×

মুক্তচিন্তা

শাল্লার নোয়াগাঁও : কলম আর চলতে চাইছে না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২১, ১২:০৭ এএম

গত বুধবারের ঘটনা। ঘটনাস্থল সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে। ইসলাম অবমাননার মিথ্যা এবং চিরাচরিত অভিযোগে এলাকার এবং আশপাশের গ্রামের হেফাজত সমর্থক উগ্রপন্থিরা ওই গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে তাÐব চালিয়ে হিন্দুদের শতাধিক বাড়ি ও বেশ কয়েকটি মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট করে বাধা-বিপত্তিহীনভাবে চলে যায়। তারা একটি মন্দির থেকে একটি কষ্টিপাথরের মূর্তিও নিয়ে যায়। কারণ? আগের দিন ওই গ্রামে হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মুমিনুল হক ওয়াজ করেন। ওয়াজ করাকালে, প্রত্যক্ষদর্শী ও শ্রোতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘উসকানিমূলক সাম্প্রদায়িক’ বক্তব্য দেন। জানা যায়, ওই গ্রামের ঝুমন দাশ আপন নামের এক যুবক ফেসবুকে মুমিনুল হকের ওই বক্তব্য ‘সাম্প্রদায়িক ও আপত্তিকর’ এই জাতীয় কথা তার ফেসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট দেন। সঙ্গে সঙ্গে পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ ঘটনা জানা মাত্রই কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা জানিয়ে পোস্ট দেন। পরদিন ১৮ মার্চ সকালে ৭১ টেলিভিশন ও অপর কোনো কোনো চ্যানেলে খবরটি সচিত্র প্রচার করা হয়। বেশিরভাগ জাতীয় দৈনিকে সবিস্তারে ওই ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই ঘটনাকে নিয়ে আজকের এই নিবন্ধ। এ জাতীয় বহু ঘটনা দশকজুড়ে ঘটে আসছে, এগুলো নিয়েই লিখেছি। কিন্তু এ ঘটনাটি এমনই হৃদয়ে আঘাত করেছে এতটাই যে, লিখতে বসলেও কলম আর চলতে চাইছে না। কতই বা লেখা যায় একই জাতীয় ঘটনা নিয়ে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত পত্রিকাগুলোর বর্ণনা পড়ে বাধ্য হয়েই না লিখে পারছি না। একটি জাতীয় দৈনিক ১৮ মার্চের সংখ্যায় ‘নোয়াগাঁওকে আর এক রামু বানাল হেফাজত’ শীর্ষক দুই কলাম শিরোনামে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছে : ‘গ্রামের সবাই যখন দৌড়ে পালাচ্ছিলেন, তখন চিৎকার করে তাদের বাড়ি ছেড়ে না যাওয়ার অনুরোধ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সত্তরোর্ধ্ব জগৎ চন্দ্র দাশ। সবাই তাকে ফেলেই দৌড়াতে থাকেন। ছেলে লিটন দাশ পালানোর মনস্থির করলেও বাবার এই অবস্থা দেখে তিনিও বাড়িতে থেকে যান। এর কিছুক্ষণ পরেই তাদের বাড়িতে হামলা হয়। চলে ভাঙচুর, লুটপাট। গত বুধবার ১৭ মার্চ সকাল ৮টা থেকে টানা ঘণ্টাব্যাপী সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে এভাবে হামলা করে শতাধিক বাড়িঘর এবং পাঁচটি মন্দির ভাঙচুর করে হেফাজত সমর্থকরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মামুনুল হককে ‘কটাক্ষ’ করে স্থানীয় যুবক ঝুমন দাশ আপনের একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে এই তাÐব চলে। কক্সবাজারের রামু হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, পাবনার বনগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুরের পীরগাছার ঘটনা দশকব্যাপী ঘটার পর সর্বশেষ সুনামগঞ্জের নোয়াগাঁও গ্রামে তাÐব সবটাই একই সূত্রে গাথা। এই অভিযোগ ফেসবুকে ধর্ম অবমাননা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ মার্চ দিরাইয়ে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আসেন মামুনুল হকসহ সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা।  মামুনুল হক ওই সমাবেশে নানা উসকানিমূলক কথাবার্তা বলে যান। এরই প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে পরদিন শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাশ আপন তার ফেসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি মামুনুল হকের সমালোচনা করেন। এই পোস্ট দেয়াকে ‘ধর্মীয় উসকানি’ আখ্যা দিয়ে হেফাজত নেতার অনুসারীরা উত্তেজনাকর সেøাগান দিয়ে রাতের বেলায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় গ্রামবাসীই ঝুমনকে ধরে পুলিশে হস্তান্তর করেন। ঝুমন পুলিশ হেফাজতেই আছেন। গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন মঙ্গলবার বিকাল থেকেই তারা শুনছিলেন তাদের গ্রামে হামলা হতে পারে। কাশিপুর, চÐীপুর ও নাচনী গ্রামে মাইকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছিল। এতে ঘরে ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন রাত ৮টার দিকে হবিবপুর, নোয়াগাঁওয়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বৈঠকে বসেন। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া ঝুমন দাশকে গ্রামের লোকজনকেই আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। এরপর ঝুমনকে ধরার জন্য প্রত্যেকটি সম্ভাব্য স্থানে মোটরসাইকেলে লোক পাঠানো হয়। রাতে উপজেলার স্বাখাই বাজার থেকে ঝুমনকে গ্রামের লোকজনই আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এরপর গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জড়ো হয়ে পুলিশ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ফোন করেন। তারা সবাই আশ্বাস দেন, এখন আর কিছু হবে না, সবাই যার যার বাড়িতে অবস্থান করেন। কিন্তু পরদিন সকাল ৭টা থেকে দিরাইর, নাচনী, চÐীপুর ও শাল্লা উপজেলার কাশিপুর গ্রামের মসজিদের মাইকে সবাইকে একত্রিত হওয়ার আহŸান জানানো হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই সকাল ৮টার দিকে কয়েকশ মানুষ দেশি অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে একযোগে হামলা করে। তার আগে মানুষ জমায়েত হওয়ার ব্যাপারে প্রচারিত সংবাদ নোয়াগাঁও গ্রামে পৌঁছলে গ্রাম থেকে থানায় ফোন করে জানান হয়। হামলাকারীরা হিন্দুদের বাড়ি খুঁজে খুঁজে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ভাঙচুর করা হয় গ্রামের চÐী মন্দির, দুর্গা মন্দির, কালী মন্দির, শিব মন্দির ও বিষ্ণু মন্দির। এর আগেই এসব মন্দিরের পুরোহিতরাও প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে হাওরের দিকে চলে যান। প্রায় এক ঘণ্টা সম্পূর্ণ বিনা বাধায় চলে তাÐব। পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। মুক্তিযোদ্ধা জগৎ চন্দ্র দাশের ছেলে লিটন দাশ বলেন, আমাদের বাড়িতে নাচনী গ্রামের ইউপি সদস্য স্বাধীন মিয়া ও পক্কন মিয়া বলছিল ‘এটি জগদীশের বাবার বাড়ি। ভেঙে গুঁড়িয়ে দাও’। লিটন বলেন, এ কথা আমি ওপর থেকে শুনছিলাম। তবে দরজা ভাঙতে না পেরে আমাদের মাঝের হাটির অন্য বাড়িতে চলে যায়। পরে আবারও ফিরে এসে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রবীণ হওয়া সত্তে¡ও তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে। বাবা পরে তার শোকেসের ড্রয়ার থেকে ১০ হাজার টাকা এনে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলে তারা টাকা নিয়ে চলে যায়। গ্রামের অসীম চক্রবর্তী জানান, তার বাড়ির বিষ্ণু মন্দির ভাঙচুর করে শত বছরের পুরনো কষ্টিপাথরের বিষ্ণুমূর্তি নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। স্থানীয় হবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ দাস জানিয়েছেন, হামলাকারীরা তার নিজের ঘরসহ ৯০টি বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অলিউল হকের বাড়ি কাশিপুর গ্রামে। তার গ্রাম থেকে ভাঙচুর করতে এসেছে অনেকে। এ বিষয়ে অলিউল হক বলেন, আমরা ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। কেউ শুনেছে আমাদের কথা, কেউ কেউ শুনেনি। তবে তার দাবি, দু-তিনটি ঘর ভাঙচুর হয়েছে। এর বেশি নয়। শাল্লা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরী বলেন, ৮৮টি বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। বিত্তশালীদের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট হয়েছে বেশি। শাল্লা থানার ওসি নাজমুল হক বলেন, আমরা পৌঁছার আগেই নদী পার হয়ে কিছু মানুষ সেখানে গিয়ে হামলা করে। তবে বেশিরভাগ মানুষকে আটকাতে পেরেছে পুলিশ। পুলিশ সুপার মীজানুর রহমান বলেন, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন আছে বলে জানান তিনি। অপর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বিবরণে জানা যায়, নাচনী গ্রামের স্বাধীন মেম্বার ও ফক্কনের নেতৃত্বে কয়েকশ মানুষ গ্রামের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতেই হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধারা হলেনÑ অনিল চন্দ্র দাস, কাজলী চন্দ্র দাস, সুনুরঞ্জন দাস, অনিল কান্তি দাসসহ আরও তিনজন। মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্রের পাকা ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সব কিছু তছনছ করে। এরপর একে একে গ্রামের ৮৮টি ঘরে হামলা ও লুটপাট চালায় তারা। প্রতিটি ঘর থেকেই টাকা-পয়সা, সোনাদানাসহ মূল্যবান জিনিস লুট করে হামলাকারীরা। গ্রামবাসী জানায়, হামলায় অংশ নেয় নাচনী গ্রামের স্বাধীন মিয়া, ইয়ারত আলী, ইনাত আলী, মীর্জা হোসেন, নেহার আলী, আলম উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, আলাকাছ, হুমায়ুস, লুৎফর মো. ফারুক, আকরাম, কেরামত, কাশিপুর গ্রামের নবাব মিয়া, সাইফুল আবদুল মজিদ, তৌহিদসহ শত শত লোক। পরদিন দুপুর ১টার দিকে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও পুলিশ সুপার মীজানুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এই নিবন্ধ রেখা পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা) আতঙ্কগ্রস্ত হিন্দুরা কেউ থানায় মামলা দায়ের করেননি। কাউকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তারও করা হয়নি। এমন ঘটনা আমাদের, দেশবাসীকে বছর বছরই প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। নোয়াগাঁও বর্বরতা নিয়ে এই লেখাটিই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা নিয়ে শেষ লেখা হোকÑ এমন কামনা করি। তবে এই ঘটনা কতিপয় গুরুতর প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। তা হলো : এক. মামুনুল হক যখন উত্তেজনাকর বক্তব্য দিলেন তখনই বা এ যাবৎ তাকে গ্রেপ্তার করা হলো না কেন? দুই. যারা আগের রাতে হিন্দুদের হামলা করার সেøাগান দিয়ে মিছিল করল তৎক্ষণাৎ বা তারপর আজ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হলো না কেন? তিন. হিন্দুরা যখন থানাকে জানাল তৎক্ষণাৎ পুলিশ এসে আতঙ্কিত হিন্দুদের নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করল না কেন? চার. ঘটনা ঘটল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে? আওয়ামী লীগ কেন প্রতিরোধ করল না? পাঁচ. স্পষ্টত থানার পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের কর্তব্য পালনে গুরুতর অবহেলা প্রদর্শন করে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটার সুযোগ করে দিয়েছেন অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধেই বা ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হবে না। ছয়. একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে মামুনুল হকের উসকানিমূলক বক্তব্যের সমালোচনা করা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তবে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া, তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা, মন্দির ও বিগ্রহ ভাঙা কেন ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত বা ধর্মের অমর্যাদা করা হয়েছে বলে বিবেচনা করে উপযুক্ত আইনে মোকদ্দমা দায়ের হচ্ছে না। সাত. ক্ষতিগ্রস্তরা আতঙ্কিত। এরপরও তারা মামলা করছে। গ্রেপ্তারও হয়েছে? শাস্তি হবে কি? আট.  হেফাজতে ইসলাম কি আইনের ঊর্ধ্বে? রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App