×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২১, ১২:২৪ এএম

পারমিতার জগৎ
ফরিদ আহমদ দুলাল আপনি এখন ঘুমান একটু। আমার একটা জরুরি ক্লাস আছে; ক্লাসটা শেষ করেই আসছি আবার।” সবুজ কে শুইয়ে দিয়ে আমি ক্লাসে চলে এলাম; কিন্তু সবুজের জন্য আজ আমার মনটা কেমন অস্থির লাগছে। আমার গ্রাম সম্পর্কে সবুজ এতো খোঁজ রাখে কী করে! দুর্গাপুরের ব্যাপারে এতো আবেগ কেনো কবির? দুর্গাপুরে কি কবির হৃদয়ঘটিত বিষয় আছে? স্যারের লেকচারে মন বসাতে পারলাম না কিছুতেই। বুকের ভেতর কী এক অস্থিরতা কাজ করছে। সবুজের ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় মনে হয়েছিলো, এ বেলা আর যাবো না। বিকেলের দিকে যাবো সবুজকে দেখতে; কিন্তু মন বলছে সবুজ যেনো আমার জন্যেই অপেক্ষা করছে। ক্লাসটা শেষ হতেই তাই ছুটলাম নিউ কেবিনের দিকে। এ ক’দিনে আজই প্রথম মনে হলো, আমি কাছে যাওয়াতে কবি খুশি হয়েছেন। কবিকে দেখে আজ অনেকটাই সুস্থ মনে হলো। আমি কবির চিকিৎসা সংক্রান্ত খোঁজ নিলাম। আগামীকাল কবির নতুন করে ড্রেসিং করার কথা। আমি কবির চুলে আঙুল চালিয়ে বললাম, “কবি আপনি তো এখন অনেকটাই সুস্থ। আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে? এখনও কি ব্যথা আছে কোনো?” কবি মৃদু হাসলেন, “সমস্যা কী? এতো যত্নের মধ্যে কারো কি খারাপ থাকার অবকাশ থাকে? আচ্ছা আমাকে রিলিজ করবে কবে?” আমি কবির চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললাম, “আপনাকে তো এখন সুস্থই বলা যায়। আগামীকাল আবার ড্রেসিং করা হবে। যদি কোনো কমপ্লিকেশন না থাকে তাহলে পরশু অথবা তার পরদিন রিলিজ করে দেয়া হতে পারে। আপনার বাড়ির লোকজন কোথায়? কখন আসবেন?” কবি নিজেই উঠে বসতে চেষ্টা করলেন, আমি তাকে সাহায্য করলাম। খাটে হেলান দিয়ে কবি বললেন, “আমার আত্মীয়-স্বজন বুঝে গেছে, ওরা না এলেও আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আপনি যেভাবে সেবা-যত্ন করছেন, তাতে তাদের আসাটা নিরর্থক প্রায়।” নিজের অজান্তেই ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল বুক থেকে। কবির চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললাম, “এই তো দু’দিনেই আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। এর পর আর কখনো মনেও পড়বে না প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই মেয়েটির কথা। আমার সৌভাগ্য একজন কবির অসুস্থতায় যৎকিঞ্চিত সেবা করার সুযোগ পেলাম।” আমার যে হাতটি কবির চুলে বিলি কাটছিলো, কবি হঠাৎ বাঁ হাতে সেটি ধরে সামনে নিয়ে এলেন, তারপর নিজের ডান হাত আমার হাতে রেখে বললেন, “আচ্ছা পারভিন, আপনি অনেক কথা জানেন; আপনি পাহাড়-দুহিতা নদীর সাথেও আপনার সখ্য, বলুন তো নদী কখনো রচনা করা যায়? যায় না, অলক্ষে সবার রচিত হয়ে যায় নদী। নদী কি নিজেই জানে তার জন্মপর্বের কথা? প্রকৃতির সকল সন্তান স্বতঃস্ফূর্ত। প্রেমও প্রকৃতির মতো স্বতঃস্ফূর্ত; পাহাড়-দুহিতা জানে না কখন তার মেঘখণ্ডের সাথে প্রণয় হয়ে যায়। কবিতার সাথে আপনার যে প্রণয়লীলা, তা-ও স্বতঃস্ফূর্ত। হয়তো আপনি জানতেও পারেননি কখন কবিতা আপনার বুকের ভেতর বাসা বেঁধেছে। কবিতাচর্চা আপনি না-ই করতে পারেন, কিন্তু কবিতালতা আপনাকে আশ্রয় করে পল্লবিত হতে চাইছে; আপনি তাকে প্রশ্রয় দেবেন কি-না তা আপনিই ভালো জানেন।” কবির কথায় আমি বিচলিত বোধ করছিলাম, প্রসঙ্গ বদলাতে তাই আমি বললাম, “পারমিতার মুখে শুনেছিলাম আপনি মানুষের হাত দেখে বলে দিতে পারেন তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ? আমার হাত দেখে বলবেন, কী আছে আমার ভবিষ্যতে?” আমার কথায় সবুজ শব্দ করে হেসে উঠতে গিয়ে হঠাৎ ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন। আমার বুকের মধ্যে যেনো মোচর দিয়ে উঠলো। নিজের অজান্তে কখন কবির যন্ত্রণাকাতর মুখটা নিজের সাথে জড়িয়ে নিলাম বুঝতে পারিনি। কবির মুখটা আমার গ্রীবার সাথে  মিশে আছে পরম নিশ্চিন্তে। কয়েক মুহূর্ত, তারপর কবি নিজেই সরে গেলেন; আমি আবার কবিকে খাটের রেলিঙে হেলান দিয়ে শুইয়ে সযত্নে প্রশ্ন করলাম, “আপনার কি কষ্ট হচ্ছে খুব? কোথায় সমস্যা হচ্ছে?” কবি নিজেকে সহজ করে নিয়ে বললেন, “না ঠিক আছে; আসলে হঠাৎ সশব্দে হাসতে গিয়ে চাপ লেগে গেলো। আচ্ছা, আপনি খেয়েছেন?” মনে হলো কবি আমাকে বিদায় দিতে চাইছেন। আমি মৃদু হেসে বললাম, “আমার খাওয়া নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না আপনাকে। আমি হোস্টেলে গিয়েই খেয়ে নেবো।” কবি বালিশের নিচ থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিলেন, তারপর বললেন, “এটা হোস্টেলে গিয়ে, খাওয়ার পরে দেখবেন।” কাগজটা আমি খাতার মধ্যে রাখলাম, কিন্তু কী আছে কাগজটাতে জানার জন্য ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলাম। সবুজকে শুইয়ে দিয়ে তার কপালে, গালে, দুই চোখের উপর মৃদু স্পর্শের আদর বুলিয়ে বেরিয়ে এলাম কেবিন থেকে। সামান্য পথ যেনো ফুরাতেই চায় না। বুকের ভেতর বারবার উঁকি দিচ্ছে, কী আছে কাগজটাতে? ঘরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করেই শুয়ে পড়লাম বিছানায়। খাতার ভেতর থেকে কাগজটা বের করে ভাঁজ খুলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে। কবি কেনো বললেন, খাওয়ার পর দেখতে? বুঝতে পারছি না কী লেখা আছে কাগজে? নিজের সাথে নিজেই তর্ক শুরু করলাম; শেষপর্যন্ত ভাবলাম, আচ্ছা খুলে দেখি, না পড়লাম; দেখেই রেখে দেবো, তারপর খেয়ে এসে পড়বো। নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না, খুলেই ফেললাম কাগজটা। খুলে দেখলাম কবিতা, তখন আর না পড়ে থাকতে পারলাম না-   পাহাড়-দুহিতা পাহাড়ের সাথে সখ্য পাথর-প্রতীমা সে যে পাহাড়ের মেয়ে আমি ভাবি মেঘ গুন টেনে উজান-সন্ধানে যাই ডিঙা বেয়ে নৈঃশব্দ্য মৌনতা তার কৃষ্ণকলি পাহাড়-দুহিতা চোখে তার মেঘের বিষাদ ঠোঁটে মৃদুহাসি প্রজ্ঞাপারমিতা সাতসমুদ্রের ওপারে ছিলাম হঠাৎ শ্রাবণ মেঘে দেখি স্বর্ণদ্যুতি পাহাড়ের গায়ে দেখি কালো মেঘে কৃষ্ণকলি-জ্যোতি; মিটাতে সহস্র বছরের তৃষ্ণা তেরোনদী পার হয়ে আসি দেখি মেঘ পাহাড় জড়িয়ে আছে আকাশে পূর্ণিমা কে যেনো বাজায় বাঁশি।   এ আমার সামান্য পৃথিবী ছোট জলাশয় ছোট ছোট সুখ আমার আকাশে তারা ঝিকিমিকি পাখি হাসিমুখ বসন্তবাউরি খঞ্জনা টিয়া ভোর-দোয়েলের গান আর আছে নিরুত্তর কথকতা লাবণ্যের মৌন অভিমান; তুমি পাহাড়ের কন্যা হলে আমি মেঘ শ্রীকৃষ্ণ-বালক মেঘবতী হও যদি নদীতীরে বংশীধারী আমি গো-পালক। কবিতাটা পড়া শেষ করে কাগজটা বালিশের নিচে রাখলাম। আবার বের করে আবার পড়লাম। দু’বার-তিনবার-পাঁচবার পড়া হলো; কবিতাটি ভাঁজ করে বুকের কাছে যত্নে রাখলাম। হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং-এ না গিয়ে কেনো যে হাসপাতালের দিকে পা বাড়ালাম বুঝতে পারলাম না। সোজা গিয়ে সবুজের দরোজায় দাঁড়ালাম। দরোজা খুলতে গিয়ে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো; কেনো এলাম এখানে? কী বলবো সবুজকে আমি? আমি কি তাকে প্রশ্ন করবো, কেনো এ কবিতা লিখেছেন আপনি? কী বলতে চেয়েছেন কবিতায় আমায়? কেনো আমার মনে অস্থিরতা জাগাচ্ছেন? কেনো স্বস্তি কেড়ে নিতে চাইছেন আমার? আমি তো আপনার সুন্দরী পারমিতা নই, আমি শ্যামলবরণ পাহাড়ের কুঁচবরণ মেয়ে, আমাকে নিয়ে কেনো আপনার কবিতা লেখা? এতোসব স্বগত অন্তর্জিজ্ঞাসার ফাঁকে কখন দরোজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেছি বুঝতেই পারিনি। মনে হলো সবুজ তন্দ্রাঘোরে, আমার উপস্থিতি কবি টের পায়নি। নিঃশব্দ হেঁটে সবুজের শয্যার কাছাকাছি দাঁড়ালাম। তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে আমার হঠাৎ বুক ভেঙে কান্না এলো। একবার মনে হলো কবিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলাম। সবুজের তন্দ্রাচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, কেনো তোমাকে আমার অতটা আপন মনে হয়? কেনো মনে হয়, তুমি আসলে আমার জন্যেই এখানে এসেছো? স্পর্শ করতে চেয়েও থামি; কেনো আমি সবুজের জন্য আকুল হচ্ছি? সবুজ তো আমার নয়, ও শুধুই পারমিতার। বন্ধু হয়ে আমি কি বন্ধুর সাথে প্রতারণা করছি? বুক থেকে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে। তন্দ্রার মধ্যেই সবুজ আমার উপস্থিতি টের পেয়ে হঠাৎ চোখ মেলে তাকালেন। সামনে আমায় দাঁড়ানো দেখে কবি যেনো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। শয্যায় দ্রুত উঠে বসতে চাইলেন, পলকে আমি জড়িয়ে ধরলাম তাকে। আমি জানি এভাবে হঠাৎ উঠতে গেলেই ব্যথা হবে, আজই একবার জোরে হাসতে গিয়ে ব্যথা হয়েছিলো। কবির নিঃশ্বাস আমার বুকে লাগছিলো। আমার ইচ্ছে হলো তাকে আরও নিবিড় করে বুকে জড়িয়ে ধরি। গোপন আকাক্সক্ষাটি চেপে রাখতে পারলাম না; শোয়া থেকে উঠিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসানোর আগে মুহূর্তের জন্য একবার বুকে চেপে ধরে আবার দূরে সরে এলাম। সবুজ কিছুটা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো, “বেলা কি অনেক হলো? আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?” : না বেলা অনেক হয়নি। কিন্তু আমি ঘরে থাকতে পারলাম না। কে যেনো আমায় জোর করে এখানে টেনে আনলো। আমি এসে কি আপনার বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটালাম? : বিশ্রামের দীর্ঘসূত্রিতায় আমি ক্লান্ত। শুয়ে থেকে থেকেই পরিশ্রান্ত আমি। আপনি পাশে থাকা মানেই তো স্বস্তি আমার। সারাদিন থাকুন না কাছে, ক্লান্ত হবো না। একাকীত্বের ক্লেশ যে-কোনো পরিশ্রমের চেয়ে কম নয়। মানুষের জন্য আনন্দই সবচেয়ে বড় বিশ্রাম, নিরানন্দে কেবল ক্লান্তির যোগ। পাহাড় ছুঁয়ে থাকা মেঘেদের ক্লান্তি ছিলো কবে? যদি পাহাড়কে ভিজিয়ে দিতে পারে তাতেই তো মেঘের আনন্দ। : পাথুরে পাহাড় কখনো কি ভেজে? নজরুলের কবিতায় আছে না? “হাজার বছর ঝর্নায় ডুবে রস পায়নি-কো নুড়ি”! তাই তো পাহাড়ের অতৃপ্ত তৃষ্ণা। : আশ্চর্য! পাহাড়ে আপনি বৃক্ষ জন্মাতে দেখেননি? : সবুজের তৃষ্ণায়ই তো কবির কাছে পাহাড়-দুহিতার ছুটে আসা। তৃষ্ণা এমন এক যন্ত্রণা, যা থেকে মুক্তি পাওয়া দুঃসাধ্য। : আপনি কি সত্যি মুক্তি পেতে চান? তাহলে আর একটা সত্যি বলুন, দুপুরের খাবার খেয়েছেন? চেষ্টা করেও মিথ্যা বলতে পারলাম না। : খাইনি। আসলে আমার  খেতে ইচ্ছে হলো না। খিদে পায়নি একদম। : নিশ্চয়ই আপনি না খেয়েই কবিতাটা পড়েছেন! আমি কিন্তু আপনাকে বলেছিলাম খাবার পরে পড়তে? : একটু আগে আপনিই তো বলেছেন, নদী কি আর রচনা করা যায়? অলক্ষে সবার রচিত হয়ে যায় নদী। বলেন নি? এখন আপনি বলুন, কেনো আপনি এ কবিতা লিখেছেন? : উত্তর তো একটাই, নদী কি আর কখনো রচনা করা যায়! অলক্ষে সবার রচিত হয়ে যায় নদী। দেখুন পারভিন, একজন পাহাড়-দুহিতার আবেগ আমি উপলব্ধি করতে পারি; তাই আমি আপনাকে সতর্ক করে বলেছিলাম, খাওয়ার পর কবিতাটা পড়তে। আমি জনতাম, কবিতাটি পড়লে আপনার আর খাওয়ার আগ্রহ থাকবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App