×

মুক্তচিন্তা

উত্তপ্ত স্বদেশ : দুর্ভাবনা ও সমাধানের পথ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২১, ১২:৩১ এএম

ইস্যু খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত জঙ্গিগোষ্ঠী এবার একটা ইস্যু পেয়ে গেছে। আর তার সঠিক ব্যবহার করছে তারা। গত দুদিন চরম উত্তেজনা আর সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এ লেখা যখন লিখছি তখন চলার কথা হরতাল। বলাবাহুল্য নতুন প্রজন্মের কাছে এই হরতাল-অবরোধ অপরিচিত শব্দ। আমাদের যৌবনের সোনালি দিন তারুণ্যের সুবর্ণকাল কেটেছিল এসব হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভেতর। পেছন ফিরে তাকালে দেখি এরশাদ আমল, বেগম জিয়ার আমলে সবসময় লাগাতার হরতাল-অবরোধে জীবন ছিল অতিষ্ঠ। দিনের পর দিন এমন থেমে যাওয়া জীবন দেশ ও জাতিকে এগোতে দেয়নি। শুধু কি তাই? দেশের মানুষের জীবন ছিল সবসময় ঝুঁকির মুখে। কে অসুস্থ, কে রোগী, কে সুস্থ তার ধার ধারত না রাজনীতি। আজ দেশ শাসনে থাকা আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে তারাও কম হরতাল ডাকেনি। রাজনীতির সে ক্রান্তিকাল হঠাৎই যেন থেমে গেল। ধারাবাহিক দেশ শাসনে শেখ হাসিনা সম্ভব করে তুললেন হরতাল-অবরোধহীন বাংলাদেশ। মাঝে মাঝে যে তার ব্যতিক্রম হয়নি বা হয় না তা কিন্তু নয়। কিন্তু তা এখনো ব্যতিক্রমেই আছে। বেশ ক’বছর আগে মতিঝিলে হেফাজতের তাণ্ডব বাদ দিলে দেশের এই সমস্যা মাথাচাড়া দিতে পারেনি। ইস্যু খুঁজে বেড়ানো বিরোধী দল ও উগ্রবাদীরা সুযোগ পাচ্ছিল না। এবার তাদের সামনে এসে পড়ল নতুন সুযোগ। তাও স্বাধীনতা দিবসের মহান দিনে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার বায়তুল মোকাররমসহ সারাদেশে হেফাজতকর্মীসহ সাধারণ মুসল্লিদের ওপর পুলিশের হামলা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শনিবার রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলামকে নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সঙ্গে মাঠে নামে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন। পুলিশ, হেফাজত এবং ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের একপর্যায়ে গুলি ছুড়ে পুলিশ। এতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঁচজন নিহত হয়। এছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানায় হামলা করে তছনছ করে হেফাজতকর্মীরা। এ দুই ঘটনায় পুলিশসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়। জানা যায়, বিকাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। জেলার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে অন্তত ৫ জন। পুলিশসহ আহত হয়েছে অর্ধশত। গত শনিবার বিকালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নন্দনপুরে কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী মহাসড়কে অবস্থান করলে পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা তাদের ধাওয়া করলে সেখানে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে ৫ জন নিহতসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। উপরের খবরগুলো মিডিয়ার। সামাজিক মাধ্যমে এর চেয়েও ভয়াবহ সব খবর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের কারণে এখন যার যা খুশি যে যেমন ইচ্ছা লিখতে পারে। বলতে পারে। এই অবাধ স্বাধীনতার ব্যবহার, অপব্যবহার নির্ভর করে যিনি বা যারা লিখছেন বলছেন তাদের ওপর। আর সব বিষয়ের মতো আমরা বাঙালিরা এখানেও না মানি নিয়মকানুন না কোনো নীতি। ফলে সামাজিক মিডিয়াজুড়ে আতঙ্ক আর ভয়। ভয়ের ব্যাপার দেশের কিছু চিহ্নিত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক অন্যবারের মতো এবার এই বিষয়টি নিয়েও পানি ঘোলা করছেন। একটা সহজ সাধারণ বিষয় বুঝতে পারছি না। মোদির আসাটা বিষয় হলে তিনি এলেন ঢাকায়, গেলেন গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা আর মানুষ মরল কি না হাটহাজারী আর ব্রাহ্মবাড়িয়ায়। সারাদেশে যদি দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতো তাহলেও বুঝতাম। দু-একটি জায়গায় এমন উত্তেজনা বলে দেয় কারা এর পেছনে আর কী তাদের উদ্দেশ্য। নরেন্দ্র মোদি আমার পছন্দের কেউ না। ভারতের যে অসাম্প্রদায়িক ইমেজ, বহুকাল ধরে গান্ধী ও তার পরবর্তী নেতাদের হাত ধরে উঠে আসা ভারতের সে ইমেজ আজ বহুভাবে বাধাগ্রস্ত। নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি তার ইন্ধনদাতা। কিন্তু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী আর সুধীজনদের কাছে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। উপমহাদেশে অসাম্প্রদাকিতার দায় শুধু ভারতের? আমরা বা প্রতিবেশীরা কি সে দেশে মৌলবাদের বিস্তারে অবদান রাখিনি? ভারতের একপাশে পাকিস্তানে কি আসলেই কোনোকালে গণতন্ত্র ছিল না আছে? সেখানে কি সাম্প্রদায়িকতা নাই? সে দেশের নারীরা কি আসলেই ভালো থাকেন? অথচ পাকিস্তানের জন্য এসব বুদ্ধিজীবী ভক্তিতে গদগদ। তাদের দিলে রহমের স্রোত। আজ যদি ইমরান খান আসতেন আপনারা যারা ভাঙচুর করছেন, জনগণের সম্পত্তিতে আগুন দিচ্ছেন, রেলস্টেশন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, আপনারা কি ইমরান খান এলে একাত্তরের কথা মনে রেখে বাঙালি হত্যা, নারী ধর্ষণের জন্য এমন তাণ্ডব করতেন? আমি একবারও বলছি না মোদির ভারতে সবকিছু ঠিকঠাক। বরং গো মাংসের জন্য যে তাণ্ডব বা মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের ওপর যে অনাচার তা আতঙ্কের। কিন্তু আপনারা ভুলে গেছেন যে কাজ করে আপনারা রাগ বা প্রতিবাদ দেখাচ্ছেন তার সঙ্গে মূলত ধ্বংস আর দেশ বিরোধিতা জড়িয়ে। এর মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি বা ভারতের কিছু হবে না। সেটা আপনারাও ভালো জানেন। আপনাদের মূল টার্গেট আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা। তাই বঙ্গবন্ধুকে ছাড় দেননি আপনারা। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে আগুন লাগানো বা বাঁশ লাঠি নিয়ে হামলা কেন? কী এর ব্যাখ্যা? বহুদিন থেকে আপনারা চাইছেন শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলতে। আমরা এটা মানি নানা অশান্তি, লুটপাট আর অন্যায় হচ্ছে। তার দায় কি দেশের নিরীহ সংখ্যালঘু নামের গিনিপিগদের না রেলস্টেশন আর হাটহাজারীর রাস্তার? এগুলোর ওপর আপনাদের এত আক্রোশ? আপনাদের আক্রোশ মূলত বঙ্গবন্ধুর দেশটির ওপর। ভারত বিরোধিতা বাহ্যিক আবরণ মাত্র। এই অন্ধত্ব মানা যায় না। যারা জান হারালেন তাদের জান ফিরিয়ে দিতে পারবেন উসকানিদাতারা? অথচ এরা কেউ জানত না ২০১৫ সালে মোদির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে ছবি তুলে ধন্য হয়েছিল মামুনুল হক। আর সুযোগ পেলে এখনো তাই করবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, ৫০ বছরেও এই অপরাজনীতি শেষ হয়নি। বরং এখন তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বলতেই হবে এর দায় আওয়ামী লীগকেও নিতে হবে। তাদের দল সরকারে থাকার সময় যত লম্বা হচ্ছে দল তত মাঠহীন আর নির্জীব। এই দল যে বঙ্গবন্ধুর দল, এই দল যে রাজপথের দল এখন তা বোঝা মুশকিল। এত বড় ঘটনার পরও ব্রাহ্মণবাড়িয়া বা হাটহাজারী মূলত রাজনৈতিক প্রতিরোধহীন। যার কারণ দুটি। প্রথমত, আওয়ামী লীগে এখন আদর্শহীন স্বর্গপ্রত্যাশীদের ভিড়। শেষত, তাদের সে রাজনৈতিক শক্তি কেড়ে নিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ভোটহীন রাজনীতি। অচিরেই এসব দিকে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হলে দেশের অবস্থা আরো সঙ্গীণ হতে বাধ্য। এবার দুর্যোগ কাটাতে পারা মানে কি আগামীবারে তা হবে না? আর সবকিছুর সমাধান কি শেখ হাসিনা একাই দেবেন? নিয়ন্ত্রণ করবে নিয়মিত বাহিনী? মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা উন্নতিতে এমন হবেই, তাই মানুষকে জাগাতে হবে। সে কাজ করে বহুবার পথ দেখানো বাংলাদেশকে জাগাতে পারলেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পালাবে। আর তা না হলে কী হবে ভাবলেও ভয় জাগে বৈকি।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App