×

জাতীয়

বিচারহীনতায় বেপরোয়া উগ্রপন্থিরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৪৭ এএম

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের তাণ্ডব নতুন কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী গোষ্ঠীর হাতে বারবার আগুন ও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে এই জনপদ। হামলা হয়েছে মন্দিরসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে। বেছে বেছে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র। বারবার টার্গেট করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্থাপনা, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাড়ি। দিন দিনে তাণ্ডবের তীব্রতা আরো বাড়ছে।

সর্বশেষ গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চের ঘটনার আগে ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি মাদ্রাসা ছাত্রদের তাণ্ডবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরের বিভিন্ন অফিস পুড়েছিল। এবারো এসব প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়েছে। সঙ্গে আরো বহু প্রতিষ্ঠান পুড়েছে। করা হয়েছে ভাঙচুর।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০১ সালে ফতোয়াবাজি নিয়ে আন্দোলনে মারা যায় ছয়জন। তখন আন্দোলন হলেও এতটা তাণ্ডব হয়নি। কয়েক বছর আগে একটি কনসার্ট আয়োজনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা দিলেও কোনো ধরনের নাশকতা হয়নি। এরপর ২০১৬ সালেও তাণ্ডব ঘটে। ওই ঘটনার ৫ বছর পর এবারের তাণ্ডবে ২৮ মার্চ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৪২টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগপত্রই দেয়নি পুলিশ। এই বিচারহীনতার কারণেই এখানে উগ্রবাদ বাড়ছে। ঘন ঘন দাঙ্গা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, স্থাপনা ভাঙচুর চলছে অবাধে। অপশক্তি এরই মধ্যে বুঝে গেছে, তাণ্ডব করলেও তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ গতকাল বৃহস্পতিবার ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের তাণ্ডবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করেন। পরে সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিং করেন তিনি। এ সময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আগে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার একটিরও বিচার হয়নি, এখানকার মানুষের ধারণা এবারের ঘটনারও বিচার হবে না। বিচারহীনতায় এখানে উগ্রবাদ বাড়ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, প্রতিটি ঘটনার বিচার হওয়া উচিত এবং ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের চিহ্নিত করে প্রত্যেককেই বিচারের আওতায় আনা হবে।

হামলার দিনে ৬ ঘণ্টা প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমরা শুনেছি এবং এর জন্য ঢাকা থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হামলার সময় পুলিশের নীরব থাকার ঘটনা পুলিশের পেশাদারিত্ব প্রমাণ করে না। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন আইজিপি। সেখানে তিনি বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে তাতে অবশ্যই মামলা করা হবে। এমনকি বিচার না হলেও আমি বলব আপনারা মামলা করুন। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ দমন করেছি, এখানে যা হয়েছে এটাও জঙ্গি আক্রমণ থেকে কম নয়। এটাও দমন করব।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারহীনতায় উগ্রবাদ বাড়ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, এটা এখনই বলার সময় আসেনি। এখানে বহুমুখী বিষয় কাজ করছে। সব বিশ্লেষণ করার পর ঠিকঠাক চিত্র পাওয়া যাবে।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আগে আসামি চিহ্নিত করি, তারপরই বলা যাবে এখানে কেন এত তাণ্ডব হয়। আগের ঘটনায় তো বিচার হয়নি, এবারের ঘটনায় কি বিচার হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেন বিচার হবে না, অবশ্যই বিচার হবে। আগের ঘটনারও বিচার হবে, এখনকার ঘটনারও বিচার হবে।

বারবার কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হামলা হচ্ছে, ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে? এই জনপদ কি কোনো অপশক্তির কব্জায় চলে গেছে- এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন স্থানীয়রা। জেলায় ৩২ লাখ লোকের বাস। এরমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের বাসিন্দা ৩ লাখ। জেলাজুড়ে ৫৭৪টি মাদ্রাসা রয়েছে। সব মাদ্রাসায় ১ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এই ১ লাখ শিক্ষার্থীর মাথাপিছু প্রতিদিন গড়ে ১শ টাকা করে খরচ হলে দৈনিক খরচের পরিমাণ ১ কোটি টাকা। মাসে ৩০ কোটি টাকা। এই ৩০ কোটি টাকা এই শহরের মানুষেরই দেয়া। কিন্তু ওই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কাছে কেউই নিরাপদ নন। ঠিক এই তথ্যটি সামনে রেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, সাধারণ মানুষের আর্থিক অনুদানে যারা পড়ালেখা করেন তাদের কর্মসূচিতে এমন নৈরাজ্য কেন? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, এখানকার পুলিশ-প্রশাসন, সমাজপতি ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে উগ্রপন্থিদের সখ্যতা রয়েছে। কারো কারো আবার ব্যবসা রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে ভোটের রাজনীতি। অর্থাৎ প্রতিটি বিষয় এমনভাবে জড়িত- সবাই মনে করেন ‘আমি কথা বললেই স্বার্থহানি ঘটবে’। এজন্য বছর বছর এই জেলায় তাণ্ডবনৃত্য হলেও সবাই থাকেন চুপ।

হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সাজিদুর রহমান জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতির নেতৃত্বে যুবলীগ-ছাত্রলীগের মিছিল জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসায় হামলা করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে তাণ্ডবের সঙ্গে হেফাজতের কেউ জড়িত নয়। তার দাবি, যারা তাণ্ডব করেছে তারা বহিরাগত। প্যান্ট শার্ট অথবা হাফপ্যান্ট পরিহিত; এরা মাথায় হেলমেট লাগিয়ে তাণ্ডব করেছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারও এবারের হামলাকে পূর্ব পরিকল্পিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। এবারের হামলা একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে উল্লেখ করে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, এর আগে ১৯৯৮ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ হামলাকারীদের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। ২০১৬ সালে নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা হয়েছে। ওই ঘটনার চার বছর পার হলেও চার্জশিট দেয়নি পুলিশ। এর কারণ কি- জানতে চান আল মামুন সরকার। তার মতে, সব মিলিয়ে এর আগে যত ঘটনা ঘটেছে তার একটিরও বিচার না হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছে উগ্রবাদীরা। এবারের ঘটনার পরও যদি তাদের বিচার না করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের হামলার আশঙ্কা সরকারদলীয় এই নেতার।

একই অভিযোগ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সোমেশ রঞ্জন রায় ভোরের কাগজকে বলেন, বিচারহীনতার কারণেই এখানে উগ্রবাদ বাড়ছে। তার মতে, এই উগ্রবাদীদের এখানে লালন-পালন করা হয়েছে। স্বার্থের কারণে তাদের মাথায় তোলা হয়েছে। এখন তাদের মাথা থেকে নামানোর ক্ষমতা কারো নেই। এক কথায় তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবারও শহর ঘুরে দেখা গেছে, তাণ্ডবের পর সেবা বন্ধ রয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে। সদর উপজেলা ভ‚মি অফিস পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় বসার জায়গাও সেখানে নেই। সহকারী কমিশনার (ভূমি) এ বি এম মশিউজ্জামান বলেন, অফিসের একটি কাগজও অক্ষত নেই। এখানে জমিসংক্রান্ত অনেক রেকর্ড থাকে। যে কারণে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। আপাতত ওই অফিসের সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।

জেলা পরিষদ ও পৌরসভা থেকেও সেবা দান বন্ধ রয়েছে। ওই দুটি প্রতিষ্ঠানে দিনভর ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়। ২৬ মার্চ তাণ্ডবের পর থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে সব ধরনের ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাতিল করা হলে যাত্রীদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু হোরায়রাহ বলেন, একাত্তরের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে নারকীয় এ তাণ্ডব। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনী যতটুকু না করেছে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের কিছু দোসর তারচেয়েও বেশি তাণ্ডব করেছে। আমরা এর বিচার চাই।

তবে এ বিষয়টি টেনে গতকাল আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যখনই হামলা হয়; তখনই এখানকার রেলওয়ে স্টেশনকে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এর কারণ কি? নিজেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তিনি বলেন, হয়তো জনগণকে শিক্ষা দেয়ার জন্য দুষ্কৃতকারীরা এ পথ বেছে নিয়েছে। তারপরই তিনি বলেন, ভয় পাবেন না। এদের তাণ্ডবে কোনো কোনো অঞ্চল উপদ্রুত হয়ে যাবে- এটা হতে পারে না।

এ সময় পুলিশের আইজিপিকে উদ্দেশ্য করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি বলেন, সেদিনের হামলায় পুলিশ প্রশাসন নীরব ছিল? কেন নীরব ছিল এটা খুঁজে বের করা দরকার। এরকম হামলা হবে শহরে- তা পুলিশ জানত না এটাতো হতে পারে না। প্রয়োজনে গত ছয় মাসে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা হোক।

প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জাভেদ রহিম বিজন বলেন, এখানে আগেও বহু তাণ্ডব হয়েছে। কোনোটির বিচার হয়নি। এবারের তাণ্ডবতো ব্যতিক্রম। আগেরগুলোর বিচার হয়নি। আমরা চাই, অন্তত এ ঘটনার বিচার হোক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্মিলিতি সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আব্দুর নূর বলেন, সরকার চায় না, এজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় বিচারও হয় না। বিচার হলে এ রকম ঘটনা ঘটত না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App