×

মুক্তচিন্তা

উগ্রবাদ দমনে রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৯ এএম

উগ্রবাদ দমনে রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বর্র্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যোগ দেন। নরেন্দ্র মোদির এই সফরের প্রতিবাদে হেফাজত দেশজুড়ে নারকীয় তাণ্ডব চালায়। হেফাজতের নৃশংস তাণ্ডবলীলায় দেশবাসীকে মনে করিয়ে দেয়, ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি জানোয়ারদের আক্রমণের কথা। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হায়েনারা যেভাবে নিরীহ নিরপরাধ মানুষের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পর হেফাজতি মৌলবাদীরা ২৫ মার্চের নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটাল। নরেন্দ্র মোদি এই উপমহাদেশের একজন সাম্প্রদায়িক উগ্র মৌলবাদী নেতা। দুনিয়াজুড়ে মৌলবাদ অশান্তির আগুন জ¦ালায়, তবে মৌলবাদ মৌলবাদকে কখনো আঘাত করে না। হেফাজত যে তাণ্ডতা চালিয়েছে এটা কি তাদের কর্তৃক মোদির বিরোধিতা বলাটা ঠিক হবে না। কারণ হেফাজতি মৌলবাদীরা মোদির আগমনে হরতালের নামে তাণ্ডব চালিয়ে কি প্রমাণ করতে চেয়েছে? তারা কি এ দেশের ইসলাম ধর্মপালনকারী মানুষের ধর্ম রক্ষাকবচ? মোদির আগমনে কি এ দেশের ইসলাম ধর্মপালনকারীদের ধর্মীয় পবিত্রতা নষ্ট হয়ে গেছে? হেফাজত ধর্ম রক্ষা এবং ধর্মের পবিত্রতায় যে কর্মকাণ্ডগুলো করেছে তাতে সাধারণ মানুষের ধর্মের প্রতি আগ্রহটা কমারই কথা। কারণ, ১. মোদির বাংলাদেশ সফরে মাত্র দুয়েক দিন আগে হেফাজতের শীর্ষ নেতা মামুনুল হক হেলিকপ্টার করে বক্তৃতা দিতে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় যান। শাল্লায় হেফাজতি মামুনুল হকের বক্তৃতার পর ওই উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু ধর্মপালনকারী নিরীহ বাঙালিদের ঘরবাড়ি পুড়ে দেয় দুর্বৃত্তরা ধর্ম রক্ষার নামে। এ হামলার কারণ সম্পর্কে শোনা যায়, নোয়াগাঁওয়ে তাণ্ডবলীলা চালায় মৌলবাদীরা প্রতিশোধ নিতে। কারণ এক হিন্দুধর্ম পালনকারীর এফবির স্ট্যাটাস নাকি ধর্মকে অবমাননাকর অবস্থা ফেলেছে, তা উদ্ধার করতে তারা এ হামলা চালায়। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মপালনকারী ব্যক্তি যদি অন্য ধর্মপালনকারীদের অনুভূতিতে আঘাত করে তার দায় কেন সমগ্র ধর্মপালনকারীকে ভোগ করতে হবে? এমন কথা কি কোনো ধর্মে লেখা আছে? কোনো এক ব্যক্তির স্ট্যাটাসে সারা নোয়াগাঁওয়ের মানুষ দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হবে? কেউ নেটের মাধ্যমে অবমাননাকর কিছু প্রচার করলে তার জন্য আইন আছে। সাইবার অপরাধের জন্য সরকার ৫৭ ধারার একটি আইন তৈরি করেছে। এই আইনের আওতায় অপরাধীকে আনা উচিত, কিন্তু তা না করে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে যারা নোয়াগাঁওয়ে হামলা করল তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আরেকটি বিষয় হলো তারা কি আইন অমান্য করে এসব করতে পারে? তাদের নেপথ্যের শক্তির আধারটি কোথায়। তারও অনুসন্ধান করা উচিত। কারণ এ রকম স্ট্যাটাসের কথা বলে হামলা চলেছিল রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় (২০১৬ সালে), গাইবান্ধা, রংপুরসহ অনেক এলাকায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য নিজ হাতে আইন যারা তুলে নিয়ে তাণ্ডব চালাল সেই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়নি। তবে নোয়াগাঁওয়ের ঘটনাটিকে বলা যায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর তাণ্ডবলীলার ড্রেস রিহার্সাল। ২. ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনটিতে আগুন ধরিয়ে দেয় হেফাজতিরা, এই স্টেশনের সঙ্গে মোদির সফরের সম্পর্ক কী? বাংলাদেশের মানুষের করের টাকায় নির্মাণ করা হয়েছিল রেলস্টেশন। এই স্টেশনটি যারা পুড়িয়ে দেয় তাদের মুখে ধর্মীয় ও নৈতিকতা কতটা মানায়! যারা এদের কাছ থেকে ধর্মীয় নৈতিকতার কথা অনুশীলন করেন তারাই বা কতটা নৈতিকভাবে গড়ে উঠছে, সেই বিষয়টিও সরকারের ভাবা উচিত। ৩. ভূমি অফিসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ওই এলাকার জনগণের ভূমিসংক্রান্ত কাগজপত্র, নথি, দলিল ধ্বংস করে ফেলার কারণটা কি? ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হায়েনার দল যখন বুঝতে পারল তাদের পতন অনিবার্য, তখন তারা এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা অনেক সরকারি অফিসের রেকর্ড রুমে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক কাগজপত্র এবং প্রয়োজনীয় ভূমির দলিল পাওয়া যায়নি। ভূমির সঠিক মালিকানা যাচাই করতে সমস্যা সৃষ্টি হয়, এ রকম দলিল না পাওয়ার জন্য। পাকিস্তানিদের ওই জঘন্য কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন দেশের জনগণকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। সঠিক তথ্য এবং দলিল পাকিস্তানিরা পোড়ার কারণে সেই সময় বেড়েছিল ভূমি নিয়ে বিরোধ। এখনো ওই সময়ের দলিল খোয়া যাওয়ার কারণে ভূমি বিরোধ রয়ে গেছে। ভূমি বিরোধের কারণ হচ্ছে মারামারি, এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। এগুলো কি ধর্ম রক্ষা বা ধর্মের পবিত্রতার কাজ? ৪. হাজার বছরের বঙ্গ জনপদের শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার নেতৃত্বে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্ম হয়। বাংলাদেশ জন্ম নেয়ায় ফলে এই জনপদের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজেদের সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচারসহ সব অনুষ্ঠান পালন করতে পারছে। এই মহান নেতার প্রতিকৃতিটি হেফাজতি মৌলবাদীরা মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে ভেঙেছে। এতে কী প্রমাণ হয় তারা মোদিবিরোধী, না বঙ্গবন্ধুবিরোধী? বিশ্ববাসীর কাছে বঙ্গবন্ধু একজন সেক্যুলার নেতা। হেফাজতি মৌলবাদীরা সেক্যুলারদের পছন্দ করে তাই তারা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে ভাঙচুর করেছে। ৫. মোদিবিরোধী আন্দোলন ও হরতালে হেফাজতিরা-মৌলবাদীরা দেশের অনেক শহরের তাণ্ডব চালায়। তাদের তাণ্ডবের মূল টার্গেট ছিল রাষ্ট্র এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সম্পদগুলো ধ্বংস করা। ৬. এবারের হেফাজতি আক্রমণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। হেফাজতিরা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয় মাদ্রাসা আক্রান্ত হয়েছে। এ ঘোষণা শুনে এলাকার লোক এসে তাদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে তাণ্ডবলীলায় অংশ নেয়। এ রকম অপকর্মটি হেফাজতিরা ২০১৬ সালেও করেছিল। মসজিদের মাইক ব্যবহার করে যারা নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হচ্ছে না বিধায় এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ৭. মৌলবাদী হেফাজতি গোষ্ঠী পাকিস্তান সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ। তারা আবহমান কালের বাংলা সংস্কৃতিবিরোধী এবারে হেফাজতিদের নাশকতার মূল টার্গেট হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলাউদ্দিন সংগীত বিদ্যালয়। এ রকম বহু উদাহরণ এখানে দেয়া যাবে, প্রতিটি উদাহরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মৌলবাদী হেফাজতিরা মোদির বিরোধিতা করে নাই তারা করেছে এ দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শুরু হয়েছিল তাদের গাত্রদাহ, এই গাত্রদাহ প্রশমনের জন্য মোদিকে ইস্যু করে তারা নাশকতা চালায়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ১৯৭১ সালে যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তাদের বয়স তো সত্তরের কোঠায় তারা এখন বয়োবৃদ্ধ, তাদের তো নাশকতা চালানোর মতো শারীরিক যোগ্যতা নেই? তাছাড়া জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং ’৭১-এর পরাজিত শক্তির পুনর্জন্মদাতা বিএনপিও তো এখন কোণঠাসা? তাহলে কি করে এই তাণ্ডব হলো। আজকে এই স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধী লালন-পালনের কেন্দ্র পরিণত হয়েছে কিছু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসাসহ সব সরকারি প্রতিষ্ঠান। ধর্মের মোড়কে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি দপ্তরগুলোতে অবাধে চলছে এখন মৌলবাদ চর্চা। আর এভাবেই জন্ম নিচ্ছে পাকিস্তান আদর্শিক নতুন প্রজন্ম। এ ধরনের মৌলবাদ চর্চা হতো না কথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের অংশ পূর্ব বাংলায়। বর্তমানে পাকিস্তান আদর্শ অনুশীলনের চারণভূমি পরিণত হয়ে যাচ্ছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি দপ্তরগুলো। এ রকম উদাহরণ সারাদেশে রয়েছে এ ধরনের অনুপ্রবেশকারীরা প্রকৃতার্থে পাকিস্তান আদর্শ বাস্তবায়নে ব্যস্ত। এরা আবরণটা পাল্টে আওয়ামী লীগ হয়ে নিজেদের স্বার্থ কায়েম করছে। আওয়ামী লীগে এ ধরনের অনুপ্রবেশকারীদের জন্য হেফাজত শক্তিশালী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাণ্ডব ও নাশকতা পুলিশ থামাতে পারেনি, খোদ জেলা প্রশাসকের অফিসসহ এই জেলার প্রশাসন ও জননিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সরকারি দপ্তরগুলো হেফাজতিদের তাণ্ডবীয় লালসার শিকার হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে পুলিশ সূত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, এই জেলায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখের অধিক। এই ১ লাখ দুর্ধর্ষ নাশকতাকারীকে জেলায় কর্মরত পুলিশের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হয়নি। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নয়, সারাদেশে রয়েছে এ রকম মৌলবাদ ও পাকিস্তানি আদর্শিক তৈরির কারখানা। এর ফলে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এভাবে যদি ধর্মীয় আবরণে মৌলবাদ অনুশীলন চলতে থাকে তাহলে একদিন এ দেশ পাকিস্তানি আদর্শের চারণভূমিতে পরিণত হবে। সুতরাং এখনই এর প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। প্রথমত, ক) বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সরকারি অফিসগুলোতে ধর্মের নামে মৌলবাদ অনুশীলন বন্ধ করতে হবে। খ) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে তাই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি থেকে অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানি আদর্শিক মৌলবাদীদের চিহ্নিত করা এবং দল থেকে বের করে দেয়া। গ) মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলাম এমনভাবে তৈরি করা দরকার যাতে করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলার সংস্কৃতি অনুশীলন করে শিক্ষিত হয়। মোদির সফরকে ঘিরে যে নাশকতামূলক তাণ্ডবলীলা চলেছে তা মোদির বিরোধিতা হয়েছে বলা যাবে না। কারণ হেফাজতি মৌলবাদীরা গোষ্ঠী তাণ্ডবতা চালায় ’৭১-এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। এক মৌলবাদী অপর মৌলবাদীর বিরোধী নয়, কথায় আছে, কাক কাকের মাংস খায় না। এবারের হেফাজতিদের তাণ্ডবতায় প্রমাণ হয় যে, তারা মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতেই এই নাশকতা করেছে। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App