×

সাময়িকী

বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের রূপকার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২১, ১২:১৫ এএম

বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের রূপকার
মফিদুল হক যখন প্রথম শুনতে পেলাম সন্জীদা খাতুনকে ‘দেশিকোত্তম’ সম্মাননায় বরণ করে নেবে বিশ্বভারতী, আশ্চর্য এক শিহরণ ও পুলক আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল মন। আমরা যারা যৌবনে পা রাখার বয়সে পেয়েছি ছায়ানটের সঙ্গে সম্পৃক্তি রচনার অবকাশ, লাভ করেছি তার সান্নিধ্য, স্নেহ ও প্রশ্রয়, সঙ্গীতবিরল ঊষর পাকিস্তানি পরিমণ্ডলে গীতসুধাসাগরের কিনারায় দাঁড়াবার। ঠাঁই, তাদের জন্য সেসব যে ছিল কত বড় পাওয়া বলে বোঝানো দুষ্কর। আজিমপুরের ফ্ল্যাটে প্রবেশের অধিকার অর্জন আমাদের কাছে ছিল সঙ্গীতের ভেতরমহল অবলোকনের অপার সুযোগ, ঝলমলে এক হর্ম্যরে কারুময় স্তম্ভগুলো ঘুরে ঘুরে যেন দেখতে পাই আমরা। অক্লান্তভাবে গান শিখিয়ে চলেন সন্জীদা আপা, আকুতিভরা নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলে অনুষ্ঠানের মহড়া, একই কলি ফিরে ফিরে দেখিয়ে দেন তিনি, বুঝিয়ে দেন সুরের সঠিক ছোঁয়ায় কীভাবে উদ্ভাসিত হতে পারে গানের ভাবসম্পদ। সেসব থাকে আমাদের মতো অশিল্পী কর্মী-যুবাদের বোধের বাইরে, তবে রেশটুকু মনে জাগায় দোলা, বারবার, ফিরে ফিরে। আর যখন তিনি অনির্বচনীয় বাচনভঙ্গিতে বুঝিয়ে বলেন বাণীর মাহাত্ম্য, বাণী ও সুরের কোনো সম্মিলনে কথা হয়ে ওঠে গান, সুর হতে পারে সঙ্গীত, সেই উপলব্ধি আমাদের জানান দেয় গানের ভেতর দিয়ে দেখার রয়েছে আরেক ভুবন। দেখার মতো দৃষ্টি, বোঝার মতো বোধ থাকে আয়ত্তের অতীত, তবে উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না নিত্যকার ক্লিষ্ট পীড়িত জীবনের বাইরে আছে আরেক অবারিত বিশ্ব। সেই অন্তর্মুখিতার সঙ্গে বহির্মুখিতার যোগ নিয়ে চলে। ছায়ানটের পথযাত্রা, গান নিয়ে জাগরণী সাধনা। আমরা হই যাত্রীদলের কনিষ্ঠ সদস্য, কাজের ডাকে সাড়া দিই প্রাণেরই উৎসাহে, অন্তরে অনুভব করতে পারি জানবার, চলবার, লড়বার অন্যতর উপলব্ধি, সঙ্গীতের কিছু হয়তো বুঝি, বেশিরভাগ বুঝি না, তবে শিহরিত হই আশ্চর্য পুলকে, অধরা মাধুরীর কল্যাণস্পর্শে। সেই থেকে চলেছে অব্যাহত পথচলা, মিনু আপার সান্নিধ্যে, স্নেহচ্ছায়ায়। চলেছেন তিনিও, তার যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের মিছিলে স্কুল বালিকা হিসেবে, তারপরে পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় ও পরে শান্তিনিকেতনে শিক্ষণের বিরল সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার দ্বারা। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ ঘিরে পূর্ববাংলা যেন আবার ফিরে পেল নিজেকে, উৎসব আয়োজনের শেষে বড় হয়ে দেখা দিল সংস্কৃতির শক্তিময়তা পুনরাবিস্কারের তাগিদ, যে তাগিদ মেটানোর প্রয়াস থেকে ছায়ানটের জন্ম আর সেই বিশাল স্বপ্নযাত্রার উদ্গাতা যাত্রীদলে। তিনি নিলেন অন্যতম প্রধান ভূমিকা। ক্রমে জন্ম নিল সঙ্গীতবিদ্যায়তন, চলল নানাবিধ সাংস্কৃতিক আয়োজন, সমাজে তা জাগিয়ে তুলছিল অভিনব ও বিস্তৃত অনুরণন। পরিবেশের প্রতিকূলতায় বিদ্যায়তন হয়ে পরে ভাসমান, ঠাঁই বদল করতে হয় বারংবার, আর ছায়ানটের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে আজিমপুরের ফ্ল্যাট, সবার জন্য যে গৃহের দ্বার অবারিত। একই সঙ্গে চলছিল সন্জীদা খাতুনের শিল্পিত জীবনসাধনা, ব্যক্তিগত দুঃখকষ্ট-পীড়ন জয় করে। সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি তিনি নন্দনতত্ত্বের মেলে ধরেন নতুন মাত্রা, তাঁর অনেক অবদানের মতো সেসবও থেকে যায় অলক্ষ্যে। কথা ও সুরের সম্মিলন কী করে তৈরি করে তৃতীয় অর্থ, যা মিলবে না কেবল কথায় কিংবা নিছক সুরে, সেসব রসমণ্ডিত করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি আপন গবেষণাকর্মে ও বিভিন্ন প্রকাশনায়। সেই থেকে ক্রমে তিনি ঝুঁকলেন ধ্বনির মাধুর্য ও রূপানুসন্ধানে, ধ্বনি ও উচ্চারণ কীভাবে অর্থময়তা করে তোলে বাঙ্ময়, ধ্বনি থেকে শব্দ রূপান্তরিত হয় সার্থক কবিতায়, সেসবের নিবিড় গহীন ব্যাখ্যা মেলে তাঁর রচনায়, সাহিত্য রসাস্বাদনে নতুন মাত্রা যোগ করে এসব উপলব্ধি। পাশাপাশি চলছিল সঙ্গীতের অব্যাহত সাধনা, সুরের স্পর্শে সমাজের জাগরণ, মানবিকতার উদ্বোধনের নিরন্তর ও সম্মেলক প্রয়াস। আর সবকিছু ছাপিয়ে চলে নবীন-নবীনাদের গানের পাঠদানের চেষ্টা, অন্তরে শিল্পের বীজ রোপণ, সঙ্গীত-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসারতাদানের চেষ্টা। তাঁর স্নেহচ্ছায়ায় থাকতে পারার সৌভাগ্যে অভ্যস্ত হয়ে সবকিছু এত স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছিলাম যে, তাঁর দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ কখনো ঘটেনি। এখন বিশ্বভারতীর সম্মাননা-সূত্রে তাকাতে গিয়ে উপলব্ধি করি সেই স্নেহবৃক্ষ আমাদের অজান্তে কখন বিশাল মহীরুহে রূপান্তরিত হয়েছে, আমি সেখানে রয়েছি বটে তবে অবারিত সেই ছায়াতলে। আশ্রিতজনের সংখ্যা অগণিত, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে, দেশ ও দেশের বাইরে। সন্জীদা খাতুন সঙ্গীতসাধক, হাজারো শিষ্য-শিষ্যার সঙ্গীতগুরু, সমাজের শিল্পরুচির নির্মাতা, সেই সাথে শিল্পতত্ত্বের উদ্গাতা, সঙ্গীত ব্যাখ্যাকার, রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের অন্যতম প্রধান রূপকার, পঞ্চাশাধিক বছর যাবৎ জাতির সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার সাথী ও সারথি। ভেতর ও বাইরের সম্মিলনে সঙ্গীতে-সংস্কৃতিতে-সমাজে বিপুল বৈভব জোগানো এমন সঙ্গীতব্যক্তিত্ব দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় আর কাউকে পাওয়া যাবে না। যেমন তার পথচলা, তেমনি তার যাত্রাপথের আনন্দগান, আলোকের ঝরনাধারায় সবাইকে স্নাত করে চলছে এই নিরন্তর অভিযাত্রা। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App