই সকল শিক্ষিত ভদ্রজনের নিকট হরিনাথ নিতান্ত উপেক্ষার পাত্র; কারণ তিনি বাঙ্গালার মিলটন, স্কট, বাঙ্গালার শেলী, বায়রণ, বা মেকলে ছিলেন না; কিন্তু তিনি বাঙ্গালার হরিনাথ-বাঙ্গালীর হরিনাথ।... তাহার কবিতায় আমরা বিদেশীয় ভায়োলেট, হাসনাহানা, ম্যাগনোলিয়া, গ্রাডিফ্লোরা, ডেফোডিল, বা লিলির সৌরভ পাইনা বটে, কিন্তু প্রস্ফুটিত কদম্ব, কেতকী, শেফালিকা, চম্পক, রজনীগন্ধার দেশী সুগন্ধে তাহার কবিতা ভরপুর।” প্রকৃতপক্ষে লৌকিক জীবনের সঙ্গে সুগভীর সংলগ্নতার কারণে তার শিল্পকর্মে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাসাহিত্যে হরিনাথের অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। গ্রাম্য পাঁচালিকার, বাউল পদকর্তা, নীতি-শিক্ষামূলক শিশুপাঠ্য পুস্তক-রচয়িতা, ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যাকারÑ এই ধরনের প্রক্ষিপ্ত মন্তব্য-পরিচয়ের অভ্যন্তরেই মূলত হরিনাথের সাহিত্যপ্রতিভার মূল্যায়ন সীমাবদ্ধ। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে হরিনাথ উপেক্ষিত, কোনো ইতিহাসকার কিংবা সমালোচকই তার প্রতি সুবিচার করেননি। অবশ্য সমকালীন বিদ্বদসমাজে হরিনাথ        শিবনাথ শাস্ত্রী তার ‘বিজয়-বসন্ত’ সম্পর্কেও সপ্রশংস মন্তব্য করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও (১৮৬১-১৯৪১) সাগ্রহে কুমারখালীর কাঙাল-কুঠির থেকে হরিনাথের কিছু বই সংগ্রহ করেন। এই ধরনের উদাহরণ হয়তো আরো উপস্থাপিত করা যায়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বলতে হয়, হরিনাথ তার প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। হরিনাথের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে তার সাহিত্য-শিষ্য দীনেন্দ্রকুমার রায় (১৮৬৯-১৯৪৩) যে মন্তব্য করেছেন, তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ : “বঙ্গের লেখকশ্রেষ্ঠ বিদ্যাসাগর, ঈশ্বর গুপ্ত, অক্ষয়কুমার দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ, রাজনারায়ণ বসু ও কালীপ্রসন্ন ঘোষ মহোদয়গণের নিকট যদি আমাদের মাতৃভাষা ঋণী থাকেন, তাহা হইলে তাহার-হরিনাথের ঋণ অস্বীকার করিবার উপায় নাই।” হরিনাথ নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। তাকে কেন্দ্র করে কুমারখালীতে একটি সাহিত্যচক্র গড়ে ওঠে। কাঙাল-অনুরাগী এই সাহিত্য-গোষ্ঠী ‘গ্রামবার্ত্তা’ পত্রিকা পরিচালনা ও ফিকিরচাঁদের বাউলদল গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। হরিনাথ কেবল সাহিত্যস্রষ্টাই ছিলেন না। তিনি সাহিত্যিকেরও স্রষ্টা ছিলেন এবং অনেককেই ‘সাহিত্য-সেবাব্রতে দীক্ষিত’ করে বাংলাসাহিত্যে খ্যাতিমান হওয়ায় সুযোগ করে দেন। এ কথা যথার্থ যে, “হরিনাথের আদর্শে, হরিনাথের উপদেশে, হরিনাথের সহায়তায়, কুমারখালী প্রদেশে অনেকের হৃদয়ে সাহিত্যানুরাগ সঞ্চারিত হইয়াছিল।” এঁদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২), জলধর সেন, তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণর (১৮৬০-১৯১৩), ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রের (১৮৬১-১৯৩০), দীনেন্দ্রকুমার রায়, কবি-ঔপন্যাসিক চন্দ্রশেখর কর (১৮৬১-?) প্রমুখের নাম বাংলাসাহিত্যে সুপরিচিত। কাঙালের এই মধুচক্রে বাউল-শিরোমণি লালন সাঁইয়েরও (১৭৭৪-১৮৯০) আন্তরিক যোগ ছিল। কাঙালের ব্যক্তিত্বে ছিল সম্মোহনী শক্তি-কাঙাল-মণ্ডলিকে তিনি চুম্বকের মতোই আকর্ষণ করতেন। দীনেন্দ্রকুমার রায় সুদূর মেহেরপুর থেকে তার আকর্ষণে কুমারখালীতে ছুটে আসতেন : “বেণুরববিমুগ্ধ মৃগশিশুর ন্যায় কাঙালের প্রাণস্পর্শী আহ্বানে আকৃষ্ট হইয়া কিশোর বয়সে কতবারই তাহার নিকটে গিয়াছি।” তার প্রিয়-সান্নিধ্যলাভের আশায় আসতেন আর-এক ভক্ত চন্দ্রশেখর কর : “নিদারুণ সংসাররৌদ্রে ঘুরিতে ঘুরিরে ক্লান্ত হইয়া দিনেকের তরে সেই মহাপুরুষের শীতল ছায়ায় যাইয়া উপবেশন করিতাম।” প্রকৃতপক্ষে দূর-মফস্বলে সংস্কৃতিচর্চার একটি অনুকূল আবহ রচনা করতে পেরেছিলেন কাঙাল। এ বিষয়ে ‘প্রভাকর’ সম্পাদক কবি ঈশ্বর গুপ্তের সাহিত্য-বিষয়ক পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে হরিনাথের এই স্মরণীয় ভূমিকার তুলনা হতে পারে। চার. হরিনাথের শেষজীবন অজ্ঞাতবাসের কাল। প্রায় সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে সাধনমার্গে তার জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত হয়। আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হরিনাথ এই পর্যায়ে সমাজ-সংসার সম্পর্কে অনেকখানিই বীতস্পৃহ হয়ে পড়েন। সমাজবিপ্লবী হরিনাথের এই মানস-রূপান্তর অনেকটাই হতাশাগ্রস্ত পরাজিত মনোভাবের পরিচায়ক। সমাজহিতের জন্য, পীড়িত-নির্যাতিত মানুষের জন্য তিনি যে সংগ্রাম করেছিলেন, তা স্বীকৃতি বা সমর্থন তিনি সমাজ থেকে পাননি। তাই এই অবস্থায় তাকে সমাজ-সম্পর্কের বাইরে আত্মমুখিন এক নির্জন বিবর খুঁজে নিতে হয়েছিল, মানবমুখিন হরিনাথ অন্তরের অস্তিত্ব রক্ষার গরজেই ক্রমশ রূপান্তরিত হন ঈশ্বরমুখিন সাধকে। তার সামাজিক-ভাবনার স্থান দখল করে ধর্মাশ্রিত-চেতনা। তার কর্মের সামাজিক স্বীকৃতি থাকলে তিনি হয়তো সক্রিয় সমাজহিতেই জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো ব্যয় করতেন। হরিনাথ যাদের জন্য জমিদার-মহাজন-কুঠিয়ালগোরা পল্টন-রাজকর্মচারীদের বিরাগভাজন হন, সেই কৃষক-প্রজা-রায়ত-পত্নীবাসী তার ‘সংকট ও বিপদে কোনো সাড়া দেয়নি কিংবা তাদের রক্ষাকবজ ‘গ্রামবার্ত্তা’র প্রকাশনা-বন্ধের ব্যাপারেও কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। একধরনের অভিমান, আক্ষেপ ও হতাশা তাকে সামাজিক চিন্তা ও কর্ম থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে ধর্মভাবনার ভেতর দিয়ে সাধনায় স্থাপিত করে। সমাজমনস্ক ও লোকহিতৈষী হরিনাথের এ হলো এক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও দুঃখজনক পরাভব। পাঁচ. কাঙাল হরিনাথ ৫ বৈশাখ ১৩০৩ (১৬ এপ্রিল ১৮৯৬) বৃহস্পতিবার অপরাহু ৩-৩০ মিনিটে অক্ষয়তৃতীয়া তিথিতে কুমারখালীর কাঙাল-কুটিরে ৬৩ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। তার শবানুগমন ও শেষকৃত্যানুষ্ঠানে কুমারখালী অঞ্চলের জাত-বর্ণনির্বিশেষে সর্বশ্রেণীর হিন্দু জনগণ অংশগ্রহণ করেন। হরিনাথের মৃত্যুতে তার প্রিয়-শিষ্য তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব তার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে রচনা করেন ‘শ্মশানে কাঙাল’ (১৩০৩) নামক কাব্য-শোকোচ্ছ্বাস। তার মৃত্যুতে ‘ওহফরধহ গরৎৎড়ৎ’ পত্রিকা মন্তব্য করে, ‘ঞযব উরংঃৎরপঃ ঘঁফফবধ যধং ষড়ংঃড়হব রঃং মৎবধ সবহ’ হরিনাথের মৃত্যুর পর তার শিষ্য ও অনুরাগীবৃন্দ প্রতি বছর অক্ষয় তৃতীয়ায় তার মৃত্যুতিথিতে কুমারখালীর কাঙাল-কুটিরে স্মৃতি-উৎসবের প্রচলন করেন। এই স্মরণোৎসবে বাংলার বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক সাংবাদিক-শিল্পী-বিদ্বজ্জন অংশগ্রহণ করতেন। আশানুরূপ সাহিত্যিক-স্বীকৃতি না পেলেও সুধীজন তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে একেবারে উদাসীন ছিলেন না। শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) হরিনাথের বাংলাভাষায় অধিকার সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App