×

মুক্তচিন্তা

হেফাজত এবং নেপথ্যে উচ্চারিত পক্ষ-বিপক্ষ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২১, ১২:১৩ এএম

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গুলিতে নিহত ও ভাঙচুরের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে হেফাজতে ইসলাম। ৩০ মার্চ জামিয়া ইউনুছিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতে ইসলামের জেলার সাধারণ সম্পাদক মুফতি মোবারক উল্লাহ বলেন, হাটহাজারীতে পুলিশের গুলিতে ৪ জন নিহতের ঘটনায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও সভা-সমাবেশ করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। সেখানে পুলিশের গুলিতে ১ জন নিহত হয়। পরদিন স্থানীয় এমপি ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরীর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ মাদ্রাসায় হামলা চালায়। পরে পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ এক হয়ে গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলে ২ জন নিহত হয়। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, এ হামলা না চালালে পরিবেশ উত্তপ্ত হতো না। এ হামলায় মানুষের মনে আঘাত লাগে। মাদ্রাসার প্রতি ভালোবাসার কারণে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পুলিশ, বিজিবি নির্বিচারে তাদের ওপর গুলি চালায়। এর পুরো দায় এমপিকে নিতে হবে। এর সঙ্গে আমরা কোনোভাবেই জড়িত নয়। আমরা মনে করি, তৌহিদী জনতার আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এমপি নিজেই ছাত্রলীগকে দিয়ে এসব ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছেন। হেফাজত নিজেদের পাপহীন বলে দাবি করছে। এবং সেজন্যই তারা বিচার বিভাগীয় তদন্তও দাবি করছে। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিকভাবেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। যেহেতু বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে ভঙচুরের ঘটনা কিংবা অগ্নিকাণ্ডের চিত্র উঠে এসেছে। হেফাজত যেদিন সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের পাপহীন অপরাধহীন বলে দাবি করল, ঠিক পরদিনই রাজধানীর লালবাগ ও চকবাজারের ২টি মাদ্রাসা থেকে ৫৯০টি ছোরা উদ্ধার করল পুলিশ। মাদ্রাসায় ছোরা থাকার কথা নয়, সেখানে ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত থাকার কথা শিক্ষকমণ্ডলীর (হুজুর), সেখানে থাকার কথা কুরআন-হাদিস আর ইসলামী আকিদা শেখার কেতাব। আমি বিশ্বাস করি, সেসব ওই মাদ্রাসাগুলোতে আছে। আবার পাশাপাশি পাওয়া গেছে এই ছোরাগুলোও। অর্থাৎ সেখানেও অবৈধ অস্ত্রগুলো তারা জমা রেখেছেন। তারা তাদের ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী হয়তো বলবেন এগুলো তাদের ‘ঢাল’। দেশ-বিদেশের মানুষও দেখেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় এগুলোর প্রদর্শনী। ছাত্রলীগ-যুবলীগ কিংবা পুলিশের বিরুদ্ধে তারাও প্রদর্শন করেছে মূলত তাদের হাতের লাঠিগুলো। যে লাঠিগুলো মূলত সব হরতালকে একটা জঙ্গিরূপ দিয়ে আতঙ্ক ছড়াতে সহায়তা করেছে। কিন্তু তারা সংবাদ সম্মেলনে এগুলো উচ্চারণ করেনি, বরং তারা বলেছে, তারা আগেভাগে কোনো আক্রমণ করেনি। অর্থাৎ তাদের প্রতিপক্ষ যখন তাদের আক্রমণ করেছে, তখন তারা মরিয়া হয়ে তার উত্তর দিয়েছে। আর সে কারণে খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক, কে বা কারা এই ভাঙচুর কিংবা শহর অশান্ত করার পেছনে কাজ করেছে। এ প্রশ্ন বিভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকেই উঠছে। হরতালের নামে অস্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখেছে সারা বিশ্ব। খুব স্বাভাবিকভাবেই এ চিত্রগুলো দেখার পর আমাদের বিশ্বাস করাটাই উচিত যে, এ তাণ্ডব হেফাজতিদেরই। কিন্তু রাজনৈতিক আলাপ কেন জানি তা বলছে না। সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই জায়গাটাতে প্রধান টার্গেট করা হচ্ছে বিএনপিকে এবং আরো গভীরে গিয়ে যদি আমরা দৃষ্টি দেই, তাহলে দেখা যায় সন্দেহের তীর সরাসরি গিয়ে পড়ছে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর ওপর। ঘুরে ফিরে বলা হচ্ছে বিএনপি এবং জামায়াতই সুযোগ নিয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা ধরে নিলাম তারা সুযোগ নিয়েছে। রাজনীতি তো সুযোগেরই একটা জায়গা। সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। আর সেজন্য হেফাজতের মাধ্যমে সন্ত্রস্ত হওয়া জনপদে বিএনপি তার রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি কাজে লাগাতেই পারে। আবার অন্যদিকে যেহেতু হেফাজত-জামায়াতের দৃশ্যমান বন্ধন না থাকলেও আদর্শগত একটা মিল যে আছে, তা তো অস্বীকার করার নয়। অর্থাৎ দুটো দলই ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে তাদের রাজনীতির প্রভাব ছড়িয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে, সুতরাং তাদের রাজনৈতিক দুঃসময়ে অদৃশ্য সুতায় তারা নিজেদের বাঁধবেই। সে হিসাবে দপ করে জ্বলে ওঠা হেফাজতিদের একটা আন্দোলনে জামায়াত যে সুযোগ পেলে এগিয়ে আসবেই, তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়। বিএনপি এমনিতেই এক ধরনের খোঁড়া হস্তি হয়ে বসে আছে। তারা প্রায়ই বলে থাকে, তারা রাজপথে দাঁড়াতে পারছে না, সরকারের রোষানলের কারণে। অথচ দেখা যায় বিএনপি জনগণের কোনো ইস্যু নিয়ে রাস্তায় আসছে না, জনগণের ইস্যু না থাকায় সরকারও হয়তো সুযোগ বুঝেই তাদের ঝেটিয়ে বিদায় করছে। বামদলগুলো যেখানে তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে মোদি বিরোধিতায় নামল, সেখানে বিএনপি ছিল নিশ্চুপ। এটাও একটা বড় বিস্ময়। ভারত বিরোধিতা যেখানে তাদের রাজনীতির একটা প্রধান ইস্যু সব সময়েই। নেতিবাচক হলেও তাদের রাজনীতির অগ্নিগর্ভ সময়ে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নীরবই থেকেছে। হয়তো ক্ষমতার রাজনীতির কৌশলগত কারণে তারা ভারতকে চটাতে চায়নি, তাই প্রকাশ্যে মাঠেও থাকেনি। কিন্তু যেহেতু মোদিবিরোধী মাঠ উষ্ণ ছিল, সেহেতু বিএনপি প্রকাশ্যে না এসে একটা অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করেছে বলে আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। যদি আওয়ামী লীগের এ দাবি সঠিকও হয়, তাহলে তা হবে বিএনপির রাজনীতির একটা চাতুরিক সফলতা। তর্কের জন্য বলতে পারি, সেজন্য তারা সুযোগ হয়তো নিয়েছেও। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো যেভাবে হেফাজতের তাণ্ডবকে বিএনপি এবং জামায়াতের নামে চিত্রিত করার চেষ্টা চলছে, তাতে মূল ঘটনা অর্থাৎ হেফাজত ক্রমে অন্তরালে চলে যাবে। স্বাধীনতার পক্ষের মানুষগুলো উগ্র মৌলবাদীদের প্রতি তাদের ঘৃণার প্রকাশ ঘটিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্ত্রাসে। উগ্রতার বিপরীতে একটা স্পিরিট বা শক্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু এই জায়গায় যদি বিএনপি এবং জামায়াতকে সুযোগ সন্ধানী হিসেবে না দেখে সন্ত্রাসের নিয়ামক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে মূল খেলোয়াড়রা অন্তরালে থেকে যাবে। এখন থেকে প্রায় ৮ বছর আগে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশের লক্ষ্যটা কী ছিল। সেখানেও তাদের লক্ষ্য ছিল সরকারের পতন। দিনভর রাজধানীতে তাণ্ডব চালানোর পর তারা অবস্থান নেয় শাপলা চত্বরে। সে সময় সরকারবিরোধী শক্তি বিশেষত বিএনপি-জামায়াত তাদের এই দিনভর সন্ত্রাস কিংবা তাণ্ডবে সমর্থন জুগিয়েছিল, সে কথাগুলো সরকারও জানে পাবলিকও জানে। এত কিছু জানার পরও হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক উন্নয়ন হওয়ার অধ্যায়টা সবারই জানা। এটাকে কেউ পজিটিভলি নিয়েছে আবার মৌলবাদবিরোধী মানুষগুলো এদের লাই দেয়াকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। সতর্ক করে দেয়ার কাজটি অনেকেই করেছেন। কিন্তু সতর্ক বার্তাটা কতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তা দেখেছে মানুষ। মোদিবিরোধী আন্দোলন একসময় পৌঁছে গেছে সরকারবিরোধী আন্দোলনে। সত্যি কথা হলো, সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অন্যান্য অনেক দলই আন্দোলন করছে, কিন্তু কেউ কোনো পক্ষই জানমালের ক্ষতিসাধনে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু হেফাজতি আন্দোলনে জানমালের অনেক বড় ধরনের ধ্বংস আমরা দেখলাম। কিন্তু যেভাবে এ ব্যাপারটা ট্যাকল দেয়ার কথা, সেভাবে কি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে? ব্রাহ্মণবাড়িয়া ধ্বংসলীলায় যেমন আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতের নাম উচ্চারণ করছে, ঠিক সেভাবেই হেফাজত আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলে তারাই পারস্পরিক জেদের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন বলে দাবি করছে হেফাজত। এসব অভিযোগের কিছুটা সত্যতাও আসছে পারস্পরিক অভিযোগ থেকে। আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাত্রলীগের জেলার সাবেক সভাপতি মাহমুদুল হক ভূঁইয়া বলেছেন, ‘মাদ্রাসায় হামলা করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেছেন আওয়ামী লীগের জেলার সভাপতি ও সংসদ সদস্য ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী। নিজেদের ওপর চাপ আসবে তাই ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আমাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কাদের কারণে এই শহরে এত মানুষ মারা গেল, কারা তাণ্ডব চালাল তার সঠিক তদন্ত হোক। তাহলেই তাদের মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে।’ বিএনপিও সেই একইরকম অভিযোগও করছে। অভিযোগ যে যেভাবেই করুক না, দেশের গোটা পরিস্থিতি এত নাজুক হওয়ার পেছনে মূলত হেফাজত। অর্থাৎ যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তবে তাদেরকেই নিয়ে আসতে হবে জনগণের কাঠগড়ায়। তা না করে সেই ২০১৩ পরবর্তী অবস্থানের মতো যদি আবারো বাতাবরণ তৈরি করা হয় এবং মূল টার্গেট আড়াল করা হয়, তাহলে হেফাজত যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে আগেও উঠেছিল, যেভাবে ২৬ মার্চও সন্ত্রস্ত রেখেছিল জনপদ, সেভাবেই থাকবে। ভুলে গেলে চলবে না, হেফাজত শুধুই একটা সাধারণ ইসলামিক গ্রুপ নয়, সে দলটি বেড়ে উঠছে দ্রুত। মাত্র ১০/১১ বছরে দেশের ব্যাপক জনগণের মাঝে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে দলটি, বেশকিছু দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ আশকারায় সারাদেশের শহর থেকে গ্রামে এরা চষে বেড়াচ্ছে। ওয়াজ নামের বিনোদনে এরা বিনোদিত করে সাধারণ মানুষগুলোকে টেনে আনছে একেকজন বিনোদনকারীর দিকে, ইসলামের দিকে নয়। এরা বিজ্ঞানের বিপরীতে সুড়সুড় দিচ্ছে, নৃত্য করছে, গাইছে আর একেকজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। ডিজিটাল আইন থেকেও এরা দিব্যি ওয়াজ করে লাখ লাখ মানুষকে উসকে দেয়। একজন মোশতাক কিংবা একজন কিশোর আইনে ফেসে যান, অথচ ডিজিটাল আইন এই ওয়াজওয়ালাদের কিছুই করতে পারে না। আইন কিছু করুক কিংবা না করুক সেই প্রশ্ন উত্থাপন না করে বলা যায়, হেফাজতের পাপ এবারো যদি অন্যের ঘাড়ে চাপানো হয়, তাহলে তারা মাথায় উঠে নৃত্য করবে, আর যার ফলাফল ভোগ করবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, আগামীর দিনগুলোতে।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App