×

সারাদেশ

করোনায় সংকটে বাউফলের মৃৎশিল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২১, ০৫:১৬ পিএম

করোনায় সংকটে বাউফলের মৃৎশিল্প

করোনায় দক্ষিণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটুয়াখালীর বাউফলের মৃৎশিল্পের সংকটময় পরিস্থিতি

দক্ষিণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটুয়াখালীর বাউফলের মৃৎ শিল্পের সুনাম দেশের গন্ডী পেরিয়ে বিদেশেও রয়েছে। বাংলার লোকজ কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে শিল্পীর নিঁপুন হাতে ফুটিয়ে তোলা হয় বাউফলের এই মৃৎ শিল্পের মধ্য দিয়ে। বিশ্বের মানুষ চিরায়ত বাংলার সংস্কৃতি খুঁজে পায় এই শিল্পের মাধ্যমে। কিন্তু মহামারি করোনার থাবায় কঠিন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলো। বৈশাখী মেলা এবং দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের জন্য লাখ লাখ টাকার মৃৎ পণ্য তৈরী করে সেগুলো সরবরাহ করতে না পেরে বিপাকে পড়েছে মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পীরা।

সরেজমিন দেখা গেছে, বাউফলের মদনপুরা, কনকদিয়া ও বগা ইউনিয়ন এবং বাউফল ইউনিয়নের বিলবিলাস এলাকায়  প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার এই শিল্পের সাথে জড়িত। এছাড়াও এ শিল্পের সাথে সহ-কারিগর হিসেবে জড়িত রয়েছে আরো প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার। বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে হরেক রকমের মাটির পণ্য তৈরী করে ঘরে মজুদ করে রেখেছেন। করোনার কারণে বৈশাখী মেলা অনিশ্চিত হওয়ায় এবং অর্ডার করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তৈরীকৃত পণ্য সরবরাহ করতে না পাড়ায় দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে তাদের কপালে।

এক সময় দেশের প্রায় সকল সাধারন মানুষই সাংসারিক কাজে মাটির তৈরী হাড়ি, পাতিল ও বাসন-কোসন ব্যবহার করতেন। হাতে গোনা দু-চারটি পরিবার তামা, কাশা ব্যবহার করতেন। দেশে প্লাটিক ও সিলভার শিল্পের বিকাশের পর ক্রমেই ধস নামে মৃৎ শিল্পের। আধুনিক যুগের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যান।

১৯৯০ এর দিকে বাউফলের আধুনিক মৃৎ শিল্পের পূরোধা বলে ক্ষ্যাত বিশ্বেশ্বর পাল ঢাকার আড়ং সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিরায়ত বাংলার এই শিল্পকে রক্ষার উদ্যোগ নেন। আধুনিক রুচির মৃৎ শিল্পের উপর প্রশিক্ষিত করানো হয় কয়েকজনকে। এরপর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার নতুন যুদ্ধ শুরু করেন তারা।  আধুনিক রুচি সম্মত ডিজাইন অনুযায়ি মাটির সাথে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক রং দিয়ে তৈরী করতে থাকেন দৃষ্টি নন্দন চায়ের কাপ-পিরিচ, ডিনার সেট, জগ-গ্লাস, ফুলদানী, শো-পিচ, নানা ধরণের খেলনা, ধর্মীয় অনুশাসনের লিপি, কয়েলদানী ইত্যাদি। আগুণে পোড়ানোর পর এগুলোর উপর নারী শিল্পীদের নিঁপুন হাতে বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানের বিখ্যাত বিখ্যাত মেলায় এগুলো ষ্টলে বসিয়ে উপস্থাপণ করা হয়  মানুষের সামনে। ক্রমেই দৃষ্টি আকর্ষণ হয় সর্ব শ্রেণির মানুষের। স্থান পেতে থাকে দেশের বিখ্যাত বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের শো-রুমে। বাউফলের মৃৎ শিল্প পরিচিত হয়ে উঠে দেশের সর্বত্র। গাড়ি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত মানুষ সখের মৃৎ শিল্প সংগ্রহ করতে চলে আসছে বাউফলের মৃৎ পল্লীতে। এক পর্যায়ে নজর কারে বিদেশীদেরও। এরই ধারাবাহিকতায় সৌখিন এই মাটির পণ্য রপ্তানী হতে থাকে জাপান, নেদারল্যান্ডস, আমেরিকা এবং কেনাডাসহ প্রভৃতি দেশে। অর্জন করতে থাকে বিদেশী মুদ্রা। শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলোর মধ্যে আর্থিক, সামাজিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। প্রায় আড়াই যুগ দাপটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দেশ এবং বিদেশে বাউফলের মৃৎ শিল্প স্থায়ী ঠিকানা করে নিতে সক্ষম হয়।

কিন্তু ২০২০ থেকে করোনার প্রার্দুভাব এবং সামাজিক কিছু সমস্যা শুরু হলে ঝিমিয়ে পড়তে থাকে এই শৈল্পীক ব্যাবসাটি। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত মেলাগুলো সামাজিক সমস্যা ও করোনার কারণে বন্ধ রয়েছে। ফলে তৈরীকৃত মালামালগুলো যথা সময়ে বিক্রি করতে না পাড়ার কারণে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছেন মালিক-শ্রমিক সকলেই। বৈশাখী মেলা হবে কী হবে না এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলো। অপরদিকে লকডাউনের কারনে মালামাল সরবরাহ করতে পারছেন না। চাহিদাও অনেকটা কমে গেছে। ফলে লাখ লাখ টাকার পণ্য ঘরে মজুদ হয়ে পড়ে রয়েছে। ২০২১ সালের প্রথম দিকে করোনার প্রভাব কিছুটা কমে গেলে এবং বৈশাখী মেলাকে  সামনে রেখে বাউফলের প্রায় সকল পরিবারেই মালামাল তৈরীতে ব্যস্ত সময় পাড় করছিল। কিন্তু হঠাৎ লক ডাইন শুরু হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা।

বাউফলের মৃৎ শিল্পের অন্যতম কর্ণধার বরুন পাল জানান, প্রায় ৩০ লাখ টাকার মালামাল প্রস্তুত রয়েছে। হঠাৎ লক ডাইনের কারণে মালামাল সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বৈশাখী মেলা নিয়েও রয়েছে সংশয়। তিনি বলেন, বছরের এই সময়টায়ই বেশি পণ্য চলে। সে চিন্তা করে সকল পুঁজি একাজে ব্যয় করেছি। এখন মালামাল নিয়ে মহাবিপদে পড়েছি। শুধু আমরা মালিক পক্ষই নয়, এ কাজের সঙ্গে জড়িত সকলেই এবং দুশ্চিন্তায় রয়েছি পরিবার পরিজন নিয়ে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App