×

জাতীয়

ভারত-পাকিস্তানে তৈরি হচ্ছে ভেন্টিলেটর, বাংলাদেশ পারল না কেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৫১ এএম

২০২০ সালের শুরুতে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি দেখা দেয়ার পর জরুরিভাবে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বা ভেন্টিলেটর মেশিন তৈরিতে উঠেপড়ে লাগে বিভিন্ন দেশ। এ প্রচেষ্টায় গত এক বছরে অনেক দেশই সফল হয়েছে। ভারত এখন প্রতি মাসে দেড় হাজার ও পাকিস্তান ৩০০ ভেন্টিলেটর তৈরি করছে। তাদের হাসপাতালগুলোতে সেসব যন্ত্র ব্যবহারও হচ্ছে। অথচ সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসেও ভেন্টিলেটর তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়া ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এমন অবস্থা হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

গত বছরের ২৮ এপ্রিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে দেশে খুব শিগগিরই ভেন্টিলেটর উৎপাদন শুরু হবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন। তিনি শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের তিন মডেলের প্রোটোটাইপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উদ্বোধন করেন তখন। সে সময় আরো অন্তত ১৮টি উদ্যোগ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে ছিল। এর মধ্যে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি), মিনিস্টার হাইটেক পার্ক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ শিল্পকারিগরি সহায়তা কেন্দ্রসহ অনেক প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ব্যক্তির তৈরি প্রটোটাইপ কারিগরি বিবেচনায় প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও যায় অনেক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ-ই উৎপাদনে যেতে পারেনি।

এদিকে গত বছর ভারত সরকারও ভেন্টিলেটর তৈরিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগকে একটি প্ল্যাটফর্মে এনে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দিতে শুরু করে সরকার। এ জন্য ৩৬টি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালু করা হয়। যেখানে যন্ত্রটি তৈরি করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের নানা সুবিধা অসুবিধার কথা আলোচনা হতো। আর যে কোনো সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে জরুরিভিত্তিতে সব সহায়তা দেয়া হতো। ভারতের পত্রিকা ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসে প্রকাশিত (৫ আগস্ট ২০২০) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ কারণে

মাত্র ৬ মাসের মধ্যে দেশটি নিজের দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভেন্টিলেটর রপ্তানির করার অবস্থায় চলে আসে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব রাজেশ ভূষণ রায়কে উদ্ধৃত করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির ৯৬ শতাংশ

মার্কেট শেয়ার দখল করে আছে নিজস্ব ভেন্টিলেটর। দেশীয় ভেন্টিলেটরের দামও অনেক কম। যেখানে আমদানিকৃত ভেন্টিলেটরের দাম ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা, সেখানে মাত্র দেড় থেকে ৪ লাখ টাকার মধ্যে দেশীয় ভেন্টিলেটর তৈরি করে তারা। তথ্যমতে, ভারত মাসে এখন দেড় হাজার ইউনিট ভেন্টিলেটর তৈরি করছে।

অন্যদিকে পাকিস্তানে ভেন্টিলেটর তৈরির গল্পও একইরকম। ২০২০ সালের ৬ জুলাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এজেন্সির কাছে ১০০টির বেশি ভেন্টিলেটর মেশিন হস্তান্তর করেন, যেগুলো পাকিস্তানেই তৈরি। ভয়েস অব আমেরিকার সাউথ এন্ড কারেন্ট এশিয়া বিভাগে প্রকাশিত ওই দিনের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হরিপুরের একটি কারখানায় ‘সেইফভেন্ট এসপি১০০’ নামে এসব ভেন্টিলেটর তৈরি হয়। মাসে এখন কারখানাটি ৩০০ ভেন্টিলেটর তৈরি করছে। এটির উৎপাদন খরচও খুব কম। বাংলাদেশ কেন পারেনি এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে গত শুক্রবার প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভেন্টিলেটর তৈরি ও আরএন্ডডি নিয়ে আইসিটি বিভাগ মূলত বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছে। সহায়তা করেছে অন্যান্য ক্ষেত্রেও। কিন্তু হাসপাতালে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার এখতিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের। এছাড়া বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে যন্ত্রাংশ আমদানি, কর সুবিধা, স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিটেক অর্জন, বিনিয়োগসহ অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সংশ্লিষ্ট। অন্য দেশগুলো একই প্ল্যাটফর্ম থেকে এসব সমন্বয় করেছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, দ্রুততার সঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন অফিস ঘুরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় উৎসাহ হারিয়েছেন উদ্যোক্তারা। আবার মাঝখানে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কারণেও বিষয়টি গুরুত্ব হারায়।

এ প্রসঙ্গে মিনিস্টার হাইটেক পার্কের পরিচালক প্রকৌশলী মনিরুল হাসান স্বপন বলেন, আমরা অনেক দূর এগিয়েছিলাম। এমআইএসটির ল্যাব থেকে পরীক্ষা করিয়েছি। টুকটাক কারেকশন ছিল। সেগুলো ঠিক করা হয়। টানা ৭ দিন প্রোটেটাইপগুলো চালাই। এরপর আমাদের মতো করে কয়েকটি হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও দিয়েছি। সব ফলাফল ভালো ছিল। কিন্তু সরকারিভাবে অথরাইজড করা একটি হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দিতে গিয়ে আটকে যাই। কারণ, এর কোনো ক্রাইটেরিয়া বা নির্ণয় পদ্ধতি তাদের ঠিক করে দেয়া হয়নি। কোন পদ্ধতিতে এটাকে অনুমোদন দেয়া হবে সেটাও জানে না তারা। সে কারণে আমরা আর এগোতে পারিনি। অনেক বিনিয়োগ করেও দেশের প্রয়োজনে ভূমিকা রাখতে না পেরে তারা হতাশ বলে মন্তব্য করেন মনিরুল হাসান।

করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে ভেন্টিলেটরের সংকটের মধ্যে গত মার্চে বিশ্বখ্যাত মেডিকেল পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেডট্রনিক্স তাদের পিবি-৫৬০ মডেলের ছোট এক ধরনের ভেন্টিলেটরের নকশা, সফটওয়্যারসহ স্বত্ব উন্মুক্ত করে দেয়। তখন বিভিন্ন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ও গবেষক বিচ্ছিন্নভাবে ভেন্টিলেটর তৈরির চেষ্টা শুরু করেন। একপর্যায়ে সরকারের এটুআই ইনোভেশন ল্যাব বিষয়টিকে সমন্বয়ের চেষ্টা করে। এর সমন্বয়কারী কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ জুয়েল জানান, তিন স্তর বিশিষ্ট সার্কিট বানানো, কম্পোনেন্ট জোগাড় করা, মোল্ড তৈরি প্রভৃতি সমস্যা অতিক্রম করে দেশে ভেন্টিলেটর উৎপাদন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। এরপর বিষয়টি নিয়ে আমরা আর এগোতে পারিনি। শিগগিরই এ বিষয়ে আবারো অনলাইন বৈঠক করা হবে বলে জানান তিনি।

জুয়েল জানান, ভেন্টিলেটরের প্রোটোটাইপগুলোর মেকানিক্যাল পরীক্ষা করা হয় এমআইএসটির ল্যাবে। সেখানে গ্যাস ফ্লো অ্যানালাইজারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রয়েছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি অনেক প্রোটোটাইপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল। যার মধ্যে ৬-৭টি উদ্যোগ প্রায় চূড়ান্ত হয়। এর মধ্যে এমআইএসটির ইমারজেন্সি ও কনভেনশনাল টাইপ ভেন্টিলেটরও রয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলোও চূড়ান্ত হয়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App