×

জাতীয়

জালিয়াত চক্রের টার্গেট উচ্চ আদালত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২১, ০৯:১১ এএম

ভুয়া এফআইআর, চার্জশিট, জব্দ তালিকা দেয়া হয়। জালিয়াতির ৬০ মামলা বিচারাধীন। জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট বিচারপ্রার্থীদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। দেশের অন্যান্য আদালতের মতো জালিয়াত চক্রের টার্গেটে এই বিচারাঙ্গন। নানা উপায়ে জালিয়াতি করছে একটি চক্রটি। তথ্য গোপন ও নথি জালিয়াতি করে উচ্চ ও নিম্ন আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে আসামিরা। জালিয়াতি বন্ধে সুপ্রিম কোর্ট থেকে বিভিন্ন সময় নির্দেশনাসহ একাধিক মামলাও হয়েছে। কিন্তু এরপরও থামছে না জালিয়াতি। উচ্চ ও নিম্ন সব আদালতে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা জরুরি বলে মন্তব্য আদালতসহ সংশ্লিষ্টদের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত কয়েক মাসে হাইকোর্টে জালিয়ালি, তথ্য গোপোন করে জামিন নেয়া, অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযানের ঘটনা ঘটেছে। জামিন নেয়ার ক্ষেত্রে ভুয়া এফআইআর, চার্জশিট ও জব্দ তালিকা দাখিল করা হচ্ছে। অভিযোগের গুরুত্ব কমিয়ে তৈরি করা কাগজপত্র দেখিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করে রায় পক্ষে নেয়া হচ্ছে।

আইনজীবী ও আদালত সূত্রে জানা যায়, এসব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে একাধিক চক্র। জামিন আদেশের কপি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এর আগে ফৌজদারি মিস শাখার জমাদার মঞ্জু রানী কৈরীকে বরখাস্ত করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এরপর কিছুদিন জামিন জালিয়াতির ঘটনা থেমে ছিল। সম্প্রতি আবারো বেশ কয়েকটি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে।

অনুসন্ধান করে জানা যায়, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের নাম উল্লেখ করে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জামিন পান আমিনুর ইসলামসহ ৩০ আসামি। কিন্তু ওই দিন এই কোর্ট থেকে এমন কোনো জামিন আদেশ হয়নি। এমনকি সেখানে আইনজীবীদের যে নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেটির সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। যুবলীগ নেতাসহ জালিয়াতি করে বগুড়ায় ৩০ আসামি জামিন নিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রতিবেদন না দেয়ায় বগুড়া চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে (সিজিএম) গত ১৬ মার্চ শোকজ করে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। এর আগে জামিন জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

এ সময় আদালত বলেন, হাইকোর্টের আদেশ জাল হচ্ছে, নিম্ন আদালতের স্বাক্ষর জাল হচ্ছে। নিম্ন আদালতের আদেশ টেম্পারিং করে আমাদের কাছে আনছে। আপিল বিভাগের এখানেও হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। এ ধরনের কাজে যারা যুক্ত তাদের খুঁজে বের করা জরুরি। যাতে পরবর্তী সময় আর এ রকম ঘটনা না ঘটে।

প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের মামলায় চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি নিম্ন আদালতে কামরুলের জামিন আবেদন নামঞ্জুর হয়। পরে তিনি হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে জামিন আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ হয়। এ তথ্য গোপন করে নি¤œ আদালতের জামিন নামঞ্জুরের একই আদেশ দেখিয়ে ১৫ মার্চ বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে জামিন আবেদন করে আসামিপক্ষ। তথ্য গোপনের বিষয়টি নজরে এলে ওই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোনো আদালতে জামিন আবেদন করতে পারবেন না বলে আদেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এ আদালতে কামরুলের আইনজীবী দুই মাস জামিন আবেদন পরিচালনা করতে পারবেন না বলেও সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।

মাদক মামলার আসামি সফিউল্লাহ খান ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। জামিননামা আদেশ নি¤œ আদালতে (গোপালগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত) পাঠানো হয়। এরপর আসামি শফিউল্লাহ খানের জামিননামা দাখিল করলে তা গ্রহণ করা হয়। এ সময় আদালতের দৃষ্টিতে আসে, আসামির দখল থেকে ২২০০ পিস ইয়াবা উদ্ধারের অভিযোগ থাকলেও হাইকোর্টের আদেশে ২২ পিস ইয়াবা উদ্ধারের কথা রয়েছে। এরপর গোপালগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে অবহিত করেন। রেজিস্ট্রার জেনারেল বিষয়টি সংশ্লিষ্ট জামিন দেয়া বিচারপতিদের অবহিত করেন। পরে আদালত জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার জন্য নির্দেশ দেন।

সূত্র জানায়, হাইকোর্টের নির্দেশে নথি ও জামিন জালিয়াতির ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৬০টির মতো মামলা করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এর মধ্যে ফৌজদারি বিবিধ শাখা থেকে ৩৯টি, রিট শাখা থেকে ৯টি, ফৌজদারি আপিল শাখা থেকে ২টি এবং অন্যান্য শাখা থেকে ১০টি মামলা করা হয়। এসব মামলা তদন্ত ও বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া গত বছরের নভেম্বরে প্রতারণার মাধ্যমে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়ার ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, গোপালগঞ্জ আদালতের চার কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে পৃথক ২টি মামলা করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। শাহবাগ থানায় মামলা ২টি করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলাগুলো ঝুলে আছে বিচারিক আদালতে, নিষ্পত্তি খুবই কম।

এর আগে গত বছরের ১৬ আগস্ট উচ্চ আদালতের বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে হাইকোর্ট বিভাগের এফিডেভিট শাখায় আকস্মিক অভিযান চালান আপিল বিভাগের এক বিচারপতি। এ সময় আইনজীবীদের সহকারী, হলফনামাকারী, তদবিরকারীসহ ৪৩ জনকে শাখার ভেতরে পেলে তাদের এক জায়গায় জড়ো করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অনুমতি ও নিয়মশৃঙ্খলা না মেনে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এফিডেভিট শাখায় অবস্থান করায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দস কাজল ভোরের কাগজকে বলেন, জামিন জালিয়াতি, নথি জালিয়াতিসহ বেশ কিছু পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে যেটা আইন অঙ্গকে কলুষিত করে। এতে আইনজীবীরা যেমন তাদের ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত হয় তেমনি বিচারপ্রার্থীরাও নানা রকম বঞ্চনার শিকার হন। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের জন্য আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ওই আইনজীবী বলেন, জালিয়াতি যারা করেন তারা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এটা করে থাকেন। বারের পক্ষ থেকে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার- জালিয়াতির ঘটনায় কোনো ছাড় দেয়া হবে না।

জালিয়াতি প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সম্প্রতি উচ্চ আদালতে জালিয়াতির খবর উঠে আসছে, যা আইন অঙ্গনের জন্য উদ্বেগের। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। তা না হলে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App