×

মুক্তচিন্তা

এপার বাংলার নতুন উপলব্ধি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২১, ১২:১২ এএম

পশ্চিমবঙ্গ এখন নির্বাচনী কুরুক্ষেত্র। লড়াইয়ের মুখ মোদি বনাম মমতা। ইস্যু উন্নয়ন বনাম ধর্ম। এই পরিপ্রেক্ষিতে মোদি গেলেন ঢাকায়। বাংলা সংবাদ মাধ্যমের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্র যারা রাজ্য সরকারি বিজ্ঞাপনে আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় সবসময় মোদির বিরুদ্ধাচরণ করে এবং একটি বাংলা টিভি চ্যানেল যারা মোদির পক্ষে কথা বলে, এরাই মোদির সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি পেল, বাকিরা নয়। দুর্ভাগ্য এই যে, দুদিনের এই সফরে বাংলা সংবাদপত্রে ভারত-বাংলাদেশ প্রথম দিনের শীর্ষ বৈঠকের সংবাদ স্থান পেল না। অথচ এই বৈঠক ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল আঞ্চলিক সমন্বয় (অর্থনৈতিক)। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে ভারত আরসিইপিতে (রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ, আসিয়ানের ১০টি সদস্য রাষ্ট্র এবং ছয়টি রাষ্ট্রÑ অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড) অংশ নিয়েছে। আলোচনা হওয়ার কথা ছিল ‘বর্ধিত আরসিইপি’ নিয়ে, যাতে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অংশ নিতে পারে। তিস্তা চুক্তি ও আরো ৬টি অভিন্ন নদীর পানি নিয়েও আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল সীমান্ত সহিংসতা বন্ধ করা নিয়ে। অথচ এগুলো নিয়ে কোনো সংবাদ আমরা পেলাম না। বরং আমরা পেলাম বাংলাদেশের আমজনগণ মোদির সফরে ক্ষুব্ধ ও তুমুল আন্দোলন করছেন। বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে পূজা দিয়েই তিনি কেটে পড়েছেন যশোরেশ্বরী কালীবাড়িতে পূজা দিতে এবং ওড়াকান্দিতে মতুয়া মন্দিরে পূজা দিয়ে চাইছেন মতুয়া সম্প্রদায়ের মন জয় করতে। এমনকি মোদি ১৯৭১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের দাবিতে ও সেনা হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার দাবিতে সত্যাগ্রহ করে জেলে গিয়েছিলেন, এই দাবি করায় তাকে মিথ্যাচারী ইঙ্গিতপূর্ণের বিভিন্ন সংবাদ পাওয়া গেল। অর্থাৎ দুপারেই সংবাদ পরিবেশনের নামে উদ্দেশ্যমূলক ক্যাম্পেইন পরিবেশিত হলো। ভারতে এলে মুসলমানদের রাজস্থানের আজমীর শরিফের খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগা দর্শনের উদ্যোগ থাকে, সে দেশনেতাই হোন বা সাধারণ মানুষ, একে কেউ কখনো মতলবি উদ্যোগ বলে আখ্যা দিয়েছেন বলে জানা নেই। কিন্তু মোদির কালীবাড়িতে পূজা সেভাবেই উপস্থাপিত হলো। মোদির ওড়াকান্দি সফর নিয়ে বলা হলো, ওড়াকান্দিতে মতুয়াদের মন্দির দর্শন মারফত পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া ভোটারদের কাছে বার্তা পৌঁছল যে, এই প্রথম কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মতুয়াদের সর্বোচ্চ আরাধ্য পুণ্যভূমিতে উপস্থিত হয়েছেন। আর মতুয়াদের নাগরিকত্ব প্রদান নিয়ে তাদের যে ক্ষোভ আছে তা প্রশমিত করে মোদি তাদের নিজ পক্ষে টানলেন। যদি কেউ এই উদ্যোগ নিয়েও থাকেন তাহলে অন্যায় কোথায়? এর আগে তো কেউ কখনো যাননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও সুবর্ণজয়ন্তীতে তাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জ্ঞাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলায় টুইট করে, ‘মানবাধিকার ও স্বাধীনতার রক্ষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। নরেন্দ্র মোদি বঙ্গবন্ধুর প্রতি চিরকালই খুব শ্রদ্ধাশীল। তার জন্মশতবর্ষে ভারত প্রকাশ করল স্মারক ডাকটিকেট। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নিল বাংলাদেশের সেনা। ভারত সাধারণত অন্য কোনো দেশের মহাপুরুষদের নামে ডাকটিকেট বের করে না। এর আগে শুধু আব্রাহাম লিঙ্কন ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ারের মৃত্যু শতবর্ষে এবং ভøাদিনির লেনিন ও হো চি মিনের জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল ডাকটিকেট। এমনকি ভারতের গত প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে এই প্রথম কোনো প্রতিবেশী দেশের সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের আগে ভারতের কোনো প্রতিবেশীই এই সুযোগ পায়নি। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, মোদির এই উদ্যোগ কোনো সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলো না। অথচ মোদির বক্তব্যে তার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেয়া নিয়ে হেডলাইন হলো যেন তিনি বিরাট আজগুবি কোনো গল্প বলেছেন। কিন্তু দেখা গেল, ১২ আগস্ট ১৯৭১-এ ৬০০ জনসংঘের সত্যাগ্রহী বাংলাদেশকে স্বাধীনতা ও স্বীকৃতিদানের আন্দোলন করে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এমনকি তার ভিডিও আছে। মোদির বয়স তখন ২২, জনসংঘের সর্বক্ষণের কর্মী, বাস দিল্লির পার্টি অফিসে। কাজেই এই আন্দোলনে তার থাকাটাই স্বাভাবিক। দেখুন, আমি মোদির এডভোকেট নই। কিন্তু একযোগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এই মিডিয়া আক্রমণ আমাকে পীড়িত করেছে। একসময়ের প্রখ্যাত গায়ক কবীর সুমন রাজনৈতিক প্রণোদনায় বাংলাদেশের বাঙালির কাছে আপত্তি তুলে মোদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আবেদন রেখেছেন, যদিও তিনি কিছুদিন আগে আর কখনো বাংলাদেশে যাবেন না বলেছিলেন, সেখানকার মানুষদের দুর্ব্যবহারকারী আখ্যা দিয়ে। বাংলাদেশের কেউ পারতেন তার রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে বিদেশি জনগণের কাছে এমন আবেদন রাখতে? এমনকি পশ্চিমবঙ্গের কেউ রাজ্যপ্রধানের নামে এমন ভিডিও বার্তা দিলে পুলিশ নির্ঘাত গাঁজা কেস দিয়ে দিত। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা এপারে কোনো মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়নি। এমনকি নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি একবারও উল্লেখ করেনি এ ঘটনা। কারণ এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন, তবে মুক্ত দেশে স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধরে রাখা আরো কঠিন। মনে রাখতে হবে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু বলতেন, স্বাধীন বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি সবার, প্রত্যেককে রক্ষা করাই প্রত্যেকের ধর্ম। তার স্বপ্ন ছিল, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় আন্দোলন যে জাতির মজ্জায়, তার স্বাধীনসত্তা প্রোথিত থাকবে ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। সদ্য-স্বাধীন দেশের জাতীয়তাবাদ-বিহ্বল থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো দেশের সংবিধানে ‘বাঙালি’ শব্দটি হয়ে উঠেছিল ধর্মোর্ধ্ব জাতীয়তাবাদের প্রতিশব্দ। সমাজে সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের অভ্যাস ও আচরণ থাকবে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, দেশকে একসূত্রে বাঁধবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি-আশ্রয়ী উদার বাঙালিত্ব। উদ্বেগের বিষয়, এই অসাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশে গত অর্ধশতকে কমবার লঙ্ঘিত হয়নি। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু-হত্যা তারই প্রমাণ, সেনাশাসনে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি মুছে ফেলা হয়েছিল। ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনে শব্দটি ফিরে এসেছে। কিন্তু দেশে সাম্প্রদায়িকতার ছড়িটি ঘুরানোর চেষ্টা এখনো অব্যাহত। মৌলবাদ যে সমাজ ও রাজনীতির পরিসরে রীতিমতো সক্রিয়, তার প্রমাণ সাম্প্রতিককালে একটি কট্টর গোষ্ঠীর দেশজুড়ে সমস্ত মূর্তি ও ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী বলে ভেঙে ফেলার নিদান। তিন বছর আগে ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ‘লেডি জাস্টিস’-এর মূর্তি সরাতে কট্টরপন্থিদের আন্দোলন হয়েছিল, সেই মূর্তি সরানোও হলো। ২০০৮ সালে ঢাকা বিমানবন্দর প্রাঙ্গণ থেকে লালন শাহের মূর্তিও তৎকালীন সরকার সরিয়ে দেয়। ‘মুজিববর্ষে’ খোদ দেশের স্বাধীনতার রূপকারের মূর্তি ভাঙা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্নভঙ্গ কি না, তা ভাববার সময় এসেছে। বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচুর সাফল্যের অধিকারী। সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা থেকে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ, মাথাপিছু জাতীয় আয়ে ভারতকেও অতিক্রম করার সম্ভাবনা বাংলাদেশের মুকুটে গৌরবপালক কম এনে দেননি। বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙার স্পর্ধিত দুষ্কৃতির আবহেই নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতুর ইস্পাত-নির্মিত সব স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে, সেতু সম্পূর্ণ। শেখ হাসিনার সরকার ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ গড়েছে নিজ সামর্থ্য।ে বাঙালির আত্মসম্পদ ও বিশ্বাসের এই সদ্ব্যবহার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, বললে ভুল হবে না। ২০১৫ সালে মোদি যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলেন তখন আজকের আন্দোলনকারী নেতারা মোদি সান্নিধ্যে লুটপুটি খেয়েছিলেন। তার স্থিরচিত্র আছে। ইতিহাস একসময় সত্যকে উন্মোচিত করে। ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের অনেক মানুষই স্বাধীনতা চাননি। মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণ, ক্যাম্পে স্বদেশীয়দের অত্যাচার হলেও এরা চাননি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হোক। সে সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর সময় নেয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন জনসংঘের অটল বিহারি বাজপেয়ি ও লালকৃষ্ণ আদভানি। তারা চেয়েছিলেন ভারত যত শিগগিরই সম্ভব বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করে এই গণহত্যালীলা বন্ধ করুক। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বজনমতের প্রতিক্রিয়া কি হবে তা নিয়ে সন্ধিগ্ধ ছিলেন। অভ্যন্তরীণ চাপে তিনি সারা বিশ্ব পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে ভ্রমণ করেন। আশাব্যঞ্জক সাড়া পাননি তিনি। কিন্তু রাশিয়া সামরিক চুক্তিতে আসতে রাজি হলো। সৃষ্টি হলো দুই অক্ষ ভারত-রাশিয়া ও পাকিস্তান-চীন-আমেরিকা। যুদ্ধের পরে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলো। অটল বিহারি বাজপেয়ি সংসদে ইন্দিরা গান্ধীকে ‘দেবী দুর্গা’ বলে প্রশংসা করলেন। নাহ, পাকিস্তানিপন্থিরা আজো ভোলেননি সে কথা। তাই আজ তাদের এই আন্দোলন অটল আদভানির উত্তরসূরির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর সূচনালগ্ন যাতে সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সহর্ষে উদযাপিত হয় কোনো প্রণোদনা ও তিক্ততা ছাড়া এবং সংখ্যালঘুরা নিজেদের এই যাত্রা থেকে নিজেদের সরিয়ে না রেখে এক রাস্তায় শামিল হয় আজ সে লক্ষ্যে এগোবার পালা। সেটা দেখার প্রত্যাশায় আছে এপার বাংলা। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App