×

জাতীয়

মোদির সফর: প্রাপ্তি অনেক, অপ্রাপ্তিও আছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২১, ০৯:০৭ এএম

দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ব্যস্ত সময় পার করে নিজ দেশে ফিরে গেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পেছনে রেখে গেলেন ৫০ বছরের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের সোনালি অধ্যায়কে সামনে এগিয়ে নেয়ার সুদৃঢ় প্রত্যয়। সেই প্রত্যয়কে আরো মজবুত করতে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই, উপহারস্বরূপ কোভিড ভ্যাকসিনের টিকা নিয়ে আসা, জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগদান, টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর সমাধি পরিদর্শন, ওড়াকান্দি ও যশোরেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন- সব কর্মসূচিতে মোদি ছিলেন প্রাণবন্ত। এমনকি উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের পাশে থাকারও সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন মোদি। অবশ্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ফিরে যাওয়ার পরপরই বিশ্লেষণ চলছে মোদির সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খতিয়ান নিয়ে।

অনেকেই বলেছেন, মুজিব জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এসেছেন, এটাই সরকারের বড় ক‚টনৈতিক সাফল্য। এখানে আলাদা করে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে যোগ দিতে দুদিনের বাংলাদেশ সফর শেষে নয়াদিল্লি ফিরে যাওয়ার আগে ঢাকা ও গোপালগঞ্জে দুটি ভাষণ দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। দুটি মন্দির পরিদর্শন করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থল পরিদর্শন করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্তে এবং দ্বিপক্ষীয়ভাবে দুটি বৈঠক করেছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির এ সফর আমাদের জন্য গর্বের ও গৌরবের। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে যেসব অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে, তার সবগুলোই দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়েছে। সে সঙ্গে এ অঞ্চলের উন্নয়নে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতেও অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। সব মিলিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। এদিকে দুদিনের সফরে এসে জনগণের যে আন্তরিকতা দেখেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তাতে নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ সফর নিয়ে একাধিক টুইট করে এ মুগ্ধতা প্রকাশ করেন তিনি।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, ভারতের যে কোনো প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর আলাদা গুরুত্ব বহন করে। সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে মোদি ঢাকা সফর করলেও এতে দ্বিপক্ষীয় ও সৌজন্যমূলক বৈঠক ও সাক্ষাৎ দুটোই ছিল। সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এর প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে বাধা ছিল, সেটি দূর করার জন্য টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলা হয়েছে। এটিও কিন্তু কম প্রাপ্তি নয়। এছাড়া করোনা মোকাবিলায় ভারতের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে আগে পাওয়া গেছে ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন। আর মোদি আরো ১২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছেন। মোট ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন উপহার- এটাও ভারতের তরফ থেকে বড় প্রাপ্তি বলে তিনি জানান।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ, বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও অন্যান্য বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এগুলো আমাদের উন্নয়ন অংশীদারত্বে শক্তি জোগাবে এবং দুই দেশের মানুষের বিশেষ করে তরুণদের লাভবান করবে। তবে বাংলাদেশের যে দুটো চাওয়া- তিস্তার পানি চুক্তি ও সীমান্ত হত্যা, সে বিষয়ে বাংলাদেশকে আরো অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। কারণ গুরুত্বপূর্ণ এ দুই বিষয় নিয়ে ভারত বলেছে, তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু কবে চুক্তি হবে, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য নেই।

জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. জমির ভোরের কাগজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির এ সফরে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো বেড়েছে। এ সফর থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, বাণিজ্যে যা করার, তা করবে উভয় দেশই। তবে সাধারণ মানুষ চেয়েছিল মোদির সফরে পানি ভাগাভাগি চুক্তি হবে। একই সঙ্গে সীমান্ত হত্যা বন্ধ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির কোনো বক্তব্য শুনতে পাবে। কিন্তু এই দুটো লাইন অনুপস্থিত। এজন্য আমি মনে করি তিস্তার পানি চুক্তি এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের পক্ষ থেকে যা করণীয়, তা দ্রুত করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসীন ভোরের কাগজকে বলেন, নরেন্দ্র মোদির এবারের ঢাকা সফর সমস্যা বা সমাধানের জন্য নয়। আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। তবু তিনি কথা বলেছেন। বৈঠক করেছেন। তিস্তা চুক্তির বিষয়ে তো তারা না করেননি। তবে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ভারত তাদের দেশের স্বার্থটাই দেখেছে বলে মনে হয়েছে। কারণ ভারত বিষয়টিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সমস্যা হিসেবে দেখতে চাইছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে কূটনীতির সাফল্য বা ব্যর্থতা আমি দেখছি না। এদিকে গত শনিবার দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে ৬২টি পয়েন্ট উঠে আসে। এর ৪৫ নম্বর পয়েন্টে সীমান্ত সুরক্ষার বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, দুই নেতা একটি প্রশান্ত, স্থিতিশীল এবং অপরাধমুক্ত সীমানা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়েছিলেন। উভয় পক্ষই একমত হয়েছে, সীমান্তে যে কোনো মৃত্যু উদ্বেগের বিষয় এবং সীমান্ত রক্ষার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বেসামরিক নাগরিকের এ রকম মৃত্যুকে শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে জনমুখী ব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশ মানবিক কারণে রাজশাহী জেলার নিকটবর্তী পদ্মা নদীর সঙ্গে নদীপথে ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার ‘ইনোসেন্ট প্যাসেজের’ অনুরোধ জানিয়েছে। এর জবাবে ভারত অনুরোধটি বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছে। এদিকে ভারত ত্রিপুরা অংশে যেখানে বাংলাদেশের সীমানা রয়েছে, সেখানে বেড়া দেয়ার কাজ শেষ করার জন্য অনুরোধ করেছে। বাংলাদেশ বিষয়টি খতিয়ে দেখবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।

যৌথ বিবৃতিতে সার্ক ও বিমসটেকের কথাও উঠে আসে। উভয় নেতা জোর দিয়ে বলেছেন, সার্ক এবং বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর বিশেষত কোভিড-১৯-পরবর্তী পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা নিতে হবে। এ সময় কোভিড তহবিল গঠনের প্রস্তাব করার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। এরপর গতকাল রবিবার বিমসটেক নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়।

দীর্ঘ আড়াই বছর পর সাত দেশের সংগঠন বিমসটেকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আগামী বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত হবে। ভার্চুয়াল এ বৈঠকে বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলনে কী কী বিষয় উপস্থাপিত হবে, তা নিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলো আলোচনা করবে। এ বিষয়ে গতকাল রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৮ সালে কাঠমান্ডুতে শেষ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল, এ বছর শ্রীলঙ্কায় হওয়ার কথা আছে। আগামী শীর্ষ সম্মেলনে বিমসটেক চার্টার, কয়েকটি চুক্তি, পরিবহন খাতে মাস্টার কানেক্টিভিটি পরিকল্পনাসহ অন্যান্য বিষয় উপস্থাপন করার বিষয়ে সব দেশের ঐকমত্য প্রয়োজন।

তিনি বলেন, বিমসটেকের সদস্য রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা। সদস্য এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কানেক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য কাজ করছে সংস্থাটি। ২০১৬ সালে ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় বিমসটেক কানেক্টিভিটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করার এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহযোগিতায় এ স্টাডি করা হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা জানান।

তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যদি এ পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট হন, তবে আগামী শীর্ষ সম্মেলনে এটি গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করা হবে। ১৯৯৭ সালে বিমসটেক প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন পর্যন্ত এর চার্টার গ্রহণ করা হয়নি। এবারের শীর্ষ সম্মেলনে সব প্রধান নেতার স্বাক্ষরের মাধ্যমে এটি গ্রহণ করা হতে পারে বলে তিনি জানান।

এই কর্মকর্তা আরো বলেন, সব দেশের মধ্যে আইনগত সহায়তা (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স) সংক্রান্ত চুক্তি, সব দেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি ও প্রযুক্তি হস্তান্তর সহায়তা সেন্টার স্থাপন চুক্তি নিয়ে আলোচনার পর এটি শীর্ষ সম্মেলনে গ্রহণের জন্য সুপারিশ করতে পারেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App