×

জাতীয়

লকডাউন নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২১, ১১:৩৯ এএম

লকডাউন নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আবারো লকডাউন ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এমন খবরে রাজধানী ছাড়তে শুরু করেন সাধারণ মানুষ। সামাজিক দূরত্ব না মেনে গাদাগাদি করে তারা ছুটতে থাকেন গন্তব্যের দিকে। ছবিটি ৩ এপ্রিল রাজধানীর মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে তোলা -ভোরের কাগজ

লকডাউন নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’

ফাইল ছবি

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল শনিবার সকালে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, করোনার বিরাজমান পরিস্থিতিতে সরকার আগামীকাল সোমবার থেকে সারাদেশে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সন্ধ্যার মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিস্তারিত জানাবে। এরপর দুপুরে প্রায় একই রকম কথা বলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। এতে হুলস্থ‚ল পড়ে যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে। করোনা আতঙ্কের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয় ‘লকডাউন’ আতঙ্ক।

কিন্তু সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে আয়োজিত সচিব সভায় ‘লকডাউন’ হচ্ছে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। এতে জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। এই বিভ্রান্তি দূর করার জন্য মন্ত্রীরা আর কথা বলেননি। এরকম পরিস্থিতিতে আগামীকাল সোমবার থেকে জীবনযাত্রা কেমন হবে তা বুঝতে পারছেন না জনগণ।

গত রাতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন একটি টেলিভিশন চ্যানেলের আলোচনায় যুক্ত হয়ে বলেন, যে ঘোষণাটি দেয়া হবে সেটি লকডাউনও নয় আবার সাধারণ ছুটিও নয়। আমরা মানুষের চলাফেরা একেবারে (পুরোপুরি) সীমিত করে দিতে চাচ্ছি। যাতে মানুষ ঘর থেকে বের না হয়। তিনি বলেন, আমাদের জরুরি সেবা দেয়া এমন সব প্রতিষ্ঠান যেমন- ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস, ফায়ার সার্ভিস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অফিস, সংবাদপত্র এগুলো খোলা থাকবে। লকডাউনের মধ্যে শিল্পকারখানা চালু থাকবে। সেখানে একাধিক শিফট করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিকরা কাজ করবেন। কলকারখানা বন্ধ করে দিলে অধিক সংক্রমিত জেলা থেকে মানুষ বাড়িতে যাবে। এতে ওই সব জেলাতেও সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, দুই মন্ত্রীর এমন ঘোষণার পর গতকাল দিনভর লকডাউনের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। সোমবার থেকে লকডাউনের কথা চিন্তা করে গতকাল দুপুর থেকেই বহু মানুষ গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য বাস-ট্রেন স্টেশন ও নৌ বন্দরে ভিড় জমায়। একই সঙ্গে মুদির দোকানেও কেনাকাটার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে অনেকে। কিন্তু সরকার থেকে কোনো প্রজ্ঞাপনে লকডাউনের কথাউল্লেখ না করায় দেশজুড়ে ‘বিভ্রান্তি’ দেখা দেয়। এ অবস্থায় মানুষ অনেকটা দিশাহীন হয়ে পড়েন।

গতকাল দুপুরের পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লকডাউন ঘোষণার কথা শুনে অনেকেই বেশি পরিমাণ পণ্য কিনে ঘরে ফিরছেন। রাত পর্যন্ত রাজধানীর অন্যতম বড় তিন বাজার মোহাম্মদপুরের টাউন হল, হাতিরপুল ও কারওয়ান বাজারে ক্রেতাদের বাড়তি ভিড় দেখা গেছে। বেশির ভাগ মানুষ সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যÑ চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ও আলু কিনে নিয়েছেন। অনেকেই বলেন, গত শুক্রবার একপ্রস্থ রোজার বাজার করেছেন। লকডাউনের খবর শোনার পর আবার বাড়তি কিছু কিনে রেখেছেন। কারওয়ান বাজারের সরকারি অফিসগুলোতে শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। তারপরও ভিড় অন্যান্য ছুটির দিনের তুলনায় বেশি দেখা গেল। প্রাইভেট কার থামিয়ে অনেকেই কেনাকাটা করছিলেন। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে ব্যস্ত ছিলেন দোকানিরাও।

এদিকে বেড়ে যাওয়া করোনা সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আগামী দুই সপ্তাহের জন্য ‘লকডাউন’ চেয়েছিল। ওই সময়ে অত্যাবশ্যকীয় সেবা ছাড়া সব বন্ধ করে দেয়ার কথাও সরকারকে জানিয়েছিল। এছাড়া সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরদিন ভোর ৬টা পর্যন্ত ‘নাইট কারফিউ’ জারির কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু সরকার লকডাউনের পথে না হেঁটে মধ্যবর্তী কৌশল নিয়েছে। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে সচিবদের সভায় যেসব সিদ্ধান্ত নেয় হয় সেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সব প্রস্তাব মানা হয়নি। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আগে যে ১৮ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ায় সিদ্ধান্ত হয়েছে ওই সভায়। সভা সূত্র জানিয়েছে, আগামীকাল সোমবার থেকে দেশে ৭ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে রাত ৮টা থেকে পরদিন ভোর ৬টা পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হবে। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, সচিবরা ‘লকডাউন’ নয়, শর্ত সাপেক্ষে সার্বিক কার্যাবলি সম্পাদন এবং জনসাধারণের চলাচলে কঠোর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব করেছেন। যাত্রীবাহী ট্রেন, লঞ্চ ও বিমান চলাচল বন্ধের কথা স্ব স্ব দপ্তর থেকে জানানো হলেও সচিবদের সভায় গণপরিবহনকে সীমিত আকারে চলাচল করার কথা বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরও করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ‘লকডাউন’ শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার না করে ‘সাধারণ ছুটি’র কথা জানিয়েছিল। আর এবার ‘লকডাউনের’ পরিবর্তে সরকার মানুষের চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনার কথা বলছে। তবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত আকারে চালু থাকবে। শিফট করে পোশাক কারখানাও চলবে। সূত্র আরো জানিয়েছে, চলাচলে নিষেধাজ্ঞাকালে এক জেলা হতে অন্য জেলায় জনসাধারণের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। প্রতিটি জেলায় ঢোকা ও বের হওয়ার পথে চেকপোস্টের ব্যবস্থা রাখা হবে। জেলা প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্যে জনসাধারণের চলাচলে এই নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, রাতে সচিবদের এই সভার পর মন্ত্রীদের বলা ‘লকডাউন’ কার্যত আর থাকছে না। অনেকেই বলেন, সকালে সরকারের দুই মন্ত্রী এমনভাবে না বললে, মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি দেখা যেত না। মানুষজনও বাজারেও গিয়ে নিত্যপণ্য কেনার জন্য ভিড় করতেন না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সচিবদের সভার প্রস্তাব গতকাল রাতেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে আজ রবিবার সকালের দিকে ঘোষণা আসতে পারে- লকডাউন হবে কি হবে না।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ) শেখ রফিকুল ইসলাম শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, লকডাউন ঘোষণার প্রস্তাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি অনুমোদন দিলে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। তিনি আরো বলেন, এর আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের (খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম) সভাপতিত্বে এ বিষয়ে একটি ভার্চুয়াল সভা হয়। মুখ্য সচিব, সংশ্লিষ্ট সিনিয়র সচিব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ অনেকেই এই মিটিংয়ে যুক্ত ছিলেন।

এদিকে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতি হওয়ায় আগামীকাল সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য মালবাহী ছাড়া যাত্রীবাহী সব ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। হঠাৎ করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতির কারণে গত ৪ দিন ধরে ১০৪টি আন্তঃনগর ট্রেনসহ সব যাত্রীবাহী ট্রেনে ৫০ শতাংশ যাত্রী চলাচল করছে। কাউন্টার ও অনলাইনে ৫০ শতাংশ টিকেটই বিক্রি হচ্ছে। গতকাল শনিবার বিকালে রেলমন্ত্রী বলেন, আগের মতো সব যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে মালবাহী ট্রেন চলাচল করবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে শুধু ত্রাণ কিংবা যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষ ট্রেন চালানো হবে। এজন্য বিশেষ ট্রেন প্রস্তুত রাখা হবে।

আর বিআইডবিøউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক গণমাধ্যমকে বলেন, সোমবার সকাল ৬টা থেকে সারাদেশের সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান বন্ধ থাকবে। তবে মালবাহী জাহাজ চলাচল করবে। এদিকে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলও আগামীকাল সোমবার থেকে বন্ধ থাকবে। তবে আন্তর্জাতিক পথে নিয়মিত বিমান চলাচল করবে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, যেহেতু সারাদেশে এক সপ্তাহ লকডাউন থাকবে, এ জন্য অভ্যন্তরীণ পথে বিমান চলাচলও বন্ধ থাকবে। তবে আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল করবে। তিনি জানান, সরকারের লকডাউনসংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে এটি করা হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী সময়ে অভ্যন্তরীণ পথে বিমান চলাচল আবার চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, করোনা সংক্রমণ বাড়ায় গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। ওই সময় সব অফিস আদালত, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারাদেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ছুটির মধ্যে সব কিছু বন্ধ থাকার সেই পরিস্থিতি ‘লকডাউন’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এর আগে দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিতের পর গত বছরের মার্চের শুরুতে রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগ এলাকা প্রথম ‘লকডাউন’ করা হয়েছিল। সাধারণ ছুটির পরও এলাকাভিত্তিক লকডাউনের অংশ হিসেবে দুই থেকে তিন সপ্তাহ অবরুদ্ধ রাখা হয়েছিল ঢাকার রাজাবাজার ও ওয়ারীসহ কয়েকটি এলাকা।

মাঝখানে ২-৩ মাস সংক্রমণের ধারা নিম্নমুখী থাকার পর কয়েক দিন ধরে তা ফের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় গত ২৯ মার্চ জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব অফিস ও কারখানা অর্ধেক জনবল দিয়ে পরিচালনা, উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা, জনসমাগম সীমিত করা, গণপরিবহনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনসহ ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার। এরপর গতকাল সকালে ফের লকডাউনের আভাস দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App