×

মুক্তচিন্তা

করোনাকে ‘নিয়ন্ত্রণে রাখা’ আমাদের হাতে!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২১, ১২:১১ এএম

আমি করোনা ভাইরাসের জন্ম, বিস্তার, রোধ, প্রতিরোধ কিংবা আক্রান্ত হলে সেরে ওঠা প্রভৃতি ক্লিনিক্যাল কোনো বিষয় নিয়ে কখনো কোনো কথা বলি না বা লিখি না। কেননা সেটা আমার কাজ নয়, কারণ এ বিষয়ে বলার এবং লেখার জন্য আমি যথার্থ ব্যক্তি নই। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চের ৮ তারিখ বাংলাদেশে যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়, তখন থেকে আমি বেশ কিছু লেখা লিখেছি করোনা সংশ্লিষ্ট এবং করোনা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে, কিন্তু করোনার ক্লিনিক্যাল কোনো দিক দিয়ে আমি কখনো কোনো লেখা লিখিনি। আমি লিখেছি, করোনা সংশ্লিষ্ট প্রত্যায়ন এবং শব্দচয়নগুলো বাংলায় হতে যেমনÑ আইসোলেশন না বলে বিচ্ছিন্নকরণ, সোশ্যাল ডিসট্যান্স না বলে সামাজিক দূরত্ব (প্রকৃতার্থে শারীরিক দূরত্ব), মাস্ক না বলে মুখবন্ধনী, স্যানিটাইজ করা না বলে জীবাণুুমুক্তকরণ, লকডাউন না বলে বন্ধকরণ এবং কোয়ারেন্টাইন না বলে সঙ্গরোধ প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছি। আবার করোনার সংক্রমণ রক্ষার্থে ‘স্টে অ্যাট হোম’ বা ঘরে থাকার প্রেসক্রিপশন নিয়েও শ্রেণির দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বিশ্লেষণী লেখালেখি ও আলোচনা করেছি, কারণ ‘ঘরে থাকতে বলা’ সমাজের নীচু তলার মানুষের জন্য খানিকটা শাস্তিস্বরূপ, কেননা যারা বস্তিতে থাকে কিংবা কোনোরকমে একটা ‘মাথা গোঁজার ঠাঁই’ করে জীবনযাপন করে, তাদের জন্য বেশ কষ্টদায়ক। কারণ তাদের জন্য ‘ঘরের চেয়ে বাইরে’ শ্রেয়। এছাড়া ২০২০ সালের জুন-আগস্ট পর্যন্ত করোনা কীভাবে সামাজিক সম্পর্কের নতুন ধরন ও মাত্রা নির্মাণ করছে তা নিয়ে একটা গবেষণার কাজ করেছি। প্রায় ১০০ জন তথ্যদাতার দেয়া তথ্য অনুযায়ী চমৎকার কিছু ফল আমার গবেষণায় বের হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরো উচ্চতর গবেষণার খোরাক জোগাবে। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক একটি স্টাডি সার্কেল আছে, বিবর্ত পাঠচক্র, যা বেশ কয়েকটি ভার্চুয়াল সেমিনার করেছে করোনা ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি ও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের অগ্রগতি নিয়ে, যে সেমিনারগুলো আমি মডারেট করেছিলাম। তথাপি আমি করোনা ভাইরাসের ক্লিনিক্যাল কোনো কিছু নিয়ে কোনো আলোচনা কিংবা লেখালেখি করিনি। কিন্তু এখন হঠাৎ করে করোনা ভাইরাসের যে ঊর্ধ্বগতি তা আমাদের সবাইকে নতুন করে আতঙ্কিত করছে। তাই ভাবছি একজন নন-ক্লিনিক্যাল এবং নন-মেডিকেল ব্যক্তি হয়েও করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে নন-ক্লিনিক্যাল বা নন-টেকনিক্যাল কিছু পরামর্শ দেয়া যায় কিনা! ২০২০ সালের মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমবেশি হয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও বিভিন্ন সময় ওঠানামা করেছে, কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা কখনোই ৫ হাজার ছাড়াইনি এবং মৃত্যুর সংখ্যাও কখনো ৫০ অতিক্রম করেনি। অথচ মার্চের ৩০ এবং ৩১ তারিখ দুদিনই আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও ৫০-এর ওপরে। ফলে অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণে সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নানান পদক্ষেপ নিচ্ছে। গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী বহন, বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো বন্ধ করে দেয়া, ৩০ তারিখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত বাতিল করা, ব্যাংক-অফিস-আদালত ৫০ শতাংশ লোকবল দিয়ে চালানোসহ বিভিন্নভাবে সংক্রমণ রোধের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। কেননা সংক্রমণ রোধ করা না গেলে মৃত্যুর সংখ্যাও রোধ করা যাবে না। পৃথিবীর কোনো দেশ সেটা পারেনি। পারেনি বলেই, পৃথিবীর সব উন্নত দেশে জনস্বার্থ রক্ষার সব ধরনের উন্নত ব্যবস্থা থাকার পরও হাজার হাজার, লাখ লাখ লোক করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে উন্নত প্রযুক্তি আছে, ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে, মানুষের মধ্যে সচেতনা আছে, মানুষের মধ্যে শিক্ষা আছে, সরকারও যথেষ্ট দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে, তথাপি করোনা ভাইরাস থেকে নিজ দেশের জনগণকে রক্ষা করতে পারেনি। পারেনি বলেই বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ ২১ হাজার ৮৭৪ জন (৩১ মার্চ, ২০২১ পর্যন্ত) আর সংক্রমণের সংখ্যা ১২ কোটি ৯২ লাখ ২১ হাজার ৫৮৮ (৩১ মার্চ, ২০২১ পর্যন্ত)। এ রকম একটি মহামারি এবং অতিমারিতেও বাংলাদেশ শুরু থেকেই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেটা মোকাবিলা করেছে। সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে, এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের কথা চিন্তা করে সবকিছু একেবারে লকডাউন করে না দিয়ে কয়েক মাস গণপরিবহন বন্ধ রেখে সীমিত আকারে সবকিছু চালু রেখে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোটামুটি সন্তোষজনকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে সংক্রণের হার কমতে শুরু করায় আস্তে আস্তে বিভিন্ন সেক্টরের ওপর আরোপিত সীমিত নিষেধাজ্ঞা ক্রমান্বয়ে তুলে নিয়ে গোটা বাংলাদেশকে একটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সবকিছু এগিয়েছিল। একদিকে সংক্রমণের হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস হচ্ছিল, অন্যদিকে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে আসছিল। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরির ভ্যাকসিন প্রদান, যা ইতোমধ্যে প্রায় ৫৩ লাখ ৭০ হাজার ৪৩১ জন (৩১ মার্চ, ২০২১ পর্যন্ত) লোককে দেয়া হয়েছে। অত্যন্ত সন্দরভাবে এবং সুশৃঙ্খলভাবে গোটা বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেয়া শুরু হয়। এমনকি দুর্জন ও দুর্মুখেরাও সরকারের ভ্যাকসিন প্রদানের সিদ্ধান্ত, ব্যবস্থাপনা এবং আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু হঠাৎ করে করোনার প্রকোপ আবার দেখা দেয়ায় নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কয়দিন আগেও যেখানে ১৫ হাজার টেস্ট করে ৩-৪শ সংক্রমণ এবং ৩-৫ জনের মৃত্যুর পরিসংখ্যান ছিল, সেটা হঠাৎ করে দৈনিক ৫ হাজারের ওপর এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান ৫০-এর ওপরে গেল কেন এবং কীভাবে? সবকিছুর জন্য সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপানোর একটা জনপ্রিয় তরিকা সমাজে প্রবলভাবে বিদ্যমান। কিন্তু আমরা যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাই, হঠাৎ করে করোনার এ ব্যাপক সংক্রমণের জন্য মূলত আমরাই দায়ী। আমাদের বেপরোয়া আচরণ, সবকিছুকে ‘থোড়াই কেয়ার ভাব’, সরকারিভাবে এত আহাজারি করার পরও সামাজিক দূরত্বের পরামর্শ না মানা, জনপরিসরে মাস্ক না পরা, দেশে যে একটা মহামারি চলছে তাকে একেবারেই পাত্তা না দেয়া, নিজের সংক্রমিত না হওয়া বা অন্যকে সংক্রমিত না করার নূ্যূনতম দায়িত্ববোধের অভাব প্রভৃতি আমাদের নতুন করে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এখানে মনে রাখা জরুরি যে, বাংলাদেশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দিয়েছিল বলেই ১৮ কোটি মানুষের দেশে মৃত্যুর সংখ্যা এখনো ৯ হাজার ৪৬ জন (৩১ মার্চ, ২০২১ পর্যন্ত)। কিংবা সংক্রমণের সংখ্যা ৬ লাখ ১১ হাজার ২৯৫ জন (৩১ মার্চ, ২০২১ পর্যন্ত)। কিন্তু আমরা যদি নিজেরা এভাবে বেপরোয়া হই, নিজেরা যদি নিজেদের ভালোটা না বুঝি, নিজেরা যদি নিজেদের সুরক্ষা দিতে ড্যাম কেয়ার ভাব করি, তাহলে কেউ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। তাই আমি মনে করি এবং প্রবলভাবে বিশ্বাস করি, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা পুরোপুরিই আমাদের হাতে। আমরা মানে, এ দেশের সাধারণ মানুষ। এ দেশের আমজনতা। আমরাই পারি আমাদের দেশটাকে রক্ষা করতে। আমরাই পারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আমরাই পারি, আমাদের বন্ধু, স্বজন, আত্মীয় ও পরিজনকে সর্বনাশা করোনা ভাইরাসের করাল থাবা থেকে রক্ষা করতে। কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। সামান্য সচেতনতা, অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে না যাওয়া, ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরিধান করা, অন্যের সঙ্গে সামান্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা (যাকে বলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব) এবং একটু পরপর সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া বা কোনো জীবাণুনাশক দিয়ে হাতে ধুয়ে পরিষ্কার করা। একজন নন-ক্লিনিক্যাল ব্যক্তি হয়েও একটা ক্লিনিক্যাল পরামর্শ দিলাম, কেননা এ পরামর্শগুলো দেয়ার জন্য, মানার জন্য এবং অন্যকে মানতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কোনো ক্লিনিক্যাল ব্যক্তি হওয়ার প্রয়োজন। তাই করোনার হঠাৎ সংক্রমণ প্রবৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। কেননা করোনা ‘নিয়ন্ত্রণে রাখা বা না রাখা’ পুরোটাই মূলত আমাদেরই হাতে। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App