×

মুক্তচিন্তা

টেকসই উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২১, ১২:৫০ এএম

টেকসই উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা

বিশে^র অন্যতম দরিদ্র জনবহুল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যই ছিল দেশের সমৃদ্ধি, গণতন্ত্র, মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শোষণ ও বঞ্চনাহীন সমাজ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। কারণ তৎকালীন পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের প্রায় পুরো সময়টাই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে শোষণ ও নির্যাতনের জাঁতাকলে পিষ্ট করেছে। ফলে বাংলাদেশের জনগণ সে সময় অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা দূরের কথা, দুবেলা দুমুঠো ভাত ও পরিধানের বস্ত্র পাওয়াই ছিল অধিকাংশ মানুষের জন্য কষ্টকর। অনেক মানুষকেই তখন একবেলা, অর্ধবেলা অনাহারে থাকতে হতো। বাসস্থান বলতে গ্রামগুলোতে চোখে পড়ত শুধু কুঁড়েঘর আর কাঁচা ঘরবাড়ি। সে সময় রাজনীতিবিদরাও তাদের বক্তৃতায় আশ্বাস দিতেন ক্ষমতা পেলে দুবেলা দুমুঠো ভাত ও পরনের কাপড়ের ব্যবস্থা করবেন। তখন মানুষের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে এই আশার কথা শোনানোই ছিল রাজনীতিবিদদের মূল বক্তব্য। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের পাশাপাশি জনগণের ভাগ্য বদলের স্বপ্নের কথা বলেছেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে তাঁর সব কর্মসূচি ও বক্তৃতায় এ দেশের ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের উন্নয়নের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের জনগণের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত এক বিরাট জনগোষ্ঠী দরিদ্র ও হতদরিদ্রের কাতারভুক্ত। এদের মধ্যে এক বিরাট অংশ ভূমিহীন দিনমজুর, যারা শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। সেদিক থেকে এই নিকট অতীতেও বাংলাদেশের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ দরিদ্র ও হতদরিদ্রের শিকার ছিল। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্বাসনে সরকারের পাশাপাশি স্যার ফজলে হাসান আবেদের নেতৃত্বে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ব্র্যাক যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ও দরিদ্র জনগণের পুনর্বাসনে কাজ শুরু করে। স্বাস্থ্য কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। পরবর্তীতে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ চালু করে। তাদের এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় আশা, বুরো বাংলাদেশসহ আরো অনেক ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) এ পর্যন্ত ৭৩৫ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাকে সনদ প্রদান করেছে। দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ করে দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচিসহ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গৃহনির্মাণ, বিশুদ্ধ পানি ও উন্নত স্যানিটারি ব্যবস্থা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে এসব এনজিও এবং এমএফআই এক যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে এসব সংস্থা দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমে মোট দেড় লাখ কোটি টাকারও অধিক ঋণ প্রবাহ সৃষ্টি করেছে, যা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের ভাগ্য উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, গ্রামীণ মানুষের এক বিশাল অংশ এখনো ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক সেবার বাইরে রয়ে গেছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত বিশ^ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের ৫০ ভাগের ব্যাংক হিসাব রয়েছে। মোট জনসংখ্যার নারীদের ৩৫.৮ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সেবায় সম্পৃক্ত হতে পেরেছে। ২১.২ শতাংশ জনগণ মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত। ৯.৯ শতাংশ মানুষের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় রয়েছে এবং ঋণ রয়েছে ৯.১ শতাংশ ব্যক্তির। আর অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা। এর মধ্যে সরকার কর্তৃক কৃষক ও দরিদ্র নারী-পুরুষের জন্য যে ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে তার ফলেই এই পরিসংখ্যানের বৃদ্ধি ঘটেছে। তবে অধিকাংশ ১০ টাকার হিসাবেই কোনো লেনদেন না হওয়ায় তা দিনে দিনে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। গ্রামের ৩ কোটিরও অধিক দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ যারা ব্যাংকিং করার সুযোগ পায় না তারা MFI খাতের সদস্য হিসেবে ব্যাংকের মতোই টাকা জমানো ও ঋণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। অর্থনীতির জন্য এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক। মূলত গ্রাম ও শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত। ঋণপ্রাপ্তি নাগরিকের জন্য অধিকার হলেও সাধারণত এ দেশে অধিকাংশ ব্যাংকই দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের ঋণ প্রদানে অনীহা পোষণ করে থাকে। এ অবস্থায় এমএফআইগুলো এসব দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর ঋণ প্রদান কার্যক্রমের আওতায় ৩ কোটিরও বেশি সদস্য রয়েছে। তাদের গৃহীত কর্মসূচি ও উদ্যোগের ফলে ১ কোটিরও বেশি মানুষের আত্মকর্মসংস্থান হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতির প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি অর্থের জোগানদাতা হচ্ছে এসব ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা। এর ফলে অতীতের মহাজনী ব্যবস্থা প্রায় লোপ পেয়েছে। এমএফআইগুলো শুধু ঋণ প্রদান করে না, তারা গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে কর্মে উজ্জীবিত করে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশ আজ যে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে সক্ষম হয়েছে তার পেছনে সরকারের উন্নয়ন উদ্যোগের পাশাপাশি এই খাতের অবদানও অনেকখানি। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৮ ধাপ এগিয়ে এখন ১৬৮তম। এ দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতারও অনেক বৃদ্ধি ঘটেছে। দেশে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ২৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনপদে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছে- যেখানে নিজেদের আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক সময় যারা ৫-১০ হাজার টাকার ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছিলেন, এখন তাদের অনেকেই ৫-১০ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা নিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়েছেন। এভাবেই এমএফআই সেক্টর এখন বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি কথা বাস্তব সত্য যে, পরিবার নিয়ে গ্রাম আর গ্রামগুলো নিয়েই দেশ। স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি পরিবার যদি স্বাবলম্বী হয়, উন্নত হয় তবে বাংলাদেশও উন্নত দেশের মর্যাদা লাভ করবে। এমএফআই সেক্টর অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সেই কাজটিই করে যাচ্ছে। দেশে গ্রামপর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে, মানুষের জীবনমান বেড়েছে। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর অর্থমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। সেই দেশের বাজেট আজ ৫ লাখ কোটিকেও ছাড়িয়ে গেছে। জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশে^র ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে আমাদের অবস্থান ৩৩তম। এটি নিঃসন্দেহে উন্নয়ন ধারায় এক নতুন চমক। দেশের এই উন্নয়ন অভিযাত্রায় এনজিও/ এমএফআইয়ের সহায়তায় দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীও ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এক সময় এসব নিঃস্ব সর্বহারা মানুষ ছিল সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা। এখন তারা নিজেরাই অর্থনৈতিক শক্তি। এসব উন্নয়ন উদ্যোগের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা, গড় আয়ু, শিশু মৃত্যুর হার, বাল্যবিয়ে বন্ধ, মেয়েদের স্কুলে পড়ার হার, সামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ফলে দেশের এই উন্নয়ন এখন শুধু সাময়িক উন্নয়ন নয়- এ উন্নয়ন হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন।

জাকির হোসেন : নির্বাহী পরিচালক, বুরো বাংলাদেশ চেয়ার, এনজিও ফেডারেশন (এফএনবি)।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App