×

মুক্তচিন্তা

ফাদার টিমের যুদ্ধদিনের চিঠি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২১, ১২:২১ এএম

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ফাদার টিম ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের দুজন সিনেটরকে বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বর্ণনা করে চিঠি লিখলেন। তাদের একজন বার্চ বে, অন্যজন ভ্যান্স হার্টকে। বার্চ এভান্স বে জুনিয়র (জন্ম ১৯২৮-মৃত্যু ২০১৯) ১৯৬৩ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ইন্ডিয়ানার সিনেটর ছিলেন। তিনি সবচেয়ে কম বয়সি স্পিকার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিলের উপস্থাপক হিসেবে পরিচিত। এডওয়ার্ড কেনেডির সঙ্গে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় সামান্য আহত, কিন্তু কেনেডির গুরুতর জখম হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন, কিন্তু প্রাইমারিতে হেরে যান। তিনি একজন ডেমোক্র্যাট। রুপার্ট ভ্যান্স হার্টকে (১০১৯-২০০৩) ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ইন্ডিয়ানার সিনেটর ছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে তার তীব্র বিরোধিতা তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। ভিয়েতনাম নিয়ে একটি গ্রন্থসহ তার প্রকাশনা তিনটি। তিনিও ডেমোক্র্যাট। একাত্তরে দুজনই বাংলাদেশের পক্ষে লড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিপীড়নের যেসব বিবরণী আলোচিত হয়েছে তার অন্যতম জোগানদার প্রত্যক্ষদর্শী ফাদার টিম। দুই সিনেটরকে তিনি লিখেছেন: আমি ইন্ডিয়ানার মিশিগান সিটির একজন হলিক্রস ধর্মযাজক। ১৯৭১ সালের ফরেইন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্ট-এ স্যাক্সবি চার্চ সংশোধনীর সহ-প্রস্তাবক হওয়ার জন্য আপনাদের দুজনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি (এতে সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি এবং সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ পাকিস্তানের জন্য মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধের প্রস্তাব করেছিলেন)। বাঙালি শরণার্থীদের ভারত থেকে ফিরে আসার মতো পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত আমেরিকার হাত গুটিয়ে রাখার নীতি অবলম্বন করা আজ বিশেষ জরুরি। আমি স্থানীয় সংবাদপত্রে দেখেছি (ইসলামাবাদে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত) মিস্টার রজার্স পাকিস্তানের উন্নয়ন সহায়তার ওপর থেকে সাময়িক মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা বাইরের দেশগুলোকে চাতুর্যের সঙ্গে এমন ধারণা দিচ্ছে যে, এখন যে মার্কিন সহায়তা দেয়া হবে তা কখনো ফ্যাসিস্ট সামরিক শাসনকে সহায়তা করবে না। চোখে পড়ার মতো সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে সংবাদপত্রের সেন্সরশিপ প্রত্যাহার এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা। তাহলে জেনে রাখুন সংবাদপত্রের সেন্সরশিপ প্রত্যাহার করার আগের দিন সামরিক আইন আদেশ নম্বর ৮৯ জারি হয়Ñ তাতে বলা হয়, পাকিস্তানের কল্যাণের পথে বাধা প্রধান হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারেÑ এমন যে কোনো প্রকাশনা ও প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হবে। আসল কথা, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। সাধারণ ক্ষমার ঘোষণাটি দেয়া হয় ৫ সেপ্টেম্বর আর তার পরদিন খবরের কাগজগুলোতে ছবি ছাপা হয় যে কয়েদিদের জেলখানা থেকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। আসলে এই মুক্ত কয়েদিনের একজনকেও কেউ বাস্তবে দেখেনি। যাদের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দেয়া হয়েছে তাদের একজনের নামও সাংবাদিকরা সরকারের কাছ থেকে জানতে পারেননি। অধিকন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের ‘জনগণের শত্রু’ আখ্যা দিয়ে জবাই করা অব্যাহত রয়েছে, তাতে এতটুকুও হ্রাস ঘটেনি। ক্যাথলিক রিলিফ সার্ভিসের ত্রাণ কর্মসূচির মাঠ সমন্বয়কারী হিসেবে আমি গতকাল টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলা সফর করে এসেছি। আমি দেখেছি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো সম্পূর্ণভাবে লুটতরাজের শিকার হয়েছে এবং আগুনে ভস্মীভূত করা হয়েছে। আমি দেখেছি শতাব্দীর প্রাচীন একটি হিন্দু মন্দির যাচ্ছেতাইভাবে ধ্বংস করা হয়েছে এবং হিন্দুদের মধ্যে ধর্মান্তরিত হতে যারা অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতনের কাহিনী শুনে এসেছি। মধুপুরের একজন বিশিষ্ট হিন্দু (অমূল্য বাবু) তাদের হাতে নিহত হওয়ার তালিকায় রয়েছেন, অথচ পাকিস্তান সরকার তাকে জনসেবার সর্বোচ্চ পুরস্কার তখমা-ই-খিদমত প্রদান করেছে। পরপর তিনবার তিনি টাঙ্গাইল জেলার বছরের সেরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত, উন্নয়ন কর্মে তিনি ছিলেন অসাধারণ, তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নয় বরং মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। তার একমাত্র ‘অপরাধ’ তিনি হিন্দু। বর্তমানে তিনি গা ঢাকা দিয়ে আছেন আর তার পরিবার বাস করছে জলছত্র মিশনে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন ছোট একটি মাত্র উদাহরণ তুলে ধরলাম। বাঙালিদের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে আমি চিন্তিত নই, কিন্তু আমি আপনাদের বলতে পারি ৩ দিনের সফরকারী এবং বিদেশি সাংবাদিকরা খুব সহজে বের করতে পারবেন না যে, (১) সকল বাঙালি সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করে, প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে তাদের সহিংসতার স্বীকার হয়েছে। (২) প্রত্যেক বাঙালিই সেনাবাহিনী নিয়ে শঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেÑ কখন তার এবং তার পরিবারের ওপর আঘাত হানে। এমনকি বাঙালিদের মধ্যে এখনো যারা সংযুক্ত পাকিস্তান চায় তারাও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ। সেই নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে যেন বা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে সব সমস্যা গুঁড়িয়ে দেয়াটাই একমাত্র সমাধান। চিঠিটির এখানেই সমাপ্তি। তার স্মৃতিকথা থেকে আরো কিছু অংশ অনূদিত হলো : যারা ভারতে চলে গেছে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান সরকার তাদের ব্যাপারে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে শুরু করে। কয়েকদিন আগে আমি ফাদার হোমরিচের সঙ্গে ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা কারাগার থেকে একটি উপজাতি বালককে মুক্ত করার উদ্যোগ নিইÑ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে ভারতে গিয়েছিল। এই ছেলেটির জন্য ফাদার হোমরিচ পাঁচবার মুক্তাগাছা এসেছেন এবং চারজন মুসলমানকে সাক্ষী হিসেবে তাদের কাছে হাজির করেছেন যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন যে বালকটি ভারতে যায়নি, কখনো বাড়ি ছেড়েই বেরোয়নি। তাকে আরো পাঁচজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সঙ্গে একটি সেলে রাখা হয়েছেÑ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও আমরা বালকটিকে কারামুক্ত করতে পারিনি। একই সফরে আমরা টাঙ্গাইলের শিবগঞ্জে এসেছি, এখানে ১ মাস আগে ১২০টি হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন হিন্দুরা অন্যত্র কেউ মুসলমানদের সঙ্গে, কেউ গারোদের সঙ্গে কিংবা কেউ অন্য কোথাও অবস্থান করছে। তাদের একজন শিক্ষক এবং এখন শেষবর্ষের শিক্ষার্থী, আমাদের বললেন তার হেডমাস্টার তাকে সতর্ক করে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যেতে বলেছেন। আর এখানে থেকেও যদি মুসলমান না হয় তা হলে কেটে গায়ে লবণ লাগিয়ে দেয়া হবে। ফুলবাড়িয়া বাজারে টুপি পরা একজন হিন্দু ডাক্তারের দেখা পাইÑ আত্মা হারিয়ে ফেলা একজন মানুষ, তাকে ধর্মান্তর করিয়ে মুসলমান বানানো হয়েছে। অবশ্য মুসলমানরা আমাদের বলেছেন, তরবারি দিয়ে ধর্মান্তরিত করার ইতিহাস ইসলামে নেই, এখানেও জোরাজুরি করা হয়নি। তারা অবশ্য বিষয়টির একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছে- পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পৌঁছার আগে আগে যদি তারা মুসলমান না হন তাহলে অত্যাচারিত হবেন। অবশ্য সেনাবাহিনী এসে বন্দুকের নলের মুখে ধর্মান্তরিত করার ব্যাপারটাতে তারা অনেক দেরি করে ফেলেছে- অনেকেই চলে গেছে। খ্রিস্টান হওয়ার জন্য হাজার হাজার হিন্দু ক্যাথলিক মিশনে এসে ধর্ণা দিচ্ছে। ক্যাথলিক নীতি তখনই তাদের ধর্মান্তরিত করা নয়। তাদের ক্রস পরতে দেয়া হয় এবং সম্প্রদায়ভুক্ত করা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও যদি কেউ ধর্মান্তরিত হতে আগ্রহী থাকেন কেবল তখনই তাকে ব্যাপটইজ করা হয় (কেউ এভাবে ব্যাপটাইজড হয়েছে, এমনটা আমি দেখিনি)। ময়মনসিংহের পাকিস্তানি মিলিটারি কমান্ডার ফাদার জ্যাকব দেশাইকে জিজ্ঞেস করেছেন, তাহলে তারা মুসলমান হচ্ছে না কেন? ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে যাত্রীদের সঙ্গে আমাদের তিনটি সেতুতে তিনবার নামতে হয়। আমাদের দেহ তল্লাশি করা হয় এবং হেঁটে সেতু পার হতে নির্দেশ দেয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ সেখানে বড্ড বাড়াবাড়ি করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পুলিশ গোটা ঢাকাজুড়ে রোড ব্লকেড দিলেও মুক্তিবাহিনীর আগমন ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। ১২ সেপ্টেম্বর মতিঝিলে নগরের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে নটর ডেম কলেজের কাছে একটি বড় গাড়ি থামে, যাত্রীরা নেমে প্রহরারত রাজাকারদের নিরস্ত্র করে এবং পাঁচজনকে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নেয় এবং একজনের হাতে একটি চিঠি দিয়ে তাকে ফেলে রেখে যায়। সেই চিঠিতে বলা হয়, তারা চাইলে শহরের কেন্দ্রে যে কোনো সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় আমি একটি আপ্তবাক্য পাঠ করেছিলাম : মৃতের সংখ্যা যত বেড়ে যাবে মৃতের জন্য কষ্ট ততটাই কমে আসবে। বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে এ এক চরম সত্য বাক্য। উত্তর আয়ারল্যান্ডে দশজনের মৃত্যু যতটা নাড়া দিয়েছে এখানে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু তার চেয়ে বেশি নাড়া দিতে পারেনি। ডক্টর রোহড ইউএসএআইডির প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন সিনেটর স্যাক্সবিকে লেখা তার চিঠি মার্চে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেছে। ডক্টর জন রোহডকে লেখা অনেক চিঠির একটিতে ফাদার টিম লিখেছেন : গত চিঠিতে আমি আপনাকে জানিয়েছিলাম মুক্তিবাহিনী নারিকেলবাড়ি এলাকার ডাকাতগুলোকে একেবারে সাফ করে দিচ্ছে। সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে পাকিস্তানি আর্মি বহুগুণ বলশালী হয়ে সেখানে হাজির হলো এবং নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকল। এক বৃদ্ধার মৃত্যু হলো। পরদিন সকালে তারা তিনজন খ্রিস্টান জেলেকে ডাকল। একজন দ্রুত না আসায় তারা তাকে গুলি করল, তার ছেলের মাথায়ও গুলি করল। বিশপ জোয়াকিম (চট্টগ্রামের) এবং ফাদার ডেমার্স সেদিন মিশনে ছিলেন। সৈন্যরা তাদের অভিযুক্ত করল, কারণ মিশনে আহতদের চিকিৎসা করা হয়। আমি বিশপ জোয়াকিমকে বললাম, পাকিস্তান আর্মিকে তার বলা উচিত ছিল এমনকি হিটলারও জখম হওয়া নারী ও শিশুদের পরিচর্যা করতেন। প্রায় ৬০ বছর বাংলাদেশে থেকেছেন ফাদার টিম। এ দেশের মানুষের সঙ্গে তিনি মিশে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বন্ধু, ১৯৭১-এর সহযোদ্ধা রেভারেন্ড রিচার্ড উইলিয়াম টিম ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে সাউথ বেন্ড শহরে ৯৭ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App