×

জাতীয়

হেফাজতকাণ্ডে হার্ডলাইনে সরকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৫৭ এএম

* সরকারবিরোধী প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা *গ্রেপ্তার হতে পারেন মামুনুলসহ শীর্ষ নেতারা
রাজধানী ঢাকার পুরানা পল্টন, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুরসহ কয়েকটি জেলায় ধারাবাহিকভাবে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে তাণ্ডব ও নৈরাজ্যের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে সরকার। এই সাম্প্রদায়িক উগ্রগোষ্ঠীকে আর কোনো ছাড় না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড কঠোর হাতে মোকাবিলার নির্দেশ এরই মধ্যে দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। প্রধানমন্ত্র্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রবিবার সংসদে এ ব্যাপারে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ ব্রাক্ষণবাড়িয়া গিয়ে নাশকতাকারীদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। সরকারের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও সাংগঠনিকভাবে হেফাজতের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সরব রয়েছে। জ্বালাও পোড়ায়ের ঘটনায় হার্ডলাইনে রয়েছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নজরদারি ও তৎপরতা বাড়িয়েছে গোয়েন্দরাও। হুটহাট করে হেফাজত নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করায় পুলিশে চলছে বাড়তি নজরদারি। এর মধ্যে সোমবার রাতে ঢাকার পল্টন থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ছায়া তদন্ত করছে পুলিশের একাধিক ইউনিট। হেফাজতের প্রকাশ্য তৎপরতা, নেতাদের বক্তব্য এবং গোয়েন্দা তথ্যে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন দাঁড় করাতে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছে- এমন খবরে সতর্ক রয়েছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি ইউনিট। বিশেষ করে বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে কওমিসহ সব মাদ্র্রাসা বন্ধ করতে নির্দেশনা দেয়া হলেও খোলা রয়েছে হেফাজত অনুসারীদের অনেক মাদ্র্রাসা। এসব মাদ্রাসায় চোখ রাখছে গোয়েন্দা-পুলিশ ও র‌্যাব। এই পেক্ষাপটে কওমি মাদ্রাসাসহ সব আবাসিক ও অনাবাসিক মাদ্রাসা অবিলম্বে বন্ধ করতে গতকাল মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল মঙ্গলবার বিকালে বলেছেন, করোনা ভাইরাসের সঙ্গে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অপতৎপরতা প্রতিরোধ করাই এখন সরকারের ‘চ্যালেঞ্জ’। কাদের বলেন, এই মুহূর্তে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলা ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অপতৎপরতা প্রতিরোধ করাই হচ্ছে সরকারের চ্যালেঞ্জ। এ দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি কাজের সুসমন্বয় এবং দলের ঐক্য আরো সুসংহত করা জরুরি কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল জোনের ডিসি সৈয়দ নূরুল ইসলাম গতকাল বলেছেন, পল্টন থানার মামলার তদন্ত চলছে। বায়তুল মোকাররমে হামলায় ঔইদিন যারা প্রকাশ্যে ছিলেন এবং নেপথ্যে থেকে যারা নির্দেশনা দিয়েছেন; তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চলছে। তদন্তে পুরো বিষয় বেড়িয়ে আসবে। পাশাপাশি জড়িতদের আটকে অভিযান চলছে। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত করছে পুলিশ। তিনি আরো বলেন, এজাহারে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। তবে আমরা কোনো পদ বিবেচনায় নেব না। আমরা অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। মামলাটি এখনো ‘প্রি-ম্যাচিউরড’ রয়েছে। আসামিদের প্রকৃত পরিচয়, তারা বর্তমানে কোথায় অবস্থান করছে, ২৬ মার্চ তারা কোথায় ছিল, বায়তুল মোকাররমে সরাসরি উপস্থিত ছিল কিনা, তারা নাশকতার নির্দেশ-উসকানি দিয়েছে কিনা, হামলার অর্থদাতা বা মাস্টারমাইন্ড কিনা- তা শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তারসহ যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তদন্তে নাম এলে হেফাজতের মামুনুল হকসহ একাধিক শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হতে পারেন বলে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ইঙ্গিত করেছেন। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজত ও কতিপয় বাম সংগঠন রাস্তায় নেমে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বিশেষ করে কয়েকটি জেলা টার্গেট করে তারা পুলিশ, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বাসা- অফিসে পরিকল্পিত হামলা করে। আক্রান্ত হয় থানা, ফাঁড়ি, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, ভূমি অফিস, জেলার ডাকবাংলোসহ সংস্কৃতিচর্র্চা কেন্দ্র্র। হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয় গণপরিবহনে। টার্গেট হন গণমাধ্যমকর্মীরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর দিনে এমন নৈরাজ্যের নেপথ্য রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। খোঁজখবর করে হেফাজতের আড়ালে বিএনপি-জামায়াত ও শিবিরের যোগসূত্র পেয়েছে পুলিশ। পল্টন থানায় দায়েরকৃত সোমবারের মামলায় এমন অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ। হেফাজতের হরতালে গাড়ি পোড়ানোর নির্দেশ দিয়ে বিএনপি নেত্রী নিপুণ রায় কারাগারে আছেন। এ অবস্থায় কারা কিভাবে নাশকতায় জড়িত তার খোঁজখবর চলছে। জামায়াত-শিবিরের কারা হেফাজতে মিশে গেছে তার তালিকা প্রস্তুতের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তদন্তে অনেকের নাম এসেছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে আমন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় মেহমান মোদিবিরোধী বিক্ষোভে সরকার বিব্রত হয়েছে। কথিত আন্দোলনের নামে সরকারি সম্পদ নষ্ট করার ঘটনায় সরকার হেফাজতকে আর একচুলও ছাড় দিতে চায় না। হেফাজত ইস্যুতে এ পর্যন্ত দায়েরকৃত মামলার এজাহার নামিয় আসামি ছাড়াও নেপথ্যের সবাইকে আটকে যে কোনো সময় অভিযান জোরদার করা হতে পারে বলে জানা গেছে। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গুজবে কান দিয়ে বা অহেতুক উসকানি সৃষ্টি করে হেফাজত মাদ্রাসার ছাত্রদের মাঠে নামাতে পারে যে কোনো সময়। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় তারা নিজেদের ‘জয়’ দেখে অনেকটা পায়ে পারা দিয়ে মাঠ গরমের চেষ্টা করতে পারে। বিশেষ করে শুক্রবার জুমার নামাজের পর তারা প্রতিবাদের নামে রাজপথ উত্তপ্ত করতে চায়। মোদিবিরোধী বিক্ষোভ বা আন্দোলন এখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিতে যাচ্ছে। এজন্য তারা একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চাইছে। এরইমধ্যে হেফাজতের একাধিক সিনিয়র নেতা তাদের কাজে বাধা দিলে সরকারের পতন ঘটবে বলে একাধিকবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের প্রকাশ্য তৎপরতা ও গোয়েন্দা তথ্য পুলিশসহ আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি ইউনিট সতর্ক রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের কর্মকর্র্তারা বলছেন, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও রয়েল রিসোর্টে নারীসহ হেফাজত নেতা মামুনুল হক অবরুদ্ধের ঘটনায় তারা ফের মাঠ গরমের চেষ্টা করছে। নেতারা গরম বক্তব্য দিয়ে এলেও গোয়েন্দাদের কাছে থাকা প্রমাণ এবং ফাঁস হওয়া একাধিক অডিও কল রেকর্ডের কারণে তারা সুবিধা করতে পারছে না। তবুও তারা সুযোগ খুঁজছে। পল্টনের মামলায় পুলিশের ভাষ্য : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মতিঝিল জোনের সহকারী কমিশনার জাহিদুল ইসলাম গতকাল বিকালে জানান, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। পুরান ঢাকার বাসিন্দা আরিফ-উজ-জামান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন। আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। নাম উল্লেখ করে ১৭ জন ছাড়াও এ মামলার অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা দুই থেকে তিন হাজার। এজাহারে বাদী আরিফ-উজ-জামান বলেছেন, গত ২৬ মার্চ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আমি বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যাই। ফরজ নামাজ শেষে মসজিদের ভেতর কিছু উচ্ছৃঙ্খল, ধর্মান্ধ ব্যক্তিকে জুতা প্রদর্শনসহ বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান দিতে দেখি। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে বাইরে উত্তর গেটের সিঁড়িতে কয়েক হাজার জামায়াত-শিবির, বিএনপি, হেফাজতের উগ্র মৌলবাদী ব্যক্তিদের উচ্ছৃঙ্খল জমায়েত দেখতে পাই। অভিযোগে তিনি আরো বলেন, তাদের স্লোগান ও কথোপকথন থেকে জানতে পারি, হেফাজত ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বে শীর্ষস্থানীয় জামায়াত-শিবির, বিএনপি, হেফাজত নেতারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে দেশি-বিদেশি সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিকে বানচাল করতে ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করেন। এজাহারে বলা হয়েছে, তারা দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রসহ দা, ছোড়া, কুড়াল, কিরিচ, হাতুড়ি, তলোয়ার, বাঁশ, গজারি লাঠি, শাবল ও রিভলভার, পাইপগানসহ অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সাধারণ মুসল্লিদের ওপর হামলা করে। ব্যবসায়ী আরিফ-উজ-জামান অভিযোগ করেন, হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের নির্দেশে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব তার হাতে থাকা লোহার রড দিয়ে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় আঘাত করেন। পরে তিনি আমার ডান হাঁটু পিটিয়ে জখম করেন। এসময় আমি মাটিতে পরে গেলে মাওলানা লোকমান হাকিম ও নাসির উদ্দিন মনির তাদের হাতে থাকা বাঁশের লাঠি দিয়ে আমাকে পিটিয়ে আহত করেন। এক পর্যায়ে মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া তার হাতে থাকা ধারালো কিরিচ দিয়ে আমার মাথার পেছনে আঘাত করেন। পরে নুরুল ইসলাম জিহাদি বাঁশের লাঠি দিয়ে বাম বাহুতে পেটান। এজাহারে বলা হয়, স্থানীয় জনতার শক্ত প্রতিরোধের কারণে হেফাজত নেতাকর্মীরা পিছু হটেন। তারা দুটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। এছাড়া তারা টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদের আশপাশের দোকানে হামলা চালিয়ে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করেন। আসামিরা বায়তুল মোকাররমসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন।  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App