×

জাতীয়

কারাগারে বসে জঙ্গি নেটওয়ার্ক তদারকি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৫১ এএম

রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর অভিযানে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে নিহত এবং বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হওয়ায় অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে বাইরে থাকা জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে পড়লেও কারাগারে থাকা শীর্ষ জঙ্গিরা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কঠোর নিরাপত্তার গণ্ডি মাড়িয়ে কারাগারে বসেই জঙ্গি নেটওয়ার্ক তদারকি করছে তারা। এমনকি কারাগারে বসেই নতুন জঙ্গি সদস্যদের নাশকতার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। জামিনে মুক্ত জঙ্গিরা কারাগারে থাকা শীর্ষ নেতাদের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে উঠছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জঙ্গিবাদ যাতে আর কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য কারাবন্দি জঙ্গিদের বিষয়ে নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। পাশাপাশি আইনের দীর্ঘসূত্রতা থেকে বেরিয়ে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করলে হুমকি অনেকটাই কমে আসবে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ৪ মার্চ রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) অপারেশন শাখার প্রধান মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে মিঠু ওরফে হাসান এবং শেখ সোহান স্বাদ ওরফে বারা আব্দুল্লাহসহ ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।

গ্রেপ্তারের পর সিটিটিসি জানায়, তারা কারাগারে আটক ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার জাফর ও ২০০০ সালের কোটালিপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী খানের নির্দেশে সাংগঠনিক কাজ করছিল। পরিকল্পনা ছিল ঢাকা শহরে বড় ধরনের নাশকতা করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মাইনুল ইসলাম ২০১৫ সালে হুজির শীর্ষ নেতা কারাবন্দি মুফতি মঈনউদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিল। সোহান স্বাদ সুনামগঞ্জের বিবিয়ানা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। সে ঢাকায় মিরপুর বাংলা কলেজে পড়ার পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করত। ২০১৬ সালে একুশে বইমেলায় নাশকতার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়। এছাড়া সে ২০১৭ সালে বিস্ফোরক মামলা এবং ২০১৯ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়। জামিনে বের হয়ে সে মাইনুলের নেতৃত্বে হুজির সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করত।

গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উপকণ্ঠ আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকা থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানতে পারে এবিটি সদস্যরা কারাগারে বসেই তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। যোগাযোগ করছে বাইরে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে। আত্মীয় পরিচয় দিয়ে হরহামেশা দেখা করে সাংকেতিক ভাষায় নির্দেশনা আদান-প্রদানও করছে। কারাগারে বন্দি থাকা শীর্ষ জঙ্গিদের বিভিন্ন নির্দেশনা ও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণের বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে অন্যদের।

আরও পড়ুন...

সুযোগের অপেক্ষায় জঙ্গিরা

আন্তর্জাতিক মদতে চাঙ্গা হওয়ার চেষ্টা

২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর হলি আর্টিজানে হামলা মামলার রায়ে সাত জঙ্গির ফাঁসি হয়। সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এজলাস থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান বের হওয়ার সময় আইএসের মনোগ্রামসংবলিত টুপি মাথায় দিয়ে বের হন। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় তারা টুপি কোথায় পেল, তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে সর্বত্র। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে ওই আইএস টুপি কারাগার থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং আইএসপন্থি নব্য জেএমবির নেতৃত্ব ও সব সিদ্ধান্ত কারাগার থেকেই দেয়া হচ্ছে। শুধু আলোচিত এ ঘটনাগুলোই নয়, বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার বিভিন্ন সংগঠনের জঙ্গিরা কারাগার থেকে নির্দেশনা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কারাগারগুলোয় এখন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), আনসার আল ইসলাম, হিযবুত তাহরির, হিযবুত তাওহীদ ও হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশসহ আরো কিছু জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা আটক আছে। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জনকে দুর্ধর্ষ জঙ্গি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। দিনে দুবার দেখা হওয়ার সুযোগ ও কাঠামোগত কারণে ইশারায় কথা বলার সুযোগ থাকায় ওই শীর্ষ নেতারাই বাইরের জঙ্গিদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, আইনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে জঙ্গিরা বছরের পর বছর কারাগারেই বন্দি থাকে। বিভিন্ন পন্থায় কারাগার থেকে তারা নিজ নিজ সংগঠনের সদস্যদের বার্তা পাঠানোর খবর প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বাইরের জঙ্গিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃঢ়তায় দুর্বল হয়ে পড়লেও কারাগারে থাকা জঙ্গিরা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও সাক্ষী ও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে জামিনে বের হয়ে কারাগারে থাকা শীর্ষ নেতাদের দেয়া নির্দেশ পালন করছে অনেকে। এই অপতৎপরতা দমনে দ্রুত বিচার কার্যকর করা, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের এ বিষয়ে আরো গুরুত্ব দেয়া এবং কারাগারে সংশোধনাগারের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, কারাগারে যে ব্যবস্থায় জঙ্গিদের রাখা হয়, সেখানে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নতুন জঙ্গি তৈরি হওয়া সম্ভব। যেহেতু জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনায় হাতেগোনা কয়েকজনই যথেষ্ট, সেহেতু কারাগারে বন্দি জঙ্গিরাই বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

সিটিটিসি ইউনিটের উপকমিশনার (ডিসি) সাইফুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার বেশ কয়েকজন জঙ্গির কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে তারা কারাগারে থাকা শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পেত। আবার অনেকে কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে নাশকতায় অংশও নিয়েছে। এটিকে আমরা বড় ধরনের হুমকি মনে করছি না। তবে কারাগারে থেকে যাতে কোনো জঙ্গি তথ্য আদানপ্রদান করতে না পারে, সেদিকে আমাদের নজরদারি রয়েছে।

কারা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, কারাগারের যে সেলে জঙ্গিরা থাকে, সেখানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সেখান থেকে বাইরে বার্তা বা নির্দেশনা পাঠানোর সুযোগ নেই। এরপরও আমরা মাঝেমধ্যে জানতে পারি কারাগার থেকে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। হয়তো আদালতে পাঠানো হলে তখন কোনোভাবে জঙ্গিরা কাজটি করে থাকতে পারে। তবে তারা যাতে কারাগারে থেকে কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে, সেজন্য আমরা তৎপর রয়েছি। পাশাপাশি পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের পরামর্শে তাদেরকে কীভাবে ডিরেডিক্যালাইজেশনের আওতায় আনা যায়, সে বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘কারাগার হবে সংশোধনাগার’-এর আওতায় জঙ্গিদেরকেও আনা সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন কারাপ্রধান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App