×

সাময়িকী

আমাদের কালের এক বাকজাদুকর

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২১, ১২:১১ এএম

আমাদের কালের এক বাকজাদুকর
রহীম শাহ বাংলা শিশুসাহিত্য আর আঁতুড়ঘরে নেই। থাকার কথাও নয়। সোনালি যুগের শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর আরো একটি বর্ণময় যুগ তৈরি করেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শিবরাম চক্রবর্তী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, অন্নদাশংকর রায়, জসীম উদ্দীন, হাবীবুর রহমান, মোহাম্মদ নাসির আলী, সাজেদুল করিম, সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদাররা। যুগ যুগ ধরে শিশুসাহিত্য উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। কালের বিবর্তনে বাঁকবদলের ধারায় সবসময় সবচেয়ে এবং সব ক্ষেত্রে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে শিশুসাহিত্যিকরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ফয়েজ আহমদ, এখলাসউদ্দিন আহমদ, সুকুমার বড়ুয়া, আতোয়ার রহমান এবং স্বাধীনতা পরবর্তী অসংখ্য শিশুসাহিত্যিকের হাত ধরে শিশুসাহিত্যের যে অগ্রগতি হয়েছে তা সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর। গত শতকের শেষ কুড়ি বছর এবং বর্তমান শতকের শুরুর এই দুই দশক বাংলা শিশুসাহিত্যে দাবড়ে বেড়াচ্ছেন এক উজ্জ্বল অগ্নিপুরুষ। তার নাম আমীরুল ইসলাম। আমি খুব সচেতনভাবেই অগ্নিপুরুষ শব্দটি ব্যবহার করেছি। এই ব্যাখ্যায় না গিয়েই আমি বলতে চাই শিশুসাহিত্যের সৃজনশীল প্রতিটি শাখায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো তিনি ফুলকি ছড়াচ্ছেন অবিরাম। শিশু-মন আর মনস্তত্ত্বকে তিনি চিনে নিয়েছেন। আমাদের কালের নায়কদের মধ্যে তিনিই প্রথম বুঝতে পেরেছেন, শিশুদের মনকে রাঙিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ছড়ার কোনো বিকল্প নেই। অনেকেই পাণ্ডিত্য করে বলেনÑ যুক্তিহীন বিষয় ও অবাস্তব চিত্রÑ আমরা যাকে বলি সুকুমারীয় খামখেয়ালি, তা নানা স্বাদে মুখরোচক হয়ে ওঠে। ছন্দ দোলনায় চড়ে আর শব্দের চমৎকারিত্বে আমীরুলের ছড়া পায় প্রাণ। শিশুরা সেসব ছড়া থেকে আহরণ করে কবিতাময় ঘ্রাণ। শুধু ছড়ায় নয়, গল্পের বাকপটুতায় আমীরুল ইসলামের কৃতিত্ব আকাশচুম্বী। সোজাসাপ্টা কথা, আমাদের সময়ের সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত শিশুসাহিত্যিকটির নাম আমীরুল ইসলাম। তিনি একাধারে লিখে চলেছেন গল্প, ছড়া, উপন্যাস, রূপকথা এবং নাটকসহ নানাবিধ রচনা। তার সাহিত্যজীবনের ঊষালগ্নে জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞানের কয়েক বইও রচনা করেছেন। সায়েন্স ফিকশনও কম লিখেননি তিনি। এক কথায় একজন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। রাশেদ রউফের ভাষায়Ñ রচনার শৈল্পিক উৎকর্ষ ও বক্তব্যের স্পষ্টতার জন্য তিনি সুধী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। নতুন সৌরভ ও দীপ্তি নিয়ে তার অনুভূতি, আবেগ ও কল্পনাকে তিনি পরিব্যপ্ত করেছেন। সমাজ-পরিপার্শ্ব, বিশ্বাস-নিশ্বাস, চারদিকের অস্থিরতা-অস্বাভাবিকতা-আস্থাহীনতা সর্বোপরি দেশের সমকালীন প্রতিচ্ছবিই মূর্ত হয়ে ওঠেছে তার নানা লেখায়। এসব রচনায় তিনি কোথাও শাণিত, কোথাও বর্ণাঢ্য হিসেবে নিজেকে গভীর ও অর্থময় করে তুলেছেন। আধুনিক বাংলা ছড়ার আলোছায়ায় তিনি ঋদ্ধ হয়েছেন, দৃঢ় হয়েছেন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে। তিনি যেমন নিরীক্ষাপ্রবণ ও বুদ্ধিদীপ্ত, তেমনি সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। গদ্য ছড়া ও অনুবাদ ছড়ার মাধ্যমে তিনি বাংলা ছড়ায় নতুন মাত্রা প্রদানে চেষ্টায় রত। কি সংখ্যাপ্রাচুর্যে, কি অভিনবত্বে, কি ব্যঞ্জনায় তিনি গড়ে নিয়েছেন আমাদের শিশুসাহিত্যের স্থায়ী আসন। সময়ের ধারা অনুপাতে তার রচনার সংখ্যা অত্যধিক। বিষয়বৈচিত্র্য, প্রকাশবৈচিত্র্য ও ছন্দবৈচিত্র্যের কারণে তিনি উজ্জ্বল ও সপ্রতিভ। বাংলাদেশের ছড়াকে দিগন্তবিস্তারী ও দিগন্তবিহারী করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। বাংলা ছড়ার আবহমান ঐতিহ্য এবং সমকালের ক্ষত-বিক্ষত বাস্তবতার নিখুঁত সমন্বয়ে তিনি তৈরি করেছেন এমন এক ভুবন, যা তার ছড়াকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। তার স্বাতন্ত্র্যই তার ছড়ার বৈশিষ্ট্য। এই কথা স্বীকার করতে হয়, সাহিত্য রচনার প্রধান হাতিয়ার ভাষা। কোনো লেখক যদি নিজস্ব ধারার ভাষা নির্মাণ করতে না পারেন, তাহলে তিনি যতই লিখুন না কেনÑ একজন সুসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। অবশ্য এতে লেখকের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয় তখনই, যখন দেখি পাঠকই গ্রহণ করে না তাদের। শুধু তাই নয়, তারা কালের বিবর্তনে হারিয়েও যান। কবিতা যে কখনো পুরনো হয় না, কখনো ফুরোয় না। ছন্দের বাকপ্রতিমা কিংবা হৃদয় কাঁপানো ধ্বনি যখন উঠে আসে কবিতার পরতে পরতে, গল্পের রন্ধ্রে রন্ধ্রেÑ তখন যে কালেরই হোক না কেন, প্রতিটি লেখা হয়ে ওঠে নতুন। ধ্বনি ও ছন্দের ওপর আমীরুল ইসলামের রয়েছে অতিমানবীয় দখল। তিনি ছড়ার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে, গল্পগাথায় ছড়ান শিল্পময় কুশলী অন্তর্জাল। শুধু তাই নয়, স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তÑ এই দুই ছন্দে তিনি ছড়াগুলো নির্মাণ করলেও উপস্থাপনায় বৈচিত্র্যময়তার কারণে ছড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে ফুটে ওঠে রঙিন ছবি এবং কানে বাজতে ঝরা পাতার মোহনীয় সুর। অন্ত্যমিল, মধ্যমিল ও অনুপ্রাসের বিস্ময় এমন সুসম্পন্ন ও সঙ্গত যে, তা এককথায় অভিনব। এদিক দিয়ে আমীরুল ইসলাম ব্যতিক্রম। তার প্রতিটি গল্পই রূপকথার মতো। সাবলীল এবং নির্মেধ। অথচ ভাষাশৈলী নিজস্ব। ছড়ার কথা কী বলব! ফুলঝুরি ছড়ানো এক ছড়াকার তিনি। যখন যেখানে বসেন ছড়া লেখেন। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে তিনি ছড়া লেখেন। তার ছড়ার ভাষা ও ভঙ্গিও অনন্য। পড়লেই বোঝা যায়, আমীরুল ইসলাম হাজির। আমি মনে করি, এই ‘বুঝে যাওয়া’টাই হলো সৃজনক্ষমতা। আমার কোনো বন্ধু এত ছড়া লেখেননি, যত লিখেছেন আমীরুল। এত বিষয়বৈচিত্র্যও কারো নেই, যত আছে আমীরুলের। এত সাবলীলও কেউ নয়, যতটুকু আমীরুল। তার ভাষায়Ñ ‘আমার সামান্য জীবনেতিহাসের ছাপচিত্র পাওয়া যাবে আমার ছড়াসমূহে। ছড়া সময়ের ছবি। চাই আমি চলমান সময়কে বহমান কালের প্রেক্ষাপটে ছড়ার ছন্দে ছন্দে, সুরে সুরে গেঁথে চলেছি।’ আমি নিজেও মনে করি, তার এই প্রবহমান চিরকালের দরজায় টোকা দেয়, সৎ ছড়া সবসময় চিরকালীন। তার ‘চারিত্র লক্ষণযুক্ত ছড়া’ কখনো মৃত্যুবরণ করে না। ছড়া রচনাবলির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি বহু রকমের ছড়া লেখার চেষ্টা করে থাকি। আমার অধিকাংশ ছড়া নিরীক্ষামূলক। ... ছড়ার ভবিষ্যৎ কী, ছড়ার গন্তব্য কোথায়Ñ আমরা কেউ জানি না। তাই নিত্য নতুন ছড়া লেখার চেষ্টা করে যাই। এই যে লেখার চেষ্টা করি, এতেই আমার আনন্দ। ছড়াগুলো চরিত্রবান ছড়া হয়ে ওঠে কি না সে আমি জানি না।’ আমীরুল ইসলামের ছড়া চরিত্রবান কি না কালের কাছেই বিচার্য থাক। কিন্তু তার ছড়ার ‘সংখ্যাধিক্য’ আমার মনোযোগের জায়গা। অনেকে যদিও বলেন, ‘সংখ্যাধিক্যের কারণে গুণগত মান রক্ষা হয় না’, কিন্তু সেই সংখ্যাধিক্যের ভেতরে অনেক ‘অমূল্য রতন’ যে ছড়িয়ে আছে সে কথা বলতে দ্বিধা কোথায়? কারণ আমীরুল ইসলামের কিছু লেখা আছে যা পড়লে বুকের ভেতরে হুহু করে ঝড় বয়ে যায়। মনের গহিনে ছড়িয়ে যায় শারদসন্ধ্যার উদাসী বাতাস। এ যেন এক হিমেল কাঁপুনি। তার ছড়া পড়ে কান পেতে গান শুনি ঘাসেদের। বৃষ্টি ভেজা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে থাকি। মনের রঙের সঙ্গে মেলাই রংধনুর রংকে। আমি মনে করি, একজীবনে এমন একজন লেখক-বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্যের। যে নাকি অবিরাম স্বপ্ন ফেরি করে ছড়ার ছন্দে ছন্দে, সুরে সুরে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App