×

জাতীয়

সুযোগের অপেক্ষায় জঙ্গিরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৪১ এএম

সুযোগের অপেক্ষায় জঙ্গিরা

প্রতীকী ছবি

দেশে জঙ্গি তৎপরতা দৃশ্যমান না থাকলেও গোপন কার্যক্রম চলছে, এমন আশঙ্কা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবসময় সজাগ রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শুধু র‌্যাবের অভিযানেই বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের ৬৬ জন ধরা পড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি মাদ্রাসায় সম্প্রতি এমন কার্যক্রমের ক্লু পাওয়া গেছে। সেখানে হরকাত-উল-জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) পরিচালিত মাদ্রাসায় কোমলমতি শিশুদের দীক্ষা দেয়ার ইঙ্গিত পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এছাড়া আত্মগোপনে থাকা অনেক জঙ্গি নেতা প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন নেটওয়ার্ক গড়ার চেষ্টা করছে। অনলাইনে সদস্য সংগ্রহের খবরও রয়েছে। কারাগারে থেকেও অনেকে নানা কায়দায় বাইরে যোগাযোগ রাখছে। বিদেশেও রয়েছে নেটওয়ার্ক। সময়-সুযোগের অপেক্ষায় থাকা নিষিদ্ধ ও নতুন নামে পরিচিত একাধিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য সবসময় চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সন্ত্রাসী হামলার হোতা মেজর জিয়া এখনো অধরা। তার সঠিক অবস্থান এখনো জানা যায়নি।

তবে জঙ্গিবাদ দমনে কর্মরত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সন্ত্রাসবাদ দমনে সরকারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের শূন্য সহিষ্ণু নীতিতে অটল রয়েছে। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর থেকেই সাঁড়াশি অভিযানে জনবল হারিয়ে সংগঠনগুলো শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। বড় ধরনের হামলার কোনো সামর্থ্য এখন তাদের নেই। তারা অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে। বিশেষত কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে যখন প্রায় সবাই গৃহবন্দী ছিল। এ সময়টিতে তারা অনলাইনের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে গেছে। কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদ্য বিদায়ী পদস্থ কর্মকর্তা ও বর্তমান এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম বিভিন্ন সময়ই বলেছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জঙ্গিগোষ্ঠীর সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে দিয়েছে। বড় আক্রমণ করার ক্ষমতা তাদের নেই। তবে তাদের লোন উল্ফ টাইপ আক্রমণ (একা আক্রমণ বা ছোট গ্রুপে সংগঠিত) করার ক্ষমতা রয়েছে। তারা অনলাইন প্রচারে জড়িত। দেশে যদি কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তবে আইএসের নামে অনলাইন প্রচার চালানো হয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবদুর রব খান ভোরের গতকাল কাগজকে বলেন, আমরা সম্প্রতি দেশীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটাতে দেখিনি। এতে বোঝা যায় তারা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর সন্ত্রাসবাদ একটি ধারণা, যা রোধ করা গেলেও নির্মূল করা যায় না। এ ধারণা যারা পোষণ করেন, তাদের বিপরীত যুক্তি দিয়ে ধারণা ভাঙতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন কাউন্টার ন্যারেটিভের। যে বিষয়টিতে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি।

আরও পড়ুন...

আন্তর্জাতিক মদতে চাঙ্গা হওয়ার চেষ্টা

কারাগারে বসে জঙ্গি নেটওয়ার্ক তদারকি

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, জঙ্গিরা সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কথাটি ঠিক। আর প্রতিনিয়ত তারা ধরাও পড়ছে। এটি দুভাবেই দেখা যায়। এক. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সচেষ্ট রয়েছে। দুই. তারা সংগঠিত হওয়াসহ টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সময়-সুযোগ বুঝে কোনো ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হতেও পারে। তবে কাউন্টার ন্যারেটিভের কোনো বিকল্প নেই। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই নয়; সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিকসহ সবাইকেই এ ন্যারেটিভের অংশ হতে হবে।

সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ মার্চ রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকা থেকে হুজির অপারেশন উইংয়ের প্রধান মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে মিঠু ওরফে হাসানকে তার দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। অন্য দুজন হলো- শেখ সোহান স্বাদ ওরফে বড় আবদুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবির। এ সময় বান্দরবানের প্রশিক্ষণ শিবিরটির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হন ও এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ ৩ জনের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে হওয়া মামলায় তাদের দুই দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়। তারা এখন কারাগারে রয়েছেন।

আরো জানা গেছে, বান্দরবানের মাদ্রাসাটিতে অভিযান পরিচালনা করে ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী ২৪ শিশুকে উদ্ধার করা হয়। এই শিশুদেরকে তাদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই পার্বত্য এলাকায় শ্রমিকের কাজ করেন। এছাড়া মাদ্রাসার কয়েকটি নথি থেকে ৪০ জনের পরিচয় মিলেছে। গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও তাদের সম্পর্কে তথ্য পেয়েছেন কর্মকর্তারা। ধারণা করা হচ্ছে, এই ৪০ জনের মধ্যে কয়েকজন খুবই সম্প্রতি হুজিতে যোগ দিয়েছেন ও তাদের মধ্যে কয়েকজন ইয়ানত দিয়েছেন।

সিটিটিসি ইউনিটের উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, তারা হুজির অপারেশন উইংয়ের প্রধানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্তারিত তথ্য পেয়েছেন। তবে এই ৪০ জনের জঙ্গি বা অপরাধমূলক কার্যক্রম সম্পর্কে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

সিটিটিসি কর্মকর্তাদের মতে, গ্রেপ্তারকৃত মাইনুল মাদ্রাসার আশপাশের স্থানীয়দের তার মতামত বোঝানোর চেষ্টা করছিল। মাইনুল একটি গণমাধ্যমের পরিচয়পত্র জোগাড় করেছিল। সে এই মিথ্যে পরিচয় ব্যবহার করে হুজির লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করত। গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার পর থেকেই আইন প্রয়োগকারীরা সংস্থা জঙ্গিবাদবিরোধী অনেকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান চালায়। যার মধ্যে প্রায় ৭৯৯ জন নিহতসহ প্রায় আড়াই শতাধিক জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে।

র‌্যাব সূত্র বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৫১ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এর মধ্যে জেএমবির সদস্য রয়েছে ১৩৬ জন, হুজিবির ৪ জন, আল্লাহর দলের ৯৩ জন, হিজবুল মুযাহিদীন ১ জন, হিযবুত তাহরীরের ৬ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ১৭ জন ও আনসার আল ইসলামের ৯৪ জন রয়েছে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত ৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে জেএমবির ২৬ জন, আল্লাহর দলের ৮জন, হিযবুত তাহরীর ১ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ১ জন ও আনসার আল ইসলামের ৩০ জন সদস্য রয়েছে।

র‌্যাব লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশে এখন যে জঙ্গি সংগঠনগুলো সক্রিয় রয়েছে, সেগুলো মূলত আঞ্চলিকভিত্তিক। অর্থাৎ এদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সম্পৃক্ততা নেই। মোট আটটি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তার মধ্যে হুজি রয়েছে। আর পাহাড়ে যে জঙ্গি সংগঠনের বিষয়টি জানা গেছে, তা জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই করা হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যেসব জঙ্গি কাজ করছে, তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। আসলে জঙ্গিবাদ দেশে আর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কা নেই। যারা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে, সংখ্যায় তারা নিতান্তই কম। তাদের সাংগঠনিকভাবে কোনো সক্ষমতা নেই তেমন কিছু করার।

ওই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, যে জঙ্গিরা সম্প্রতি গ্রেপ্তার হচ্ছে, তারা সবাই মূলত স্থানীয় বা আঞ্চলিকভাবে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হয়ে কাজ করছে। এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) অভিযানে গত দুই মাসে ১৪ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে জেএমবির ৩ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পাঁচ জন, আল্লাহর দলের পাঁচজন ও আনসার-আল ইসলামের একজন রয়েছে।

এ বিষয়ে এটিইউর গণমাধ্যম শাখার পুলিশ সুপার মো. আসলাম খান ভোরের কাগজকে বলেন, জঙ্গিদের সেই সক্ষমতা এখন আর নেই। এটিইউসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন অবশিষ্ট যারা রয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করছে। এখন পর্যন্ত দেশীয় ৮টি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাহাদাত-ই আল হিকমাকে ২০০৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, জাগ্রত মুসলিম জনতা, বাংলাদেশ ও জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশকে ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, হুজিবিকে ২০০৫ সালে ১৭ অক্টোবর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে ২০১৫ সালের ২৫ মে, আনসার আল ইসলামকে ২০১৭ সালের ৫ মার্চ এবং আল্লাহর দলকে ২০১৯ সালে ৪ নভেম্বর নিষিদ্ধ করে সরকার।

এদিকে কমপক্ষে ৯টি হত্যার মাস্টারমাইন্ড জিয়া এখনো অধরা। জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী প্রকাশক ও ব্লগার ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মেজর জিয়াসহ ৮ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বুধবার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মুজিবুর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App