×

সাময়িকী

শিশু দিবস : ছড়া নিয়ে শিশুসাহিত্যিকদের ভাবনা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২১, ১২:২৪ এএম

শিশু দিবস : ছড়া নিয়ে শিশুসাহিত্যিকদের ভাবনা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন মানে সব শিশুর আনন্দের দিন। এদিনকে যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনে সরকার দিনটিকে জাতীয় শিশু দিবসের মর্যাদা দিয়েছে। আমাদের মাতৃভাষার দিনকেও আজকে পৃথিবীর সব দেশের মানুষের মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় পালন করে আসছে। এটা আমাদের গর্বের। শিশু জন্মের পর তার মুখে যখন প্রথম বুলি ফোটে তাকে মা শব্দটি আগে শেখানো হয়। তারপর বাবা, দাদা, দাদি ইত্যাদি শেখাতে দেখা যায়। শিশু যখন পরিপূর্ণ কথা বলতে শেখে তখন তাকে প্রথম পাঠ হিসেবে ছড়ার বই, বর্ণ পরিচয় শেখানো হয়। বর্ণ পরিচয়ে শিশু ছড়াটিই মায়ের মুখে মুখে উচ্চারণ করে থাকে। অর্থাৎ অ আ ই ঈ উচ্চারণের চেয়ে শিশু ‘আয় আয় চাঁদ মামা’ ছড়াটিই আগে মুখস্থ করে ফেলে। কিংবা ‘আতা গাছে তোতা পাখি...’। এই ছড়া শব্দটি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে ভেসে উঠে ছড়ার অবয়ব। ছড়া কেমন আমরা সবাই জানি। শৈশবে মায়ের মুখে মুখে ছোট ছোট কত ছড়া মুখস্থ করেছি। কত মজার মজার ছড়া শুনিয়ে আমাদেরকে ছোটবেলায় ঘুম পাড়াতেন মা। যেমন ‘আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যায়’। কিংবা ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়াল, বর্গী এলো দেশে, ধান পুরালো পান পুরালো খাজনা দেবো কিসে’। এমন অনেক ছড়া আমাদের মায়েদের মুখে মুখে। যে মা লেখাপড়া জানেন না তিনিও কিন্তু তার দুধের শিশুটিকে ঘুম পাড়াতে একইভাবে ছড়া বলেন। এক অর্থে ছড়া কম-বেশি সবার জানা। ছড়া সবাই জানে কি করে? ছড়ায় ছন্দ আছে, মিল আছে। যে কারণে সবাই তা সহজে মুখস্থও করতে পারে। আমরা গাঁও-গ্রামেও দেখি বুড়ো দাদা-দাদিমা, ঠাকুমারা সেই আদিকালের মানুষ হয়েও তারা কত সুন্দর সুন্দর ছড়া মুখে মুখে বলতে পারেন। এখন প্রশ্ন হতে পারে, এ ছড়া কবে থেকে সৃষ্টি হয়েছে? ছড়া কোথা থেকে এসেছে। এ ছাড়া কোথায় কখন সৃষ্টি হয়েছে। ছড়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা য়ায়, আমাদের সাহিত্যের মূল, যে ‘চর্যাপদ’কে গ্রহণ করি কিন্তু কারো কারো মতে ছড়া চর্যাপদেরও আগের সৃষ্টি। তাহলে কত হাজার বছর আগে ছড়ার সৃষ্টি আমরা একটা ধারণা করতে পারি। সেই ছড়া যেভাবেই সৃষ্টি হোক না কেন, মানুষ যতই শিক্ষা লাভ করছে, এ ছড়াকে ততই নানাভাবে রচনা করেছে। ছড়াকে নানা ভাগেও ভাগ করেছে। আধুনিক সাহিত্যে ছড়া সাহিত্যের মর্যাদায় আসীন। কেউ কেউ বলেন ছড়া ছোটদের জন্য। ছড়া ছোটদের পাঠ। আবার অনেকে তা মানতে নারাজ। তাদের মতে, ছড়া ছোটদের, বড়দের। যারা বড়দের পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, ছড়া বড়রাও পড়ে মজা পায় এবং ছড়া তাদের মন ও মননে যে ছাপটা রাখে তাতে মানুষকে ঋদ্ধ করতে সাহায্য করে। এরপর ছড়া আধুনিক হয়েছে। সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেছে। তাহলে ছড়া কি শিশুসাহিত্য? না বড়দের সাহিত্য। কিংবা ছড়া শুধুই শিশুসাহিত্য নয় কেন ? গত ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মশতবর্ষের শিশু দিবসে চারদিকে নানা আয়োজনের ভিড়ে এ বিষয়ে কথা বলেছি আমাদের দেশের কয়েকজন খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিকের সঙ্গে। যারা ছোটদের জন্য লিখে দেশজুড়ে সুনামের অধিকারী হয়েছেন। শিশুদের নিয়ে ভাবেন, শিশুদের মন-মননকে ঋদ্ধ করতে তাদের মনোজগৎকে আনন্দের ভুবনে নিয়ে যেতে কাজ করে চলেছেন সেসব শিশুসাহিত্যিকের। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিলÑ ছড়া কি শিশুসাহিত্য? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন রফিকুল হক (দাদুভাই), আবু সালেহ, আমীরুল ইসলাম, আসলাম সানী, আখতার হুসেন, সিরাজুল ফরিদ, সুজন বড়ুয়া, দীপঙ্কর চক্রবর্তী, রাশেদ রউফ, ফারুক হোসেন, আনজীর লিটন, আহসান মালেক, অরুণ শীল ও মালেক মাহমুদ। কথা বলেছেন শিবুকান্তি দাশ   রফিকুল হক (দাদুভাই) : সৃজনশীল সাহিত্যের মা হলো ছড়া। সাহিত্যের আদি রূপ। ছড়ার আবেদন সর্বজনীন। আখতার হুসেন : ছড়া অবশ্যই শিশুসাহিত্য। মানুষ যখন থেকে কথা বলতে শুরু করেছে এবং ছন্দ মিল দিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে তখন থেকে ছড়ার সৃষ্টি। কাব্যের আদি রূপ হচ্ছে ছড়া। ছড়ার রূপ পৃথিবীতে একই রূপ। ছড়া বড়রাও পড়ে মজা পায় এবং ছড়া তাদের মন ও মননে যে ছাপটা রাখে তাতে মানুষকে ঋদ্ধ করতে সাহায্য করে। এরপর ছড়া আধুনিক হয়েছে। সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেছে। চর্যাপদেও ছড়ার কিছু কিছু ছাপ পাওয়া যায়। চর্যাপদের আগের রূপ হচ্ছে ছড়া।   আমীরুল ইসলাম : শিশুসাহিত্য শব্দটি বেশি দিন ধরে প্রচলিত নয়। স্কুল পদ্ধতি বের হওয়ার পর থেকে এই শব্দটি প্রচলন দেখা যায়। সাহিত্যে বড়দের ছোটদের বিভাজন নেই। যে লেখাগুলো ছোটদের আনন্দ বোধে আনন্দ দেয়। যে লেখার রূপ-রস ছোটরা অনুধাবন করে সেটাই শিশুসাহিত্য। আরব্য রজনীর অধিকাংশ গল্প বড়দের। কিছু গল্প যেমন সিন্দাবাদ। আলী বাবা এসব ছোটদেরও মন জয় করেছে। সেই অর্থে ছড়া ছোটদের মন জয় করে বলেই শিশুসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ছড়া বড়দের জন্যও লিখিত হয়। অনেক ছড়া শিশুর মনের ভাষায় লিখিত কিন্তু পিওর বড়দের। সেইসব ছড়ার ধ্বনি ও সুর ছোটদের হৃদয়কে আকর্ষণ করে। তাই ব্যাপক অর্থে বিশ্বজয়ের ছড়ার মাধ্যমটি শিশুসাহিত্যের অংশ।   সুজন বড়ুয়া : ছড়া শিশুসাহিত্যের বাবা। ছড়া থেকেই শিশুসাহিত্য শুরু হয়েছে।   রাশেদ রউফ : ছড়া কি শিশুসাহিত্য? প্রশ্নটির এক কথায় জবাব দেয়া যায় না। একটু ব্যাখ্যা না করলে মনে হয় আমার মতামত স্পষ্ট হবে না। তাই দীর্ঘ কথন। ছড়া শব্দটির উৎপত্তি, সংজ্ঞা ও স্বরূপ নির্ধারণ বহুল আলোচিত বিষয়। কারো কারো মতে, ‘ছটা’ শব্দ থেকে শব্দটি উদ্ভুত। যার অর্থ হলো শ্লোক পরম্পরা বা ছন্দোবদ্ধ পদপরম্পরা। সেক্ষেত্রে ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তনটি এ রকম : ছটা > ছডা > ছড়া। আবার কোনো কোনো পণ্ডিতের ধারণা ‘ছন্দ’ থেকে ‘ছড়া’ শব্দটি এসেছে। ‘ছন্দ’ শব্দের অপভ্রংশ রূপ হলো ‘ছড়া’। আসলে বাংলা ছড়ার জন্ম পরিচয় উন্মোচন করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হয় হাজার বছরের অতীত লোকালয়ে। আবহমান বাংলার লোকালয়ই ছড়ার উৎসমুখ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ছড়ার মধ্যে একটা চিরত্ব আছে। কোনোটির কোনো কালে কোনো রচয়িতা ছিল বলিয়া পরিচয়মাত্র নাই এবং কোন তারিখে কোনটা রচিত হইয়াছিল এমন প্রশ্নও কাহারও মনে উদয় হয় না। এই স্বাভাবিক চিরত্বগুণে ইহারা আজ রচিত হইলেও পুরাতন এবং সহস্র বৎসর পূর্বে রচিত হইলেও নূতন।’ ছড়াকে সংগ্রহ করে সর্বপ্রথম লৈখিক রূপ দেন বাংলা ছড়ার প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষ যোগীন্দ্রনাথ সরকার। তিনি ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে এসব সংগৃহীত ছড়াকে ‘খুকুমণির ছড়া’ শীর্ষক একটি গ্রন্থে সংকলিত করেন। ছড়ার প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে ছড়াকে বহুমুখী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ছড়াশিল্পী অন্নদাশঙ্কর রায়। তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর ‘পরে রাগ করো তোমরা যারা বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করোÑ তার বেলা, তার বেলা? এ ধরনের ছড়া লিখে অন্নদাশংকর রায় ছড়ার মধ্যে যোগ করেন রাজনৈতিক সুর। যে ছড়া শিশুদের ঘুম পাড়ানিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হতো, সে ছড়া পরিণত হয়েছে ঘুম জাগানিয়ায়। ছড়ার ভাষাও হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার, প্রতিবাদের মাধ্যম। অন্যদিকে শিশুসাহিত্যের স্বরূপ ও সংজ্ঞা নিয়ে নানাজন নানা রকম অভিমত প্রদান করেছেন। তাদের অধিকাংশই ছোটদের জন্য লেখা সাহিত্যকে ‘শিশুসাহিত্য’ নামে অভিহিত করেছেন। লীলা মজুমদার ‘শিশুসাহিত্য’ বিষয়ে বিশ্লেষণ করেছেন গভীরভাবে। ‘ছড়াসাহিত্য’ আর ‘শিশুসাহিত্য’ এখন স্বতন্ত্র মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। তবু বলা যায়, ছড়া যখন শিশুরঞ্জনি, তখন তা শিশুসাহিত্য; আবার ছড়া যখন সমাজ সংসার রাজনীতি অর্থাৎ বহুমুখী, তথা বড়দের অনুষঙ্গকে ধারণ করবে, তখন তাকে ছড়াসাহিত্য হিসেবে আমরা পরিগণিত করি। শিশুসাহিত্য যেন সবসময় শিশুর আনন্দসঙ্গী হয়ে ওঠে, তার জন্য শিশুসাহিত্যিকদের ভাবতে হয় নিরন্তর। (সংক্ষিপ্ত লেখা)   আহসান মালেক : ছড়া শিশুসাহিত্য বটে। তবে ছড়ার অনেক শাখা-প্রশাখার একটি হলো ‘শিশুতোষ ছড়া’ বা শিশু ভোলানো ছড়া। সাহিত্যের আদিকালে চর্যাপদের পদগুলোই গবেষকদের গবেষণায় স্বীকৃতি লাভ করলেও ছড়ার প্রচলন তারও আগে থেকে। অতীতে ছড়া ছিল স্মৃতিনির্ভর, মানুষের মুখে মুখে যা ছড়িয়ে পড়ে, পুরুষানুক্রমিক যা সঞ্চারিত হয়েছে কাল থেকে কালান্তরে। প্রাচীন ও মধ্যযুগ পেরিয়ে ছড়া আজ আধুনিক সমাজের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। শিশুতোষ ছড়া বা শিশুসাহিত্যের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়া সর্বজনীনতা পেয়ে গেছে অনেক আগেই। শিশুর আনন্দের জন্য যেমন ছড়া লেখা হয়েছে, তেমনি শিশুর অধিকার, সমাজের নানান বিষয়-আশয় নিয়েও লেখা হচ্ছে ছড়া। তাই ছড়া শুধুমাত্র শিশুসাহিত্যই নয়। বরং বলা যেতে পারে সর্বজনীন ছড়া সাহিত্য।   মালেক মাহমুদ : শিশু কথা বলতে শেখে ছড়ায় ছড়ায়। সেই অর্থে ছড়াই শিশুর প্রথম পাঠ। কিন্তু ছড়া শুধু কী শিশুদের জন্য রচনা হয়? না, হয় না। সকলের জন্য রচনা হয়। বড়দের জন্য রচনা ছড়ার ভেতর থেকেই আমার, শিশুদের জন্য ছড়া আলাদা করেছি। আশা বিষয় হলো এখনকর সময় ছোটদের নিয়ে আলাদা শিশুসাহিত্য হচ্ছে। আমাদের প্রয়োজনে ছোটদের বড়দের বিভাজন করছি মাত্র। কবিতার মতো। ছড়া নিজের শক্তিতে শক্তিমান। ছড়া একটি জগৎ। ছড়ার ভেতরে কবিতার বসবাস। ছড়া নানা রঙে রঙিন। ছড়া ছোটদের। ছড়া বড়দের। ছড়া সকলের। সব ছড়াই শিশুসাহিত্য নয়। ছড়া শিশুসাহিত্যের একটি অংশ।   আবু সালেহ : শিশুকালের বইতে মজার গল্প থাকতো। তেপান্তরের গল্প। মা, দাদিরা শোনাতেন রাক্ষসের গল্প, ব্যাঙমা ব্যাঙমির গল্প। এক ছিল রাজা তার ছিল দুই রানী ... এসব রূপকথা গল্প আমাদের কালে শোনেনি এমন কেউ নেই। গল্পগুলো শিশুসাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সাহিত্যিক ডা. লুৎফর রহমানের উন্নত জীবন শিশুমন গড়ে তুলতে পড়ানো হতো। তার প্রবন্ধগুলো এখনো শিশুদের পড়িয়ে থাকেন। ছড়ার মাধ্যমেও শিশুদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এতো কিছু বলার উদ্দেশ্য হলো ছড়াই কি শিশু সাহিত্য? আমি বলবো, না ছড়া শিশুসাহিত্য নয়। সহজ-সরল এবং প্রচলিত কথা মালার কারণে ছড়ার কথা বুঝা যায়। এ কারণে ছড়ার ব্যবহার যত্রতত্র। সহজ ভাষায় লেখা গল্প, প্রবন্ধ শিশুদের জন্যও রয়েছে। তাই বলে কেউ বলবে না গল্প শিশুসাহিত্য। প্রবন্ধের বেলায়ও তাই। আর একটি কথা বলেই শেষ করতে চাই তা হলো, যারা শিশুদের জন্য লেখেন তারা শিশুসাহিত্যিক হলে যারা নারীদের নিয়ে লেখেন তারা কি নারীসাহিত্যিক, নদী নিয়ে লেখে যারা তারা কি নদীসাহিত্যিক? ছড়া শিশুসাহিত্য নয়। ড. সুকুমার সেন বলেছেন, তৃতীয় শতকে যখন বাংলা ভাষার জন্ম হয় তখন সাহিত্যের মাধ্যম ছিলো। গান, নাটকও ভূমিকা রাখে। তাই বলা যায় ছড়া সাহিত্যের অভিভাবক। ছড়া উদবাস্তুসাহিত্য নয়। এর শক্ত ঠিকানা আছে। শিশু সাহিত্য বলে একে নাবালক করা যাবে না।   আসলাম সানী : ছড়া অবশ্যই শিশুসাহিত্য। সাহিত্যের মূলেই শিশুসাহিত্য। মানুষের মুখে উচ্চারিত কথামালায় ছড়া। ছড়া হচ্ছে সাহিত্যের প্রোপিতা। ছড়া শ্রেণিভেদে বড়দের জন্যও। ছড়া মানে সেøাগান। আমরা যখন যুদ্ধে যায় তখন ছড়াকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছি। ‘পদ¥ মেঘনা যুমনা, তোমার আমার ঠিকানা’ যখন সেøাগান দিয়েছি সেটা তো ছড়ায় ছিল। ছোটদের জন্য যখন লেখা হয় ছড়া তখন শিশুকে উৎসাহ দিয়ে লিখতে হবে। শিশু যাতে আনন্দ পায়। আমি যখন ছড়া লিখি তখন আমি খুন শব্দটি ব্যবহার করি না। সেখানে আমি কালো দানো বা দৈত্য এমন শব্দকে খুঁজি। শিশুসাহিত্য সবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে বাংলা সাহিত্যের অনেক ক্ষণজন্মা পুরুষও শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। ছড়ায় অন্তমিল হতে পারে, অন্তমিল ছাড়াও হতে পারে। গ্রিক যুগে মানুষের জীবনের নানা মাত্রিক বিষয়েও ছড়া লেখা হয়েছে।   ফারুক হোসেন : ছড়া একটি পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য ক্ষেত্র। পুরো অধিক্ষেত্রে শিশুরাও অন্যতম অংশীদার, মানে পাঠক। সেই ছড়াগুলোই শিশুসাহিত্য, যেগুলো শিশু পাঠকের পাঠযোগ্য। মনে রাখতে হবে শিশুর বয়সের রেঞ্জ বেশ প্রসারিত। মোটকথা ছড়া শুধুই শিশুসাহিত্য নয়। সিরাজুল ফরিদ : ছড়া দুই ধরনের বা দুই প্রকার। এক. শিশুতোষ, যাকে বলা হয় শিশুপাঠ্য। শিশুতোষ ছড়া পাঠে শিশুরা আনন্দে উদ্বেলিত হবে। ছড়ার চিত্রকল্প দেখে মুগ্ধ হবে। তা পাঠ করে বড়রাও আনন্দ উপভোগ করবে। এই ধরনের বা এই জাতীয় ছড়াগুলোকে শিশুসাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমনÑ আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে ... দুই. বড়দের ছড়া। বড়দের অর্থাৎ মানুষের জীবনবোধ, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছড়া। যা বক্তব্যপ্রধান, অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদে তীক্ষè, শানিত বক্তব্য ধারণ করে তা শিশুসাহিত্য নয়। এছাড়া কিছু ছড়া আছে বক্তব্য ধারণ করে বটে, কিন্তু শিশুদের আনন্দ দিতে, ঘুম পাড়াতে আবৃত্তি করা হয়। বক্তব্য আসলে নিমিত্ত মাত্র। ওই ছড়াগুলোকেও শিশুসাহিত্যের পর্যায়ে ধরা যায়। যেমনÑ খোকা ঘুমালো পড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে ...   দীপঙ্কর চক্রবর্তী : ছড়া সাহিত্যের একটা ধারা। যেমনÑ গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক বা উপন্যাস। শিশুদের জন্যও গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক বা উপন্যাস লেখা হয়। তাই বলে এসব ধারাকে কেউ শিশুসাহিত্য বলে না। ছড়াকেও শিশুসাহিত্য বলা ঠিক না। আনজীর লিটন : বিষয়বৈচিত্র্যে এবং উপস্থাপনশৈলী একটি সুলিখিত ছড়ার অনিবার্য শক্তি। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্তের ওপর ভর করে ছড়া যুগ যুগ ধরে প্রবহমান। সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারে ছড়াকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। ছড়ার সম্প্রসারিত রূপই হচ্ছে কবিতা। ছড়া লৌকিকতার গণ্ডি ভেঙে লাবণ্যে পরিপূর্ণ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। সেই থেকে ছড়া নিঃসন্দেহে আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। বদলেছে উপস্থাপন রীতি। বদলেছে বিষয় ভাবনা ছন্দ। বদলেছে চিত্রকল্প। সময়ের হাত ধরে বাস্তবতার নিরিখে ছড়া নতুন মাত্রায় বিকশিত হচ্ছে। ছড়ার প্রতি তৈরি হয়েছে ভালোবাসা। এ ভালোবাসা কোনো বয়সের জালে বাঁধা থাকুক তা-ও চাই না। আমি মনে করি, সাহিত্যের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ছড়া আবির্ভূত হয়েছে। ছড়ার ছন্দবদ্ধ দোলা শিশুদের আনন্দ দেয় বলে শিশুসাহিত্যর ঘরে ঢুকে পড়লো ছড়া, এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। ছড়া বড়দেরকে ভাবাতে পারে। সমাজ-প্রকৃতি চেনাতে পারে। চেতনাকে জাগাতে পারে। ছড়ার এই অন্তর্নিহিত শক্তি ছড়াকে আলাদা মাধুর্য দিয়েছে। তাই ছড়া শুধু ছোটদের নয়, বড়দের নয়, ছড়া আসলে পাঠকের।   অরুণ শীল : না, ছড়া শুধু শিশুসাহিত্য নয়। ছড়া সবার জন্য। তাই ছড়া সাহিত্য। ছোটদের বড়দের সকলের। শিশুর জন্য লিখলে তখন শুধু শিশুদের। ছড়া বেশির ভাগই সর্বজনীন। ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’ একটি সর্বজনীন ছড়া। ‘আমপাতা জোড়া জোড়া, মারবো চাবুক চড়বো ঘোড়া’ এটা শিশুতোষ হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু এটাও সবার। যেমন ক্ষুদ্র মানুষ, ক্ষুদ্র ঋণ ঋণ নিয়েছেন? কিস্তি দিন।   কিস্তি বাকি? নিচ্ছি খুলে ঘরের বেড়া চালের টিন।   আমরা হলাম এন জি ও খুলে নেবো গেঞ্জিও। এটা বক্তব্যধর্মী হলেও আজকের প্রাইমারি পড়ুয়ারাও জানে ঋণ কী, বা এনজিও কী। তাই এটাও সময়ের দাবিতে সর্বজনীন। ছড়া বক্তব্য ভেদে শ্রেণি বদলায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App