বন্দুকের নল গণতন্ত্রের বিকল্প নয়
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২১, ১২:১০ এএম
ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ মিয়ানমারের নবনির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর প্রথমদিন নানান আশঙ্কা এবং আতঙ্কের মধ্যে দিন অতিবাহিত হলেও ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ নেপিডোসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন শহরে স্বাস্থ্যকর্মীরা সর্বপ্রথম মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্র্তা-কর্মচারীরা। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে সামরিক শাসনবিরোধী যে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল, যাকে নামকরণ করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল সিভিল ডিসঅভিডিয়েন্ট মুভমেন্ট’, সে আন্দোলন এখন মিয়ানমারের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্ত হয়েছে হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আবালবৃদ্ধবনিতা যুক্ত হয়েছে সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলনে। এ আন্দোলন এখন ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সর্বত্র। মানুষের মনে তৈরি হয়েছে সামরিক শাসনবিরোধী এক তীব্র ঘৃণা এবং নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেনা শাসনবিরোধী সর্বব্যাপী এই বিশাল বিক্ষোভ মিয়ানমারকে কি গণতন্ত্রের পথে ফেরাবে? এ নিবন্ধে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে অন সাং সু কির নেতৃত্বাধীন দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’ ভূমিধস বিজয় লাভ করে আর সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক পার্টি ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি এবং ডেভেলপমেন্ট পার্টি’র ভরাডুবি হয়। এতে করে মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর মাতবরি করার সম্ভাবনা সংকোচিত হয়ে যায়, যা সেনাবাহিনীর পক্ষে মেনে নেয়া একেবারেই অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাছাড়া মিয়ানমারের কমান্ডার ইন চিফ সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং সু কির কাছে রাষ্ট্রপতি হওয়ার খায়েশ ব্যক্ত করেন, যা সু কি এবং তার দল প্রত্যাখ্যান করে। ফলে সেনাপ্রধানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আমি আমার এ কলামে লিখেছিলাম, ‘তাছাড়া রাজনীতি এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় সেনাবাহিনীর প্রভাব এবং ক্ষমতা কমে গেলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর যে বিরাট এবং বিপুল অবৈধ ব্যবসা সেটাও হুমকির মুখে পড়বে। অধিকন্তু আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেনোসাইড সংঘটনের বিচার হচ্ছে। সেখানেও যদি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়, তার সব দায়দায়িত্ব তৎকালীন সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল মিন অং হ্লাইংকেই নিতে হবে। ফলে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান বলতে গেলে অনেকটা অনিবার্য ছিল’ (নৃবিদ্যার দর্শন, দৈনিক ভোরের কাগজ, ১৯/০২/২০২১)। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ নবনির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। এনএলডির প্রধান অন সাং সু কি জনগণকে এ সিদ্ধান্ত মেনে না নেয়ার আহ্বান জানান। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে কেবল পার্টি কর্মীরাই নয়, মিয়ানমারের হাজার হাজার মানুষ সু কির মুক্তি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। ধীরে ধীরে এ আন্দোলন এখন সেনা শাসনবিরোধী একটি জাতীয় আন্দোলনে চরিত্র ধারণ করেছে। ২০০৭ সালের মতো মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও সেনা শাসনবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছে এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সু কির মুক্ত দাবি করছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ছোট ছোট বিদ্রোহী গ্রুপ মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত ছিল, তারাও সেনা সরকারবিরোধী এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে, যা গোটা আন্দোলনের চেহারাকে পাল্টে দিয়েছে। এমনকি কিছু কিছু সশস্ত্র গ্রুপও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে রাস্তায় প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী একত্রে-একসঙ্গে সামরিক শাসনবিরোধী এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে গোটা আন্দোলনকে সামরিক শাসন বনাম গণতান্ত্রিক শাসনের একটা চরিত্র দান করেছে।
আন্দোলনের অভিনবত্বও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যেমনÑ গণঅবাধ্যতা প্রদর্শন, শ্রমিকদের প্রতিরোধ আন্দোলন, সাধারণ জনগণের থালা-বাটি বাজিয়ে প্রতিবাদ, মিলিটারি বয়কট বা পরিহার আন্দোলন, লাল ফিতা মাথায় বাঁধন (রেড-রিবন ক্যাম্পেইন), তিন আঙুলের প্রতিবাদ, গণবিক্ষোভ, সেনা শাসনবিরোধী গান-বাজনা-নৃত্য, বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক প্রতীকী প্রদর্শনী, অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে ডার্ক-লাইট প্রতিবাদ এবং ছাত্র-শিক্ষক গণবিক্ষোভ প্রভৃতি। এসব অভিনব আন্দোলন মোকাবিলা করার জন্য সামরিক সরকার সব ধরনের দমন-পীড়ন নীতি প্রয়োগ করেছে। উন্মুক্ত গোলাগুলি, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, জল কামান, নির্বিচার ধর-পাকড়, জেল-জরিমানা, খুন-হত্যা সবই করেছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট এসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপের তথ্যানুযায়ী (৩ মার্চ পর্যন্ত) মিয়ানমারের সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলনে এ পর্যন্ত খুন হয়েছে প্রায় ২৩২ জন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে হাজার হাজার প্রতিবাদী ও বিক্ষোভকারীকে। প্রায় ৪০ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত প্রায় ১৬ জন সাংবাদিক জেলে আছেন। ৫টি গণমাধ্যমকে ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নানান সময়ে ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এক ধরনের সামরিক কায়দায় সব ধরনের দমন-পীড়নের মাধ্যমে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা হলেও এ আন্দোলন ক্রমান্বয়ে আরো তীব্রতা লাভ করছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব, বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং আসিয়ানভুক্ত কয়েকটি দেশ প্রতিবাদকারীদের উন্মুক্ত গুলি করে হত্যা এবং বিভিন্ন ধরনের দমন-পীড়নের নিন্দা জানিয়েছে এবং অবিলম্বে বিক্ষোভকারীদের প্রতি সহনশীল আচরণের আহ্বান জানিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিক্ষোভকারীদের হত্যার নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু ‘চোরে না শুনে ধর্মের বাণী’। তবে বিক্ষোভকারীরাও নাছোড়বান্দা। ছাড় দেয়ার নয়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে, সেনা শাসকবিরোধী বিক্ষোভকারীদের দমন করার জন্য মার্চের ১৯ তারিখ ইয়াংগুনের ছয়টি টাউনশিপে সামরিক সরকার ‘মার্শাল ল’ জারি করতে বাধ্য হয়েছে, যা প্রায় ২০ লাখ মানুষকে সরাসরি সামরিক শাসনের আওতায় নিয়ে আসে। এতেও বিক্ষোভকারীরা ক্ষান্ত হয়নি, কেননা তারা তো ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই সেনা শাসনের মধ্যেই বাস করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ মুখোমুখি অবস্থানের শেষ কোথায়?
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এবং সেনা শাসনবিরোধী বিক্ষোভ করতে গিয়ে মিয়ানমারের মানুষের মধ্যে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন এবং ব্যাকুলতা তৈরি হয়েছে সেটার একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সমাজে পড়বে। এ আন্দোলনের সূত্র ধরে সব দল-মত-জাত-পাতের মধ্যকার বহুমুখী ভেদাভেদ, যা মিয়ানমারের সমাজ-ব্যবস্থায় প্রকট, সেখানে পারস্পরিক সহমর্মিতার একটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির শুভ সূচনা হতে পারে। ১৯৬২ সালের পর তৎকালীন বার্মা এবং পরবর্তীতের মিয়ানমারের জনগণ কোনো না কোনোভাবে সামরিক শাসনের অধীনের জীবনযাপন করেছে। ২০১১ সাল থেকে একটা সেমি ডেমোক্রেটিক শাসনে থাকতে থাকতে তারা একটা পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থার অভাব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি একটা তীব্র প্যাশন তৈরি হয়েছে এবং চলমান বিক্ষোভ সে তীব্রতার খানিকটা প্রতিফলন মাত্র। তাই ২৩২ জন বিক্ষোভকারীকে গুলি করে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করার পরও বিক্ষোভকারীদের দমানো যায়নি। বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিক্ষোভকারীদের আত্মত্যাগ এবং নিজের জীবনের বলিদান আন্দোলনের স্পৃহা এবং কমিটমেন্টকে আরো তীব্র এবং বলীয়ান করেছে। তাই চলমান আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সামরিক সরকারের পতন অতি সহজে ঘটবে সেটা আমি মনে করি না, কিন্তু আন্দোলনকারীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন এবং প্রতিজ্ঞাবোধ তৈরি হয়েছে, সেটাই একদিন সত্যিকার অর্থে এ সামরিক সরকারের পতন ঘটাবে এবং মিয়ানমারকে সত্যিকার গণতন্ত্রায়নের পথে নিয়ে আসবে। মিয়ানমারের সত্যিকার গণতন্ত্রায়নের মধ্যেই মিয়ানমারে বিদ্যমান অসংখ্য সমস্যার সমাধান লুকিয়ে আছে। বন্দুকের গুলি দিয়ে গণতন্ত্রের স্বপ্নকে রোধ করা যায় না। বন্দুকের নল গণতন্ত্রের সামাজিক স্পৃহাকে কখনোই দমাতে পারে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তার সাক্ষী। মিয়ানমারও ইতিহাসের সে সাক্ষীর কাতারে নতুন সাক্ষী হয়ে উঠুক, সে প্রত্যাশা নিরন্তর।
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]