×

জাতীয়

সুবর্ণজয়ন্তীতে দ্বিতীয় স্বাধীনতার পথে বাংলাদেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২১, ০৪:৪০ পিএম

সুবর্ণজয়ন্তীতে দ্বিতীয় স্বাধীনতার পথে বাংলাদেশ

ফাইল ছবি

সুবর্ণজয়ন্তীতে দ্বিতীয় স্বাধীনতার পথে বাংলাদেশ

সি রাজা মোহন। ফাইল ছবি

পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার পঞ্চাশতম বার্ষিকী যখন উদযাপন করছে বাংলাদেশ, তখন দেশটির সফল অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের ব্যাপক প্রশংসা চলছে চারদিকে। তবে প্রশংসার বান ডাকলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থানের গভীর ভৌগলিক পরিণাম নিয়ে খুব কমই বলা হচ্ছে। এই পরিণামের মধ্যে বলতেই হয়, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ভর কেন্দ্রটি পূর্বে সরে যাচ্ছে এবং পূর্বাঞ্চলীয় উপমহাদেশের পুরনায় একীভূতকরণ ঘটছে, এই উপমহাদেশ ছিল একসময় শত্রুতা আর  স্বল্প প্রবেশযোগ্য সীমানা দ্বারা বিভক্ত। আজকের দিনে, বাংলাদেশ দ্বিতীয় মুক্তির পথে রয়েছে । কারণ এর ফলে দেশটির আপেক্ষিক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটবে এবং এ অঞ্চলে ও এর বাইরেও ঢাকাকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেবে। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন সামুদ্রিক সম্ভাবনার সন্ধানেরও সুযোগ এনে দেবে ঢাকাকে।

[caption id="attachment_275250" align="alignnone" width="844"] ফাইল ছবি[/caption]

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে বিশ্ব অঙ্গনে আবির্ভূত হয়েছিল, বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশই একে টিকে থাকার সুযোগ দিয়েছিল, এর বিকাশে সেোগিতা করাতো দূরের। কয়েক দশক ধরেই এ ছিল বিশ্বের অন্যতম নিঃস্ব দেশ, যা আসলে দুর্ভিক্ষ, বঞ্চনা এবং রোগবালাইয়ের চরম পীড়িত দেশেরই সমার্থক। তবে গত কয়েক বছরে টেকসই উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত করেছে। ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে দেশটির। দারিদ্র্য হ্রাস, গড় আয়ু, সাক্ষরতার হার বাড়ায় এবং নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ঢাকার সফলতায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো প্রশংসামুখর।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের এই স্বীকৃতির মধ্যে অবশ্য এর ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক তাত্পর্যের প্রশংসার উল্লেখ নেই। এর কারণ, আমরা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি সম্পর্কে যথনই চিন্তা করি, তখন পুরো মনোযোগই ভারত এবং পাকিস্তানের ওপরেই থাকে।এটা আমাদের দীর্ঘকালের অভ্যাস।

ভারত-পাকিস্তান একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া কমেন্টারিয়েট, এবং থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ইন্ডাস্ট্রি  শুধু কাশ্মীর, পারমাণবিক অস্ত্র, সন্ত্রাসবাদ এবং আফগানিস্তান নিয়ে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে বাগযুদ্ধের মাঝেই মনোযোগ সীমিত রাখে, যা কোনোভাবেই দৃষ্টির পরিচয় বহন করে না, এর ফলে এই অঞ্চলের বাকি ভুখণ্ড মনোযোগের বাইরেই থেকে যায়।

বাংলাদেশ আর এ উপমহাদেশে উপেক্ষণীয় নয়।

এমনকি ভাসা-ভাসা পর্যবেক্ষণেও ধরা পড়ে, উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিটি তাদের কৌশলগত গুরুত্ব অর্জন করছে। এর মধ্যে আরও ছোট রাষ্ট্রগুলোও রয়েছে। যেমন  শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ। দেশদুটি ভারত মহাসাগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সামুদ্রিক অলিগলি এদের দুপাশ দিয়েই গেছে।  দেশদুটি তাই ভারত, চীন, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বড় সামুদ্রিক শক্তিগুলির কাছে মহা আগ্রহের বিষয়। হিমালয়ের পাদদেশ ঘেষে থাকা নেপাল ও ভুটানদীর্ঘ বেষ্টনী হিসেবে চীন ও ভারতের মাঝে ভূমিকা রাখে। বেইজিং ও দিল্লির মধ্যকার তীব্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার নাট্যমঞ্চ এই দেশ দুটি।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক তাত্পর্য এর আকারের চেয়ে এক তিল কম নয়। এর জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, সংখ্যার দিক দিয়ে যা বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম। বাংলাদেশী প্রবাসী ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিও বেড়ে চলেছে, যা বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া  উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে একটি বড়সরো জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি, ইংরেজী-ভাষাভাষী বিশ্বেও প্রবাসী সংখ্যা  বাড়ছে।

বাংলাদেশ ২০১৯ সালে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল

উত্তরের নেপাল এবং ভুটান, উত্তর-পূর্বে চীন এবং দক্ষিণ-পূর্বে বার্মার সঙ্গে ভৌগলিক সান্নিধ্য বাংলাদেশকে এসব দেশের কাছে আকর্ষণীয় অংশীদার করে তুলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে  উপমহাদেশে বাংলাদেশ ভারতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে - কৌশলগত, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ককে জোরদারের মধ্য দিয়েই এ সম্ভব হয়েছে। আর এই অঞ্চলের বাইরেও ঢাকা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অন্যতম প্রধান সেনাবলের যোগানদাতা।

বাংলাদেশ একটি রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। এর মূল ভরসা পোশাক শিল্পের ওপর। এ খাতে ২০১২ সালে ৩০ বিলিয়ন ডলার রফতানি করেছিল। চীনের পরে তৈরি পোশাক উৎপাদনে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ এবং দেড় শতাধিক দেশে তৈরি পোশাক রফতানি করে দেশটি।

বাংলাদেশ জানে, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক ভারত বা চীনের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা হ্রাস করবে

সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হিসেবে আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই এর ভূ-রাজনীতি শুরু হয়েছিল। ধর্মের নামে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৫ বছরের মাথায় পাকিস্তান থেকে বিদায় নেওয়ার পর বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি এক সত্যের সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য  হয়ে ওঠে। সেটা হলো- ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে কোনও জাতিকে সংহত বা ঐক্যবদ্ধ করতে পারে না। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে, তবুও দেশটির ধর্মীয় সংযম –  এবং বেশ কিছু শক্তিশালী সন্ত্রাসবাদী হামলার এক পর্যায়ে দেশের মধ্যে বেড়ে ওঠা ইসলামী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে সফলতাও রয়েছে। বাংলাদেশের এই ধর্মীয় সংযম পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে এখনও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক গুণ হিসেবে টিকে আছে।

দেশটি যদি নিজেই অর্থনৈতিক সাফল্য  অর্জন করতে না পারতো, তবে বাংলাদেশের এই বিশেষ অবস্থান এবং রাজনৈতিক চরিত্র এতোটা পাত্তা পেতো না। পাকিস্তান ও ভারতের সাপেক্ষে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের মাত্রা বুঝতে, দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিবেচনা নেওয়া যেতে পারে।

প্রথমত, বাংলাদেশ ২০১৯ সালে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপি  ৩০৩ বিলিয়ন ডলার এবং  পাকিস্তানের ২৭৯ বিলিয়ন ডলার। দু’দেশের মধ্যে এই ব্যবধান বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ কভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও তার প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রেখেছে এবং পাকিস্তান তার অর্থনৈতিক বিপর্যয় থামানোর লড়াই করছে।

দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল গত বছর ঘোষণা করেছিল, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০২০ সালে ভারতের তুলনায় কয়েক ডলার ছাড়িয়ে যাবে। মহামারীর সময়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে তীব্র সংকোচনের ফল হলেও ওই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উপমহাদেশে একটি তুলনামূলক অবস্থানে তুলে আনে। এটি আরও আভাস দেয়,  বাংলাদেশ আর এ উপমহাদেশে উপেক্ষণীয় নয়।

ভারত-পাকিস্তান শত্রুতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপমহাদেশের অগ্রগতি এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বকে মলিন করেছে বলে হা-হুতাশ করা ফ্যাশনেবল রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কেবল ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের সাথে কথা বলে না কিংবা বাণিজ্য করে না বলে এবং আঞ্চলিক ফোরাম — দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)  নিস্ক্রীয় বলে এই অঞ্চলের অন্যরা অগ্রসর হতে পারছে না, তা কিন্তু নয়।

ভারতের সাথে  সুসম্পর্ক বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরেও মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, বিশেষ করে সামুদ্রিক বিশ্বের  দিকে।

বাংলাদেশ যেমন পাকিস্তানের চেয়ে দ্রুত গতিতে বিকশিত হচ্ছে, তার শিক্ষার মান বাড়াচ্ছে এবং তার এক সময়ের দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করছে, তেমনি দেশটির কারণে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রটি পূর্বের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে জড়িত করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অনীহা থাকায় সার্ক অকেজো হয়ে আছে। ফলে অর্থনৈতিক কেন্দ্রটির এই পরিবর্তন আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। আর এই পরিস্থিতিতে ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান এবং নেপালের মধ্যে উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরালো হয়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সাথে আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতার দিকেও মনোযোগ বেড়েছে।

মানচিত্রের দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়: ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের ভাগই আজকের পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার এবং সংলগ্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক সেতু রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। উপমহাদেশের ভেতরে ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং এর প্রত্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশও একটি সেতু রাষ্ট্র। ভারতের মূল ভূখন্ড কেবল তথাকথিত মুরগির গলার মতো একটি সংকীর্ণ ও দুর্বল করিডোর দ্বারা সংযুক্ত রয়েছে। দেশভাগের পরে বহু বছর ধরে বন্ধ হয়ে থাকা পুরানো রেল, সড়ক এবং নদীপথের সংযোগ এখন পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে।

ইসলামাবাদ এবং ঢাকা তাদের ভৌগলিক উত্তরাধিকারকে কত আলাদাভাবে কাজের লাগিয়েছে তা লক্ষ করলেও একটি বিষয় স্পষ্ট হতে পারে। পাকিস্তানের কৌশলনির্ধারণী মহল (স্ট্রাটেজিক কমিউনিটি)  ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে তার অনন্য অবস্থান সন্ধানেরে ওপর জোর দিয়েছে; বিপরীতে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য তার ভূগোলকে কাজে খাটানোর দিকে মনোনিবেশ করেছে। পাকিস্তান সচেতনভাবে ভারতের হাতে থাকা বিশাল বাজারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দ্বার উন্মুক্ত না করার  সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজস্ব অর্থনৈতিক ক্ষতির জন্য পাকিস্তান জোর দিয়ে বলে থাকে, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হওয়ার আগপর্যন্ত ভারতের সাথে বাণিজ্যিক সংযোগ অবশ্যই উন্মুক্ত হবে না। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভারতের সাথে তার দীর্ঘ সীমান্তকে অর্থনৈতিক সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। একই সাথে, নয়াদিল্লির সাথে বিতর্কিত দ্বিপক্ষীয় ইস্যু সমাধানেও অগ্রগতি অর্জনে দেশটি সক্ষম হয়েছে।

জাপান আগ্রহী হয়ে আছে বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নে হাত বাড়াতে

এই কিছুদিন আগেও, ভারত বেষ্টিত ল্যান্ডলকড ভূখন্ড হয়ে থাকায় বাংলাদেশ হাসফাঁস করতো।  প্রতিবেশি দেশটির সঙ্গেই ভাগ করতে হয় এর ৯৯ শতাংশ ভূ-সীমান্ত। গত এক দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ভারতের সাথে এই কঠিন সম্পর্ককে উত্পাদনশীল অংশীদারত্বে রূপান্তরিত করেছে। মনমোহন সিং ও নরেন্দ্র মোদীর মতো একের পর এক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সাথে কাজ করার মধ্য দিয়ে বড়োসরো দর কষাকষি চালিয়ে গেছেন এবং এ জন্য  চাপও অব্যাহত রেখেছেন।  দরকষাকষির ইস্যুগুলো- সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সহযোগিতা, ভারতের বাজারে বাংলাদেশের আরও বেশি প্রবেশাধিকার, নদীর পানির ভাগাভাগি ও সীমান্ত বিরোধের সমাধান এবং দেশ ভাগের পর থেকে বন্ধ থাকা আন্তঃসীমান্ত সংযোগ পুনরুদ্ধার। সুবিস্তৃত এইসব ইস্যু নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারার ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অভূতপূর্বভাবে গভীর হয়েছে। ঢাকা এখন নিজেকে ল্যান্ডলকড দেশ হিসাবে দেখে না, বরং ভারত ও এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে স্থল-সংযুক্ত এবং নদী-সংযুক্ত দেশ হিসেবে নিজেকে দেখে। ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা আরও গভীর হওয়ায় তা এ উপমহাদেশে দেশভাগের নেতিবাচক পরিণতিগুলি কাটিয়ে উঠতেও ভূমিকা রাখছে।

সমস্ত বিতর্ক-বিরোধ যে পিছনে ফেলে এগোনো সম্ভব হয়েছে তা নয়। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের ঘরোয়া রাজনীতির হাতে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সারাক্ষণই পাস-ফেলের পরীক্ষা চলছে। সীমান্ত দিয়ে মানুষের চলাফেরা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার- এই উভয় ইস্যুই  দুই দেশের রাজনীতিতে বারবার উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে। তবে দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটায় এইসব উদ্বেগকে ভাগযোগ করে কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখছে। ভারতের সাথে  সুসম্পর্ক বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরেও মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, বিশেষ করে সামুদ্রিক বিশ্বের  দিকে।

বঙ্গোপসাগরের উপকূলে সবার শীর্ষে  অবস্থান হওয়ায় বাংলাদেশ সমুদ্র ইস্যুতে আরও আগ্রহী হতে শুরু করেছে। গত দশকে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা। যদি  সঠিক কার্ড খেলা হয়ে থাকে, ভারত-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ নিজের সমুদ্র –সামর্থ্ আরও বাড়াতে দ্রুত বিকশমান কৌশল ব্যবহারের সুযোগ পাবে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল ঘিরে ঢাকার তৎপরতা অবশ্যই বঙ্গোপসাগর থেকেই শুরু হওয়া উচিত। এ উপসাগরীয় এলাকা আবারও উদীয়মান চীন, ভারত, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার মহা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠছে।

এরই মধ্যে, ঢাকা এবং নেপিদো উভয়ের সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে ভারত। চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং থেকে বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের কিউকপিউ দ্বীপ পর্যন্ত জোড়া পাইপলাইন এবং সেইসাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর ক্রমবর্ধমান হানা দেওয়ার ফলেই ঝাঁকুনি খেয়ে জেগে ওঠেছে ভারত।

বেইজিংয়ের সঙ্গেও নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে ঢাকার। এরই মধ্যে চীনা সাবমেরিন এবং ফ্রিগেটও কিনেছে ঢাকা। চাইনিজ সমর-সরঞ্জামের উপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমাতে চাইবে ভারত। চীনা অর্থনৈতিক বিনিয়োগের মাত্রার সঙ্গে ভারত পাল্লা দিতে না পারলেও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করছে। এ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত কোয়াড দেশগুলোর মধ্যে জাপান আগ্রহী হয়ে আছে বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নে হাত বাড়াতে।

বাংলাদেশকে পাশে পেতে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্নভাবে যেমন তেমনি সম্মিলিতভাবেও তাদের তৎপরতা  জোরদার করছে।

এমনকি এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছে যুক্তরাষ্ট্রও। দেশটি নিজের চিরাচরিত কৌশল বাংলাদেশকে অবহেলা করা। এখন এ কৌশল থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগুন এক বিরল সফরে ঢাকা আসেন। তিনি তখন ঘোষণা করেছিলেন, "বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের এক মূল অংশীদার হিসাবে দেখছে’ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এখন চীনের সাথে "চরম" প্রতিযোগিতার কথা বলছেন। এ থেকে ধারণা করা সম্ভব, বাংলাদেশকে পাশে পেতে এই কোয়াড দেশগুলো, অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্নভাবে যেমন তেমনি সম্মিলিতভাবেও তাদের তৎপরতা  জোরদার করতে থাকবে।

বাংলাদেশ জানে, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক ভারত বা চীনের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা হ্রাস করবে এবং কাকে বেছে নেবে সে বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্তের গ্রহণের পথ তার জন্য আরও প্রশস্ত হবে। ভূ-রাজনৈতিক দাবা বোর্ডে খেলার ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব বাড়ছে ঢাকার। তারা এর বাহ্যিক পরিবেশের সুযোগও নিচ্ছে। এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশ চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে অন্ধভাবে গ্রহণ করে নি। তবে একাধিক অংশীদারকে এর সঙ্গে জড়িত করার চেষ্টা করেছিল ঢাকা। চীন ও কোয়াড দেশগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। এখন এখানেও একই ধরনের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের।

***

লেখক পরিচিতি: সি রাজা মোহন হচ্ছেন সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App