×

মুক্তচিন্তা

সড়কে এত মৃত্যু! প্রশাসন নির্বিকার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২১, ১২:২১ এএম

সড়ক-মহাসড়ক নিয়মিত প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের, নর-নারী-শিশু নির্বিশেষে। আসলে বোবা মহাসড়ক স্থির দৃষ্টিতে এসব রক্তাক্ত দৃশ্যচিত্র চেয়ে চেয়ে দেখে, কিন্তু মূল ঘাতক গণপরিবহন; তার বিশৃৃঙ্খল চরিত্র এর জন্য দায়ী। পথে পথে মৃত্যুর মিছিল সড়ক দুর্ঘটনা নামে পরিচিত। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদীরা এগুলোকে দুর্ঘটনা বলতে নারাজ। নেপথ্য কারণ খুঁজে দেখতে গেলে তেমনটিই সত্য মনে হবে। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালনা, কখনো ‘ফেলপার’ নামধারী ব্যক্তিটির ড্রাইভার সেজে বসা, কখনো ভিন্ন সংস্থার যানবাহনের সঙ্গে মারণ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি যা সড়ক-মহাসড়ক, এমনকি রাজধানীর সড়কগুলোর নিরাপদ পরিবেশ ভেঙে চুরমার করে ফেলে। দূর থেকে মানুষ দেখে সে করুণ দৃশ্য, সংবাদপত্রে তা হয়ে ওঠে ‘হেডলাইন।’ যেমন ‘আনজুমের মা-বাবাকে কেড়ে নিল আজেমেরী’। ‘বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে দম্পতির মৃত্যু।’ একমাত্র শিশুসন্তান (সাড়ে ৩ বছর বয়সি) আনজুমকে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আসা এই দম্পতি আর ঘরে ফিরতে পারেননি। এ ধরনের ঘটনা হরহামেশা ঘটতে দেখা যাচ্ছে সংবাদপত্রের বা টিভি সংবাদের কল্যাণে। ভোরের কাগজের একটি সংবাদ শিরোনাম বিবেচনার বিষয় : ‘মহাসড়কে শৃঙ্খলার বালাই নেই’। তাহলে প্রশ্ন করতে হয় : ‘শৃঙ্খলা কোথায় আছে?’ জবাবে বলা যায়, সে গিয়েছে নির্বাসনে। তা না হলে দিনের পর দিন কেন এমন সব ঘটনা পত্রপত্রিকায় এত লেখালেখি সত্ত্বেও এমনকি এক পর্যায়ে প্রতিবাদ সমাবেশ, মিছিল তো কম হয়নি। তবু বন্ধ হয়নি সড়কে, মহাসড়কে যানবাহনের প্রাণঘাতী খেলার নৈরাজ্য। প্রশ্ন উঠতে পারেÑ ঘটনাগুলো কীভাবে দেখছে মানুষ, সরকার, রাজনৈতিক সংগঠনের মতো একাধিক মুখপাত্র। ॥ দুই ॥ এ ব্যাপারে মানুষ বরাবর প্রতিবাদীÑ সাধারণ মানুষ সমালোচনায় মুখর, অন্যদিকে সচেতন শ্রেণি বুদ্ধিজীবী (যেমন ইলিয়াস কাঞ্চন প্রমুখ) থেকে ছাত্র-সমাজ, বিশেষভাবে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ। যখন কোনো বিশ^বিদ্যালয় বা কলেজ ছাত্রছাত্রী ঘাতক পরিবহনের বেপরোয়া চালনার শিকার, তখন তো কথাই নেই। তারা রাজপথে প্রতিবাদী মিছিলে নেমে পড়ে। মানুষ তখন তাদের সমর্থনে প্রায়শ এগিয়ে আসে। এ ছবিটা বাংলাদেশের রাজধানীর বরাবরে সত্য। আর সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তখন কী ভূমিকা? তারাও মাঠে, তবে তা প্রতিবাদীদের প্রতি সহানুভূতিতে নয়, বরং তাদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করতে, প্রতিবাদ নিষ্ক্রিয় করতে। এসব ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের পুলিশ বাহিনী বরাবরই সফল। একাধিক ঘটনায়Ñ কী অতীতে, কী সমকালে এমনটাই দেখা গেছে। কী তাৎপর্য এ আচরণের? সরকারি ভাষ্যে তা হলো, জননিরাপত্তা ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায় পালন। কিন্তু প্রশ্ন থাকে সে ক্ষেত্রে বাস মালিকদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দুর্নীতি এবং চালক ও হেলপারদের অপরাধমূলক আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কী হলো? তাদের দণ্ডবিধানেরই বা কী গতি হলো? এ পর্যন্ত এসব প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। কারণ বাস-ট্রাক মালিক সিন্ডিকেট এতই শক্তিমান, তারা পরিবহন শ্রমিকদের ব্যবহারে এতই চতুর ও কৌশলী যে, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে তাদের তুলনা নেই। তাই দেখা গেছে, সরকারবিশেষ সঠিক দণ্ডের আইনি প্রস্তাব তুলেও পিছিয়ে এসেছে। কাজেই সড়কে মহামৃত্যু যথানিয়মে চলছে। বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনার। ॥তিন॥ বিষয়টি নিয়ে তাই আপাতত করোনা-কোভিড পটভূমিতে সূত্রাকার আলোচনায় নেমে বলতে হয়, প্রথমত এতসব সত্ত্বেও অর্থাৎ এত প্রতিবাদ, এত রক্তপাত, এত মিছিল সত্ত্বেও সুবিচারের কোনো আইনি বিধান প্রণীত হলো না, তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেল না, অবস্থা বরাবরের মতো একইভাবে চলতে থাকে। একের পর এক মৃত্যু-করুণ দৃশ্য কান্না ছাপিয়ে সবই যথারীতি চলছে, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীর করুণ মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে। এরপর হঠাৎ করেই বিশ^মারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু বাংলাদেশেওÑ মার্চ ২০০০ থেকে। সারাদেশ, বিশেষভাবে রাজধানী ঢাকার সর্বশ্রেণির মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে বিহ্বল। ভাবা গিয়েছিল, এর ফলে পরিবহন খাতে অর্থাৎ মালিক সিন্ডিকেট ও চালক-হেলপার জুটিতে সুমতির দেখা মিলবে, তারা বুঝবে জীবন-মৃত্যুর মহিমা ও মূল্য। কিন্তু না, ক্ষণিক বিরতি সত্ত্বেও তা মেলেনি। এমনকি করোনা- কোভিটের বর্ষপূর্তির পরও তেমন কিছুর দেখা মেলেনি। যেমন নির্দয় শোষক মালিক শ্রেণি, তেমনি নিষ্ঠুর চালক-হেলপার শ্রেণিÑ যাদের আবার চিহ্নিত করা হয় শ্রমজীবী শ্রেণির মহিমায়। তাই ঘটনার পর ঘটনাÑ সড়কে-মহাসড়কে, রাজপথে, মৃত্যুর করুণ কাহিনী প্রতিদিন রক্তে লেখা হচ্ছে। আর তাই ‘বাড়ি ফেরা হলো না সুশংকরের’ (প্রথম আলো, ১৪.৩.২১)। প্রতিবেদনে প্রকাশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বন্ধুর বাড়ি থেকে হবিগঞ্জে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু সুশংকরের। দ্বিতীয় সংবাদ শিরোনাম একই দিনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড-মিরেরসরাই এলাকায় ‘৬৬ কিমিতে মৃত্যুর মিছিল/ঝরল আরো দুই প্রাণ।’ প্রতিবেদন মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এই অংশে ঘনঘন দুর্ঘটনা ঘটছে, মরছে মানুষ। নেয়া হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা। একই অবস্থা যশোরেও। সংবাদ-শিরোনাম লিখছে : ‘সড়কে নিহত ১১ জন’ (কালের কণ্ঠ, ১৩.৩.২১)। এমনকি প্রাসঙ্গিক ঘটনার নিষ্ঠুরতাও লোমহর্ষক : ‘বাস থেকে ছুড়ে ফেলা হলো প্রতিবন্ধী নারীকে’ (ভোরের কাগজ, ৯.৩.২১)। ভাবা যায় এমন নিষ্ঠুরতা! কেরানীগঞ্জে চলন্ত বাস থেকে এক প্রতিবন্ধী নারীকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিল বাসের হেলপার মহোদয়, তার প্রাপ্য ভাড়া না পাওয়ায়। তাই দেখা যাচ্ছে, এক মাসে বাস চালনার কেরামতিতে সড়কে প্রাণ গেল ৫১৭ জন হতভাগ্যের (৪.৩.২১, জবাবদিহি)। এমন বহু ঘটনা প্রতিদিন কাগজগুলোতে লিপিবদ্ধ হচ্ছেÑ নির্বিকার প্রশাসন, নির্বিকার জনমত। শেষোক্তদের প্রতিবাদী না হওয়ার কারণ কী করোনা সংক্রমণ, কিংবা তার দ্বিতীয় ঢেউ। তাই চলছে পরিবহন খাতের স্বেচ্ছাচার, আর পথযাত্রী মানুষের মৃত্যু। এর দায় কে নেবে? এ পর্যন্ত অনেক লেখালেখি শেষেও ঘটনার পরিবর্তন না দেখে প্রশ্ন করতে হয়, সরকার এসব মৃত্যুর নিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণে উদাসীন কেন? একমাত্র কঠোর আইনি ব্যবস্থাই এ জাতীয় স্বেচ্ছাচার বন্ধ করতে পারে। তাই ব্যবস্থা গ্রহণ সরকারকেই করতে হবে। আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App