×

মুক্তচিন্তা

এ কে খানের স্বপ্ন ও সাধনা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২১, ১২:১৩ এএম

কী চাকরি ক্ষেত্রে, কী শিল্প-বাণিজ্যে, কী রাজনৈতিক অঙ্গনে আর কী সমাজসেবায় সবটাতেই আবুল কাশেম খান (১৯০৫-১৯৯১), যিনি এ কে খান হিসেবে পরিচিত, ছিলেন আশ্চর্য রকমের প্রতিভাদীপ্ত ও সুপরিকল্পিত। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে স্বল্পকালীন মুন্সেফের চাকরিতে তার ন্যায়পরায়ণতা ও সৎ সাহস, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠায় তার পারদর্শিতা ও অক্লান্ত শ্রম, রাজনৈতিক জীবনে তদানীন্তন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে শিল্পায়নে তার দূরদর্শিতা ও সে বিষয়ে তৎকালীন পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ভূমিকা, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান ও অপূর্ব ত্যাগ স্বীকার এবং সর্বশেষ জীবনের প্রাপ্ত সীমায় এসে মৃত্যুর একদিন পূর্বে নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য সংস্থার লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্ম ও জনকল্যাণে উইল করে যাওয়ার বিষয়টি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে গল্পের মতোই শোনাবে। মরহুম এ কে খানের সঙ্গে আর দশজন রাজনীতিবিদ সমাজসেবীর মধ্যে পার্থক্য এখানেই যে তিনি ব্যষ্টির কল্যাণে নয়, সমষ্টির তথা গোটা দেশ ও জাতির কল্যাণে তার সমগ্র জীবনটাকে উৎসর্গ করে গেছেন। এ কে খানের চিত্ত ও বিত্তের সমন্বয় সাধিত হয়েছিল। তাই দেখা যায়, তিনি যথেষ্ট বিত্তের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও চিত্তের ঔদার্য, রুচিবোধ, সত্যনিষ্ঠা ও জ্ঞান স্পৃহাকে বিসর্জন দেননি কিংবা কোনো রকম অসততা, উদ্ধত্য বা উচ্ছৃঙ্খলকে প্রশ্রয় দেননি। তার জীবনের বিরল অবসর কেটেছে জ্ঞান চর্চায় ও বাগান চর্চায়। তিনি বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মুসলমানদের জন্য আলাদা স্বাধীন আবাসভূমির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি, এজন্য ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ এবং ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন এ কে খান। তৎকালে চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের কার্যকরী কমিটির সদস্য এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে ভারতীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন, তবে কায়েদে আজমের নির্দেশে তাতে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আইনসভার সদস্য হন। এ কে খান ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের মন্ত্রিসভায় যোগদান এবং শিল্প, পূর্ত, সেচ, বিদ্যুৎ ও খনিজ বিভাগের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন এবং ১৯৬২ সালে পদত্যাগ করেন। ১৯৬২ সালের সংবিধান রচনা ও মূল্যায়নে তার অবদান রয়েছে। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বিরোধীদলীয় সদস্য। বিদ্যুৎমন্ত্রী হিসেবে তার সময়ে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদন। শিল্পমন্ত্রী হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বস্ত্র ও পাট শিল্পের দ্রুত প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ এবং দেশের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণের প্রয়াসী ছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানা, কর্ণফুলী রেয়নমিল স্থাপন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানেও অনুরূপ শিল্প প্রতিষ্ঠা। দেশের প্রতি জেলায় শিল্প এলাকা প্রতিষ্ঠা করে স্থানীয় পুঁজি ও শ্রমিক আকর্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং ছোট ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তৎকালীন সরকারের বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এ কে খান। এ কে খান ঢাকায় পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনের প্রস্তাব প্রদান করেন, যাতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এখানে বসতে পারে এবং অধিবেশনকালে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ এখানে চলতে পারে। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় শেরেবাংলা নগর স্থাপিত হয়। মন্ত্রী থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তান শিল্প গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা, বন শিল্প করপোরেশন ও পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক স্থাপিত হয়। এক পর্যায়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার সংকট নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানের আশায় এয়ার মার্শাল আসগর খানের তেহরিকে ইশতেকলাল পার্টিতে যোগদান করেন এ কে খান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দান করেন। চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বহির্বিশ্বের উদ্দেশ্যে পাঠের জন্য ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রণয়ন করেন, যা মেজর জিয়ার (শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া) কণ্ঠে ঘোষিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশত্যাগ এবং মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদান। এ দেশের শিল্প-বাণিজ্য প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ। প্রথম ব্যবসার ক্ষেত্রে শ্বশুরের সহযোগিতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বার্মাগামী আরাকান রোডের অংশবিশেষ নির্মাণই তার প্রথম ব্যবসাগত উদ্যোগ। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববঙ্গ শিল্প-বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত এবং কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আমলে অবাঙালিদের হাতে শিল্প কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। এ অবস্থায় এ কে খান এ দেশের শিল্পায়নে প্রথম বাঙালি মুসলমান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে তার প্রথম কারখানা এ কে খান ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয়। ক্রমান্বয়ে অন্যান্য শিল্প স্থাপন এবং ষাট দশকের দিকে তার অন্যতম বড় শিল্প ‘চট্টগ্রাম টেক্সটাইল মিলস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার শিল্প-কারখানায় শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক আদর্শ স্থানীয়। শ্রমিক অসন্তোষ দূরীকরণের জন্য শিল্পে শ্রমিকদের শেয়ার প্রদানের পক্ষপাতী প্রবক্তা ছিলেন তিনি। বিশেষত তিনি শিল্পোদ্যোক্তা, শ্রমিক ও অর্থ যোগানদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ত্রিমুখী অংশীদারিত্বের কথা বিবেচনা করতেন। বাঙালি মালিকানাধীন প্রথম ব্যাংক ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক (বর্তমান পূবালী ব্যাংক) প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এ কে খানের স্মৃতিচারণে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ সাবেক অর্থমন্ত্রী এম এন হুদা (১৯১৯-১৯৯১) লিখেছেন, ‘ঝগড়াঝাটিতে অতিষ্ঠ হয়ে তারা পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমের তুলনায় দীর্ঘতর ট্যাক্স হলিডেতে রাজি হয়েছেন। এখন বিষয়টি ক্যাবিনেটে যাবে। আমি ঢাকায় এলাম। দেখি এ কে খান সাহেব কার্জন হলে এক মিটিং করছেন; আমি সিøপ দিলাম জরুরি কথা আছে; উনি মিটিং শেষ হলেই আমার সঙ্গে বসলেন। ওকে বললাম কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে দীর্ঘতর ট্যাক্স হলিডের প্রস্তাবে ওরা রাজি হয়েছে এবং সেই মতে কমিটি সুপারিশ করেছে, দুয়েকদিনের পরেই বাজেট ঘোষিত হলো যে, পূর্ব পাকিস্তানে ঞধী ঐড়ষরফধু দীর্ঘতর হবে; পাকিস্তানের জীবনে এ ধরনের সিদ্ধান্ত এটাই প্রথম। আমি তো খুশি হলামই, আমার বান্ধবরা, সচেতন জনসাধারণও। ১৯৬০ সালে চাটগাঁতে পাকিস্তান অর্থনীতি সমিতির এক সম্মেলন হয়। অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেব প্রধান অতিথি, খান সাহেবেরই মেহমান; বিভিন্ন প্রবন্ধ আলোচনায় পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য বিশেষ গুরুত্ব পায়। খান সাহেব প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও তার পুরো সমর্থন ছিল আমাদের সঙ্গে। ঢাকায় আমরা এক প্রেস কনফারেন্স করি, আমাদের জেল-জুলুমের ভয় দেখানো হয়, শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি; আমার দৃঢ় বিশ্বাস, খান সাহেবসহ সব পূর্ব পাকিস্তানি মন্ত্রীই এ ব্যাপারে আইয়ুব খান সাহেবকে ঝুঝিয়েছেন। ১৯৬২ সাল থেকে আমি প্রত্যক্ষভাবে সরকারে জড়িয়ে পড়িÑ প্রথমে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও ১৯৬৫ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী; আর সেই সুবাদে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ, গভর্নর কনফারেন্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সদস্য; আমি এসব সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সব জায়গাতেই গেছি; চাটগাঁয় যখনই গেছি, খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি এবং বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করে বিশেষ উপকৃত হয়েছি। চাটগাঁতে আমার সভা-আলোচনাতে খান সাহেব প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন আমার জন্য তার সস্নেহ সমর্থন ও সহানুভূতি থাকত। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের সরকার চাটগাঁতে বাংলাদেশের প্রথম রপ্তানি মেলা অনুষ্ঠান করে, মেলাটি সবদিক থেকেই সাফল্য অর্জন করে, এই মেলার কাজে জনাব খানের অবদান ছিল অপরিসীম। দেশের উন্নয়নে ও শিল্প উন্নয়নে যারা নিয়োজিত আছেন এবং থাকবেন, তাদের জন্য জনাব খানের জীবন সব সময়ই এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার কাজ করবে।’ শিল্পায়নে ওহফরারফঁধষ ঊহঃবৎঢ়ৎরংব বা ব্যষ্টিক প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আজকাল আন্তর্জাতিক সহযোগিতার যে সুলভ্যতা আমরা লক্ষ্য করছি চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকে তা তত সহজ ছিল না। কিন্তু সেই সময়ে এ কে খানের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন যে দ্রুত শিল্পায়নের মাধ্যমে যদি সমাজকে পরিবর্তন করতে হয় তাহলে পুঁজির সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তিরও একটা ফলপ্রসূ মিলনের প্রয়োজন এবং তার জন্য দরকার বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ কে খানের সব সফল শিল্প স্থাপনার পেছনে এই ভাবনার পরিচয় ছিল। ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক; সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান, এনবিআর। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App