×

পুরনো খবর

ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বাংলাদেশ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২১, ১২:৪৫ এএম

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স যখন ৫০ বছর, নিজেও যখন সত্তর পেরিয়ে সামনে, তখন পেছনের দিকে তাকাবার সুযোগ ঘটে- নিঃশব্দ আনমনে অথবা অজস্র শব্দরাজিতে সচকিত হয়ে। প্রিয় মাতৃভূমির পথযাত্রা নিয়ে ভাবি, আমাদের প্রজন্মের ফেলে আসা রাতদিনের কথা নিয়ে ভাবি। ভাবি, পেছনের সময়গুলো যে কেবলই সত্য ও সুন্দরের ছিল, সাফল্যের ছিল, তা তো নয়; অনেক কুৎসিৎ, অসত্য ও অসুন্দরের কাল পেরিয়েছি আমরা- যা এই স্বদেশভূমিকে যন্ত্রণার ইতিহাসে ভরিয়েছে। তাই সব মিলিয়ে, কখনো কখনো ভাবি, জীবন তো একটাই, তবে ক ব্যর্থ হলো! বুঝি সাফল্য ও ব্যর্থতা দুই-ই আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। পাকিস্তানি সেনাতন্ত্র ও উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার গণমানুষের যে বিদ্রোহ তা ছিল বাঙালির বড় জাতীয় সাফল্য, জাতীয় ইতিহাসের এক অনন্য পালাবদল। আজ থেকে ৫০ বছর আগের ইতিহাস তৈরিতে বাঙালি একদিকে যেমন একটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ার সাফল্য দেখিয়েছে, তেমনি জাতিসত্তা বিভাজনের বিষবৃক্ষগুলোকে চিহ্নিত করে সামনে অগ্রসর হবার সবলতা পেয়েছে। সে ছিল এক বিশাল অর্জন- যা স্থায়ী হয়নি; আমাদের চোখের সামনে দিয়ে পুরনো অন্ধকার আবারো ধেয়ে এসেছে। ব্যর্থতার কালিমায় কলঙ্কিত হয়েছি সকলে। সেই যখন ব্যর্থতার পাল্লা ভারি, যখন নিক্ষিপ্ত হয়েছি যন্ত্রণার কর্দমায়, জাতিসত্তার প্রতিপক্ষ দানবেরা ভাগাড় থেকে বেরিয়ে যখন রক্তস্নাত স্বাধীনতাকে তাড়া করেছে, লাখো শহীদের আত্মাকে আঘাত করেছে, মনে পড়ে, আমরা কায়মনবাক্যে তখন আবারো এক সূর্যস্নান কামনা করেছি, স্নাত হতে চেয়েছি সেই রক্তিম রশ্মিতে- যা ১৯৭১-এর, আমাদের জেনারেশনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূর্যের। সেদিনের পরাজয়গুলোকে অধিকাংশেই পরাভূত করতে পারিনি আমরা; হেরে গেছি বেশির ভাগ। যখন পারিনি তখন চেয়েছি পশুত্বের বিরুদ্ধে মনুষত্বের আবাহন, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর অবগাহন, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্য ও সুন্দরের বারিপাত। সেই সব বিপন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের মুখ খুঁজেছি, টুঙ্গিপাড়ার কবর থেকে জেগে ওঠা রাষ্ট্রজনকের বজ্রকঠিন কণ্ঠ খুঁজেছি, লাখো বিষণ্ন অপমানিত বাঙালি নারীর কান্না দেখেছি, রাষ্ট্র ভাণ্ডারে জমা দেয়া নিজেদের পুরনো অস্ত্র খুঁজতে চেয়েছি। আমাদের প্রার্থনাগুলো কখনো সার্থক হয়েছে, কখনো হয়নি। যখন হয়নি তখন অস্থির হয়েছি, অপমানিত হয়েছি, ক্রদ্ধ হয়েছি। একাত্তরের সহযোদ্ধারা ৫০ বছরের ব্যবধানে আজ বিদায়ের ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছেন, তাদের মৃত্যুর খবর আসে প্রতিনিয়ত। কবরের পর কবর তৈরি হচ্ছে গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাচ্ছে বাংলাদেশ, যে সম্মান তাদের প্রাপ্য। আমার বিশ^াস, কবরের এই মিছিল যতোই না বিদায়ের ততোই তা একাত্তরের অবিনাশী আত্মার নতুন জেগে ওঠার। ওদের শেষ নিঃশ^াস যেমনি সত্য তেমনি সত্য ওদের অকুতোভয় আত্মার বিকশিত রশ্মি। শান্তি পাই যখন দেখি বিস্তর অবরোধের মাঠ পেরিয়ে আমার প্রিয় স্বদেশ হেঁটে চলেছে সামনে, দৃপ্ত পায়ে; তৃপ্তি লাভ করি যখন দেখি বাংলার পতাকা হাতে নবতারুণ্য স্বদেশের নাম এঁকে দিচ্ছে বিশে^র সকল আঙিনায়। বলাই যায়, আমি বা আমরা অনেকেই একাত্তরের সূর্যবলয় থেকে বেরুতে পারিনি, সম্ভব হয়নি, যদিও আমার পাঠকেরা কেউ কেউ একে ব্যর্থতা বলবেন, হয়তো কেউ অভিশাপ দেবেন- গণ্ডি থেকে না বেরোবার চরম দুর্গতি বলবেন। দ্বিধা নেই বলতে, সে ব্যর্থতা আমাদের, আমার প্রজন্মের রাজটিকার গৌরব, যা হেলায় হারাতে রাজি নই। না, এই বেরোতে না পারার যুক্তি ব্যক্তির সীমায় আবদ্ধ নয়, এই কারণে যে, বিগত ৫০ বছরে এই প্রিয় মাতৃভূমি আক্রান্ত হয়েছে, এবং বারবার, এতোকাল পরেও সে বিপদমুক্ত হয়নি আজো। অতএব যাকে ভালোবেসে যুদ্ধে নেমেছিলাম, সেই সুন্দরকে প্রতিরক্ষা দেয়ার তাগাদা সকল তাগাদার চাইতে বেশি জরুরি মনে হয়েছে। এতে যদি কারো মনোকষ্ট হয়- হোক, আমার বা আমাদের কীইবা করার আছে। বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, হবে আরো; গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকসহ বহুবিধ শিল্পকর্ম সৃষ্ট হয়েছে ১৯৭১ নিয়ে, বাঙালির জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাল নিয়ে; শিল্পসাহিত্যের ক্যানভাসে বাক্সময় হয়েছে সেই সময়, সেই মানুষ, সেই সুখ-দুঃখ, ক্রোধ ও আশা-নিরাশা। আমিও কলম ধরে আছি নিরন্তর; তারপরেও তো এক শূন্যতা বিরাজমান, বড় আক্ষেপ যে- যেন কিছুই পূর্ণ হলো না আজো; পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরা সম্ভব হলো না বাঙালি প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ যৌবন! এ ব্যর্থতা শিরোধার্য। তবে আমার একান্ত বিশ্বাস যে, একদিন না একদিন অসীম সাফল্যের রাজটিকা মাথায় তুলবেন নতুন শিল্পসাধকেরা, যারা আসছেন আমাদের পরের সময়ে। জানি, সেই সাফল্য হবে নতুন নাগরিকদের কাছ থেকে অসীম পাওয়া, পুরনোর জন্যে নতুনের শ্রেষ্ঠ উপঢৌকন। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামজিক শক্তি, বহুবিধ সংকট-সীমাবদ্ধতার পর, আজ রাষ্ট্রমঞ্চে সমাসীন। যে আদর্শে এই রাষ্ট্র তার কাণ্ডারিরা যখন নিজেরাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক তখন তা এক বড় তৃপ্তির মঞ্চ আমাদের। কিন্তু ভয় হয় যখন সেই শক্তি গতানুগতিক হবার শঙ্কা তৈরি করে, নিজেকে অধিকতর যোগ্য করে তোলার প্রয়োজন বোধ করে না, আত্মতুষ্ট থাকে, কিংবা অন্যের সঙ্গে নিজের তফাত রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। এই তফাত বড় বেশি প্রয়োজন, তা নাহলে আগামীর সময় সত্য ও সুন্দরের তফাত গুলিয়ে ফেলবেÑ যা হবে বড় বিপর্যয়। অতএব প্রয়োজন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের আদর্শিক সৈনিকÑ কেবল ক্ষমতার সৈনিক নয়। মনে রাখা উচিত যে, জয়বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু কেবল কণ্ঠে উচ্চারণেরই নয়, একে ধারণ করতে হবে হৃদয়ে; এ না হলে বাংলাদেশ অরক্ষিত হবে, ভালো-মন্দ, শুভ ও অশুভ একাকার হবে; যা হবে জাতীয় বিপর্যয়। আরো একটি অনুভূতি ব্যক্ত করি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মহালগ্নটি যেন গতানুগতিকতায় বদ্ধ না হয়। পঞ্চাশ বছর পরের এই মহালগ্ন ঘিরে, আমার একান্ত প্রত্যাশা, শুরু হোক এমনই এক নবজাগৃতিÑ যা বাঙালিকে বিশাল করবে, মানবিক করবে, হৃদয়ের সকল কালিমা ঘুচিয়ে মুক্ত করবে। কারণ অনেক অর্জনের পরেও আমাদের মনুষ্যত্বের অর্জন আজো সীমিত। বাঙালি সত্য ও সুন্দরের মাল্যে ভূষিত হোক, মনুষ্যত্বের মাল্যে ভূষিত হোক, সাম্প্রদায়িকতার কলুষতা থেকে মুক্ত হোক- এই প্রার্থনা করি।

হারুন হাবীব : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App