×

জাতীয়

পথে পথে বধ্যভূমি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২১, ০৮:২২ এএম

পথে পথে বধ্যভূমি

‘মা তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না’ দেয়ালে রক্ত দিয়ে মায়ের উদ্দেশে এমন আকুতির কথা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত এক সাধারণ জনতার। পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে ফিরে মায়ের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কিনা, জানা নেই কারো। তবে খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারী খাল ও এর আশপাশের এলাকায় পাঁচ ট্রাকভর্তি মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের ধারণা, একাত্তরে গল্লামারীতে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ময়ূর নদীর তীরে অবস্থিত এই গল্লামারীতে প্রতি রাতে শতাধিক মানুষ হত্যার পাশাপাশি নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। রাজাকার ও শান্তি কমিটির সহযোগিতায় সারাদিন শহর ও গ্রাম থেকে মানুষকে ধরে এনে জেলখানা, হ্যালিপ্যাড ও ইউএফডি ক্লাবে জড়ো করা হতো। পিঠমোড়া করে ট্রাকভর্তি বাঙালিদের গল্লামারী নিয়ে যাওয়া হতো। ঘণ্টাখানেক পর খালি ট্রাক ফিরে আসত, গল্লামারীতে পড়ে থাকত তাদের নিথর দেহ। কখনো কখনো ভাসিয়ে দেয়া হতো গল্লামারীর বিলের স্রোতে। প্রথমদিকে জবাই করে হত্যা করা হতো মুক্তিকামী সাধারণ বাঙালিকে। পরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানেই ছিল রেডিও পাকিস্তানের খুলনা স্টেশন। একাত্তরে বেতারকেন্দ্রের ভবনটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতন কেন্দ্র।

‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের’ উদ্যোগে ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন প্রবেশপথের পশ্চিম পাশে খুলনা-সাতক্ষীরা রোডসংলগ্ন স্থানে গণহত্যা স্মরণে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। ফলকটি উন্মোচন করেন গণহত্যা জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। গণহত্যার ফলক স্থাপনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং তা স্বাভাবিক। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে

কোনো একটি দেশে এত অল্প সময়ে এত হত্যা হয়নি। যদিও আমরা বলি ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন, কিন্তু মনে হয় সংখ্যাটি তারও বেশি। দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে অসংখ্য বধ্যভ‚মি ও গণকবর। সেসব গণহত্যা বধ্যভ‚মি ও গণকবরের কথা এমনকি নির্যাতনের কথা বিজয়ের গৌরব ভাষ্যে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এই ইতিহাসবিদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনুসন্ধানে গণহত্যার গুরুত্ব অপরিসীম। গণহত্যা, বধ্যভ‚মি ও নির্যাতনের ইতিহাস সংরক্ষণ আমাদের জাতীয় কর্তব্য। নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন। এই তাগিদ থেকেই গড়ে উঠেছে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’। মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, বধ্যভ‚মি, গণকবর, নির্যাতনের উপকরণ সংগ্রহ এবং জাতির সামনে মুক্তিযুদ্ধের মর্মকথা তুলে ধরাই মূল উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার বাণী প্রচার করা এ প্রতিষ্ঠানের আদর্শ।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়টি দাঁড়িয়ে আছে বহু শহীদের রক্তে রঞ্জিত গল্লামারী বধ্যভ‚মির ওপর। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে গল্লামারী এলাকায় একাধিকবার এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখক সুকুমার বিশ্বাস। তিনি তার ‘একাত্তরের বধ্যভ‚মি ও গণকবর’ বইতে লিখেছেন, সেদিন গল্লামারীর বিস্তীর্ণ এলাকার যে বীভৎস রূপ দেখেছিলাম, তা আজ আর আমার পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। মানব ইতিহাসের করুণতম দৃশ্য যেন আর কোনো মানব সন্তানকে দেখতে না হয়।

শুধু গল্লামারীই নয়, একাত্তরে সারাদেশের মতোই খুলনার পথে-প্রান্তরে অসংখ্য নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভ‚মি বানিয়েছিল পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদররা। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খুলনাসহ এতদাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। চুকনগর, শিরোমনি, চরেরহাট, দেয়াড়া, রেল এলাকা, ফরেস্টঘাট প্রভৃতি স্থানে বড় বড় গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। খুলনায় গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ, গণহত্যার স্থান, নির্যাতন কেন্দ্র চিহ্নিতসহ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। খুলনা জেলায় অর্ধশতাধিক নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভ‚মি চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে জাদুঘরের মোট ৪৭টি স্থানে স্মৃতি ও পরিচিতি ফলক উন্মোচন করা হয়েছে বলে ভোরের কাগজকে জানিয়েছেন জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক ও গবেষণা কর্মকর্তা রিফাত ফারজানা। তিনি বলেন, আরো ১৩টি ফলক করা হবে। পর্যায়ক্রমে চিহ্নিত অন্যান্য নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভ‚মিতে ফলক স্থাপন করা হবে। শুধু খুলনাতেই নয়, সারাদেশের গণহত্যা, গণকবর চিহ্নিত করে একাত্তরের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ফলক তৈরি করা হবে বলে জানান রিফাত ফারজানা।

পথে পথে বধ্যভূমি : খুলনা জেলখানা ঘাট পার হয়ে সেনেরবাজার ধরে পালেরহাট। সেখান থেকে অর্ধ কিলোমিটার উত্তর দিকে যেতেই তেরোখাদা উপজেলার আজগড়া গ্রাম। এই রাস্তাটি ধরেই তেরখাদা উপজেলা সদর থেকে জেলা সদরে যাতায়াতের পথ। একাত্তরে নদী ও পায়ে হেঁটে যাওয়ার রাস্তাই ছিল যাতায়াতের মাধ্যম। একাত্তরের ভয়ংকর এপ্রিলের ১৭ (মতান্তরে ২৭) তারিখ। দুপুর ১২টার দিকে গানবোট করে পালেরহাট নেমে আজগড়া গ্রামে ঢুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। স্থানীয় রাজাকার জুম্মান খানের সহযোগিতায় প্রথমেই আজগড়া রথখোলা মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। এরপর মন্দিরের রথসহ পুরো মন্দিরটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। মন্দিরের পাশে দাঁড়ানো পল্লী চিকিৎসক কালিদাস চক্রবর্তীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। খবর পেয়ে পাশের বাড়ির শিক্ষক, উর্দু জানা সত্তরোর্ধ্ব ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষাল এসে ‘এখানে কেউ আওয়ামী লীগ করে না’ পাকিস্তানিদের বোঝাতে গেলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। হত্যা করে বৃদ্ধ হীরালাল গোস্বামীকে। পাকিস্তানি বাহিনীর অন্য একটি দল রোস্তম আজগড়ায় অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। শান্তি শিকদার, শিশির রাজকুমার, সন্ন্যাসী শিকদারসহ নাম না জানা অনেক মানুষকে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে গবেষক অমল কুমার গাইন জানান, ওই দিন ৪০ জনের অধিক ব্যক্তিকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিজয়ের পর এই নির্মম হত্যার শিকার অনেকের মৃতদেহ সেখানে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এমন হয়েছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মাথার খুলি নিয়ে খেলছে। দেশের অনেক বধ্যভূমির মতো আজগরা গণহত্যা ইতিহাসে উপেক্ষিত ছিল। ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ বিআরবি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আজগড়াতে শহীদদের নাম অঙ্কিত একটি ফলক স্থাপন করেন গণহত্যা জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।

আজগড়া গণহত্যা প্রসঙ্গে বিআরবি আজগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্র নাথ মল্লিক বলেন, ফেরি থেকে ওঠেই পাকিস্তানিরা জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর করে। নিরীহ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করে। আজগড়া গণহত্যা ফলকে ১৯ জনের নাম রয়েছে। তবে ৪০ জনের অধিক মানুষকে হত্যা করে ওই দিন পাকিস্তানিরা। তাদের বেশির ভাগ বহিরাগত হওয়ায় পরিচয় বের করা কষ্টসাধ্য। স্কুলের শিক্ষার্থীদের একাত্তরের গণহত্যার কথা জানানো হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২৫ মার্চ, ২৬ মার্চসহ জাতীয় দিবসগুলো ছাড়াও শিক্ষার্থীদের শহীদদের কথা জানানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানো হয়। বিদ্যালয়টির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শিল্পী রাণী ফৌজদার বলেন, একাত্তরের গণহত্যার স্মারক এখানে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। শিশুদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে কাজ করছি। স্কুলে ৩০০ শিক্ষার্থী। তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের কথা, গণহত্যার কথা জানে।

গজালিয়া স্নুইচ গেট গণহত্যা : একাত্তরের (১৩৭৮ বাংলার ১১ আশি^ন) শবেবরাতের রাতে ২০ জনেরও বেশি সাধারণ মানুষকে ধরে আনে রাজাকার কমান্ডার হাতেম আলী ও তার দলবল। দড়ি দিয়ে বেঁধে নদীর তীরে তাদের হত্যা করে। অনেকেরই নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন গোষ্ঠবিহারী ভদ্র, আবদুল হামিদ সরদার, আবদুল করিম শেখ, আবদুর রহমান গোলদার, ইব্রাহিম গাজী, সুশীল ভদ্র, ইরান মোল্লা, ওমর গাজী, লুৎফর রহমান মোল্লা, আবদুস সাত্তার সরদার, হাসেম গোলদার, দিলীপ ও অসিত। ২০১৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র ফলক স্থাপন করে।

অযত্নে-অবহেলায় সাচিয়াদহ গণহত্যা ফলক : খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার আঠারবাকি নদীর তীরবর্তী গ্রাম সাচিয়াদহ। গ্রামের নদীপাড়ের বাজারটির নাম সাচিয়াদহ বাজার। একাত্তরের ১৪ মে পাকিস্তানি হানাদাররা সাচিয়াদহে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করে এবং লুটপাট করে। খানসেনাদের পৈশাচিক তাণ্ডবে সেদিন ৬০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়। একাত্তরে সাচিয়াদহ বাজার ও তার পাশের গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বীভৎস গণহত্যার কথা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন তেরখাদাসহ খুলনার মানুষ। কিন্তু স্মৃতির বেদনা খুঁড়ে শহীদদের সামনে নিয়ে আসে গণহত্যা আর্কাইভ জাদুঘর। ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর সাচিয়াদহ গণহত্যার স্থান চিহ্নিতকরণ ও স্মৃতিফলকটি উন্মোচন করা হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, মাটি ও খড়ে ঢেকে আছে ফলকটির বেশির ভাগ অংশ। একপাশে রড, পাথর রাখা। নদীতে ব্রিজ তৈরির জন্য চারপাশে মাটি ফেলে ঢেকে দেয়া হয় ফলকটি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাচিয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য রিংকু বালা জানান, দুই দিনের মধ্যে সরানোর ব্যবস্থা করা হবে। সাচিয়াদহ বাজারে ৩ বছর ধরে ফার্নিচারের দোকান চালান পঞ্চাশোর্ধ গোলাম মোস্তফা। তিনি জানান, ফলক উন্মোচন করার পর নদী কাটার জন্য মাটি রাখা হয়েছিল। এরপর আর সরানোর নাম নেই। অন্যদিকে ফলক উন্মোচনের পর একদিন একটা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর কোনো উদ্যোগ নেই।

এ ব্যাপারে ঠিকাদারের ভাই আকিজুর রহমান বলেন, ফলকের পাশে রড আমরা রেখেছি। মাটি রাখার বিষয়ে কিছুই জানি না। রড সরিয়ে ফেলছি এখুনি। বাকি দায়িত্ব বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা জাতির দুর্ভাগ্য মন্তব্য করে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, একাত্তরের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো শনাক্ত করা হলেও বেশির ভাগই যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। যেগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেগুলোও রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। এ ব্যাপারে আদালতে রিট করেও কিছু লাভ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে আইন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন গবেষক শাহরিয়ার কবির।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App