×

সারাদেশ

উল্টো পথে মাইক্রোবাস, সাজিদের পিকনিকের আনন্দ পথেই ম্লান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২১, ০৮:০৯ পিএম

উল্টো পথে মাইক্রোবাস, সাজিদের পিকনিকের আনন্দ পথেই ম্লান

দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বাস-মাইক্রোবাস। ছবি: ভোরের কাগজ

‘একটি দুর্ঘটনা কান্না, সারা জীবনের কান্না’- এটি যে এভাবে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে শামসুন্নাহারের জীবনে সেটি মিনিট পাচেঁক আগেও ভাবতে পারেন নি। ভাগ্নে বউয়ের সঙ্গে সবশেষ কথা হয় আড়াইটার দিকে। তার পাঁচ মিনিট পরই স্বামী, বোন ও দুই শিশু সন্তানসহ চিরবিদায় নেন তিনি। মাজার জিয়ারত ও পিকনিকের আনন্দ ম্লানই হয়ে গেল সাজিদ-সাবাহর।

শুক্রবার (২৬ মার্চ) দুপুর আড়াইটার দিকে রাজশাহী নগরীর কাটাখালির কাপাসিয়া এলাকায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মা-বাবার সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছে দুই ভাই-বোন সাজিদ-সাবাহ। একই পরিবারের পাঁচ সদস্যসহ প্রাণ গেছে অন্তত ১৭ জনের। এ সময় অনেকেই আহত হয়েছেন। তবে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে উল্টোপথে মাইক্রোবাস চালকের গাড়ি চালানোকে দায়ী করা হচ্ছে।

সড়ক দুর্ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ভোরের কাগজের হাতে এসেছে। যাতে দেখা যাচ্ছে, কালো রংয়ের একটি মাইক্রোবাস রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক দিয়ে রাজশাহী নগরীর দিকে যাচ্ছিল। তবে সেটি উল্টো পথে। অন্যদিকে রাজশাহী থেকে হানিফ পরিবহনের যাত্রীবাহী একটি বাস ঢাকা যাওয়ার পথে কাটাখালি থানার সামনে পৌঁছলে উল্টোপথে চলতে থাকা মাইক্রোবাস ধাক্কা দেয়। এ সময় বাসটি সড়ক থেকে ছিটকে থানার গেটের সামনে চলে যায়। আর মাইক্রোবাসটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। তাতে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ধরে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মাইক্রোবাসে অগ্নিকাণ্ডের ১০ সেকেণ্ডের মধ্যেই মারা যান অন্তত ৮ ব্যক্তি। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় কারো চেহারা চেনা যাচ্ছিল না।

প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের মধ্যে শামসুন্নাহারের পরিবারেরই রয়েছেন চার সদস্য। ২০ বছর আগে গ্রামে এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী শাজাহান তোতাকে হারিয়েছেন তিনি। পরে বিয়ে করেন সালাউদ্দীন নামে আরেকজনকে। সালাউদ্দীন-শামসুন্নাহার দম্পতির ঘরে আসে ফটফুটে দুই সন্তান সাজিদ (৫) ও সাবাহ (৩)। বড় ছেলে সাজিদকে স্কুলে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন করোনাকালীন ছুটির পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেই। কন্যাশিশু সাবাকে নিয়েও স্বপ্ন ছিল ঢের। কিন্ত মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে গেলো এসব প্রাণ। বোন কামরুন্নাহারের সঙ্গে প্রাণ গেল তারও। তথ্যগুলো জানাচ্ছিলেন তার ভাগ্নে বউ চম্পা খাতুন।

তিনি জানান, তার ফুফাতো শাশুড়ি শামসুন্নাহার রাজশাহীর হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) এর মাজার জিয়ারত এবং পিকনিকের জন্য রাজশাহী আসছিলেন পুরো পরিবারসহ। তাদের ছেলে সাজিদ ও মেয়ে সাবাহ দেখতে চেয়েছিলেন মনীষী হযরত শাহ মখদুম (রহঃ) এর মাজার। ফলে একই এলাকার আরো চার পরিবারের সঙ্গে যৌথভাবে মাইক্রোবাস ভাড়া করে রওনা দেন মাজার জিয়ারত ও পিকনিকের জন্য।

সবশেষ দুপুর সোয়া দুইটার দিকে মোবাইলে কথা হয় তার। এর কিছুক্ষণ পরই শুনতে পান সড়ক দুর্ঘটনার খবর। জানতে পারেন সাজিদ-সাবাহ আর বেঁচে নেই। প্রাণ হারিযেছেন তার ফুফাতো শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেই।

সাজিদ-সাবাহর চাচা মতিউর রহমান জানান, এমন মৃত্যুতে তারা ভেঙে পড়েছেন। তার ভাবি শামসুন্নাহার সারাজীবন কষ্ট করেও সুখের দেখা পেলেন না। আগে একবার স্বামীকে হারানোর পর আবারো বিয়ে করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের জননীও হন। কিন্ত সড়কেই জীবনটা চলে গেল শামসুন্নাহারের।

জানা গেছে, শামসুন্নাহারের পরিবার ছাড়াও আরো চার পরিবারের ১২ জন মারা গেছেন এদিনের সড়ক দুর্ঘটনায়। নিহতরা সবাই মাইক্রোবাসের যাত্রী। তবে বাসের কয়েকজন যাত্রী আহত হলে তাদেরকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

রাজশাহী সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট পদে কর্মরত নূর মোহাম্মদ নিহতের পরিবারের একজন সদস্য। তিনি জানান, বড় মজিদপুর এলাকায় তার সেজ বোন নাজমা খাতুন থাকতেন। কিছুদিন আগে কথা হয় তারা রাজশাহী আসবেন তার বাসায় বেড়াতে। নাটোরে এসেও নাজমা ফোন দেন তার ভাই নূর মোহাম্মদকে। কিন্তু পথেই ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ফলে তার বোন মোসা. নাজমা খাতুন (২৮), ভাগ্নে ফয়সাল আহম্মেদ (১৩), দুই ভাগ্নি মোসা. ছামিহা (৮) ও মোসা. সুমাইয়া (৪) এবং দুলা ভাই মো. ফুলমিয়া (৩৫) মারা গেছেন। ঘটনাস্থলে এসে কাউকে জীবিত পাননি নুর মোহাম্মদ।

এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, মাইক্রোবাস ওই বাঁশের ভ্যানটি ওভারটেক করার মুহুর্তে বাসটি ঢুকে পড়ে এবং মাইক্রোবাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এতে মাইক্রোবোসের ড্রাইভারসহ ১৭ জন যাত্রী নিহত হয়। তারপরও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী দুর্ঘটনার কারণ গভীরভাবে অনুসন্ধান করছে। দুর্ঘটনা কবলিত মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App