×

জাতীয়

আওয়ামী লীগের তৃণমূলে গৃহদাহ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২১, ০৮:৫৫ এএম

আওয়ামী লীগের তৃণমূলে গৃহদাহ

ফাইল ছবি

তৃণমূল রাজনীতিতে নোয়াখালীর বসুরহাট বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত নাম। পৌরসভার আলোচিত মেয়র, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খানের স্ত্রীর দায়ের করা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে মির্জার অনুসারী সালাউদ্দিন পিটনের দায়ের করা মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

শুধু নোয়াখালীর বসুরহাট নয়, সারাদেশেই ঘরের আগুনে পুড়ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। পৌরসভার নির্বাচনকে ঘিরে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী, নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীর সংঘর্ষ যেন কোন্দলের রাজনীতির চিরায়ত রূপ। অন্যদিকে সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার আশঙ্কা আরো বাড়ছে। নির্বাচন ঘিরে প্রতি এলাকায় বিভিন্ন ক্যাডারবাহিনী গড়ে ওঠেছে। এদের মধ্যেই সংঘাত, খুনোখনি, সহিংসতা। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে মনোনয়নপ্রত্যাশী ১০ থেকে ১৫ জন। কিন্তু মনোনয়ন পাবে একজন। ফলে অন্যদের মধ্যে অসন্তোষ মিটবে না। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে প্রাণহানি ঘটে ১১০ জনের।

ব্যাপক সহিংসতা, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, বিনা ভোটে জয়ী হওয়া, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের অনিয়মে জড়িয়ে পড়া দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসির শক্তিশালী ভ‚মিকা না থাকা, জবাবদিহিতার আওতায় আনতে না পারায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের সহিংসতা বাড়ছে। এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, এবার পৌরসভা নির্বাচনেও সহিংসতা হয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে। বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ইতিহাস খুবই খারাপ। আমাদের সময়েও সহিংসতা হয়েছে। নানাবিধ কারণে ভোট বন্ধ রাখতে হয়েছে।

অন্যদিকে স্থানীয় নির্বাচনে এমপিরা হস্তক্ষেপ করেন। ফলে দিন দিন কোন্দল বাড়ছে। কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। এছাড়া সহিংসতার ক্ষেত্রে অতীতেও ইসি কোনো ভ‚মিকা নিতে পারেনি। দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেনি। এটি একটি বড় সমস্যা।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগেই তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি (১৩ মার্চ) প্রথম ধাপে ইউনিয়ন পরিষদে ২৫০ চেয়ারম্যানের নাম চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ। এতে খুলনার কয়রার মহারাজপুরে মনোনয়ন পান মো. আব্দুল্লাহ-আল মাহমুদ। বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম আব্দুল্লাহ আল মামুন লাভলুর মনোনয়ন না পাওয়ায় পরদিন বিক্ষোভ করেছেন ইউনিয়ন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাস্টার খায়রুল আলম বলেন, নৌকার প্রতীকপ্রাপ্ত আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বিগত নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচনে কাজ করেছেন। পাশাপাশি তার মেজভাই এ ইউনিয়নের ধানের শীষের প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান বেল্টু। তার বড় ভাই মোফাজ্জেল হোসেন জামায়াত করেন। এছাড়া ওইরাতেই খুলনার যোগীপোল ইউনিয়নের বহিষ্কৃত চেয়ারম্যান আনিচুর রহমানকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়ায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী খুলনা-যশোর মহাসড়ক অবরোধ করে। এ সময় তারা খুলনা-যশোর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তাদের অভিযোগ, যোগীপোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনিচুরের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্প একটি বাড়ি একটি খামারের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের অনাস্থায় তাকে মন্ত্রণালয় চেয়ারম্যান পদ থেকে স¤প্রতি বহিষ্কার করা হয়।

এদিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সিরাজগঞ্জ ও নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে কিছুদিন আগে। এরপরও থামেনি কোন্দল। বরং পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে কোন্দল আরো বেড়ে গেছে। গত ৭ মার্চ বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় একই স্থানে ও একই সময়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সমাবেশ ডাকায় সহিংসতার আশঙ্কায় ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে প্রশাসনকে। গত ৫ মার্চ আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের উপস্থিতিতে তার নির্বাচনী এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় দুই মেয়রপ্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

তৃণমূলের কোন্দল, সংঘর্ষ, প্রাণহানি ও রক্তপাতের ঘটনায় চরম ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন তিনি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ড ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভায় কঠোর অবস্থানের বিষয়টি একাধিকবার ব্যক্ত করেছেন দলীয়প্রধান। সারাদেশের দলীয় কোন্দলগুলো নিরসনেরও তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের ঘটনাসহ দলীয় কোন্দলের ঘটনায় জড়িতদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বিশৃঙ্খলার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের পরিচয় না দেখে আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকেই ছাড় নয়।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন সচিব হেলালউদ্দীন ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিয়নগুলোর একটি তালিকা স্থানীয় নির্বাচন কমিশনকে পাঠাই। তারা নির্বাচনের আয়োজন করে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকেও তারা সম্পৃক্ত করে। নির্বাচনে প্রার্থী দেয় রাজনৈতিক দল আর স্থানীয় নির্বাচন দেখভাল করে স্থানীয় নির্বাচন কমিশন। কেন্দ্র থেকে খুব একটা কিছু করার নেই।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, যতদিন পর্যন্ত দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে, ফায়দা হাসিলের রাজনীতি থাকবে, দায়বদ্ধতার অভাব থাকবে, ততদিন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা থাকবে। গত নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে কিন্তু দায়ীদের শাস্তি দেয়া হয়নি। শুধু কয়েকজনকে সর্তক করা হয়েছে। দোষীরা শাস্তি না পেলে অন্যায়ে উৎসাহিত হয়। তিনি বলেন, দলীয় গণতন্ত্র নেই। আওয়ামী লীগে দল ও সরকার এক হয়ে গেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়ছে।

তবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সহিংসতার আশঙ্কা দেখছেন না আওয়ামী লীগ নেতারা। জানতে চাইলে কর্নেল (অব.) ফারুক খান ভোরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগ বড় দল। নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি হবে, এটিই স্বাভাবিক। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে সবাইকে মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এর বিকল্প নেই। বিদ্রোহী প্রার্থীসহ কোন্দলের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

প্রসঙ্গত, আগামী ১১ এপ্রিল প্রথম ধাপে দেশের ২০ জেলায় ৬৩টি উপজেলার ৩২৩টি ইউপিতে ভোট হবে। এবারো এই নির্বাচন হবে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App