×

সারাদেশ

কী ঘটেছিল সুনামগঞ্জে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২১, ০৮:২৫ এএম

কী ঘটেছিল সুনামগঞ্জে

নোয়াগাঁও ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের হেফাজতে ইসলাম সমর্থকরা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ছবি: সংগৃহীত

অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের পরও বিক্ষোভের ঘোষণা দেয় হেফাজত। দেশবিরোধী শক্তির যোগসাজশ অনুসন্ধানে গোয়েন্দারা।

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৯০টি পরিবার। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন গ্রামের শত শত সংখ্যালঘু মানুষ। যদিও স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। কেন তাদের ওপর হামলা হলো? এর জবাব পাচ্ছেন না তারা। বিশেষ করে আশঙ্কা ব্যক্ত করে প্রশাসনকে ঘটনা জানানো এবং অভিযুক্ত ফেসবুক স্ট্যাটাসকারীকে পুলিশে দেয়ার পরও কেন হামলা? শুধুই কি ফেসবুক স্ট্যাটাস দায়ী? নাকি অন্যকোনো উদ্দেশ্য ছিল ওই হামলার নেপথ্যে? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন তারা। এই হামলার নেপথ্যে হেফাজতের পাশাপাশি দেশবিরোধী শক্তির যোগসাজশ অনুসন্ধানে নেমেছে গোয়েন্দারা। বিশেষ করে মুজিব জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদ্বোধনী দিনে হামলার নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।

অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজনীতিবিদ, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। সিলেট, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশও হয়েছে। হামলার প্রতিবাদে আজ বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সিলেট বিভাগে এবং বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট সুনামগঞ্জ শহরে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এছাড়া আগামী ২৫ মার্চ দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করবে পূজা উদযাপন পরিষদ। গতকাল এক বিবৃতিতে হামলার বিচার চেয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এদিকে হামলার একদিন পর গতকাল ৭০ জনের নামসহ ৭০০ জনকে আসামি করে শাল্লা থানায় মামলা করা হয়েছে।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত : ১৫ মার্চ শাল্লার পাশের দিরাইয়ে সমাবেশ করে হেফাজত। ওই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য রাখেন মাওলানা মামুনুল হক। পরদিনই নোয়াগাঁও গ্রামের গোপেশ দাসের ছেলে ঝুমন দাসের (২৫) স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে এলাকাবাসী।

ঝুমন দাসকে পুলিশে দেয়ার পর স্থানীয়রা আশা করেছিল, অনাকাক্সিক্ষত কিছু হবে না। কিন্তু গত বুধবার সকালে উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে পাশের কয়েকটি গ্রামের চার শতাধিক মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। ওই হামলায় নোয়াগাঁওয়ের কমপক্ষে ৯০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ ওই গ্রামে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

নোয়াগাঁও গ্রামের একাধিক বাসিন্দার ভাষ্য, গত বুধবার সকাল থেকে আশপাশের অন্তত চার গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে লাঠিসোঁটা, দা, রামদা, কিরিচসহ নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নোয়াগাঁও গ্রামে হামলার প্রস্তুতি নেন। এর মধ্যে কাশিপুর, দিরাই উপজেলার নাসনি, চণ্ডীপুর ও সন্তোষপুর গ্রামের লোকজন ছিলেন। হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। কয়েকটি ঘরের জিনিসপত্রও লুট করা হয়েছে। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর মানুষ বাড়িতে ফিরে আসেন। তবে এখনো ভয়-আতঙ্কে আছেন তারা। আতঙ্ক সত্তে¡ও গ্রামের নিরাপত্তায় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ ছিল না কেন? কেন ছিল না পুলিশের বাড়তি নজরদারি? এসব বিষয়ের উত্তর খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা।

নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা জগদীশ চন্দ্র দাস বলেন, যে ছেলেটি ফেসবুকে আপত্তিকর কথাবার্তা লিখেছে, তাকে আমরাই ধরে পুলিশে দিয়েছি। আমরা ভাবতেই পারিনি এরপর গ্রামে হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। মানুষজন চরম ভয়ে আছে। একই গ্রামের রন্টু দাস বলেন, আমাদের কী দোষ? আমরা কী করেছি? আমাদের ওপর এমন অত্যাচার কেন? ঘরের মন্দির থেকে শুরু করে সব ভেঙেছে তারা। আমরা আতঙ্কে আছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাল্লা সদরের দুজন ব্যবসায়ী বলেন, ঝুটন দাসকে আটকের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাজারের দোকানপাট খুলতে নিষেধ করা হয়। সকালে নোয়াগাঁও গ্রামে হামলার পর শাল্লা সদর বাজারেও হামলার চেষ্টা চালান স্থানীয় আটগাঁও গ্রামের লোকজন। পরে প্রশাসন ও পুলিশের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়।

শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরী বলেন, হামলার জন্য লোকজন জড়ো হয়েছিলেন বেশি। পরে অন্য লোকরাই হামলা করতে বাধা দেন। তারপরও ২০-২৫ জন যুবক গ্রামে ঢুকে ভাঙচুর করেছেন। আমরা পুরো এলাকার মানুষকে নিয়ে বৈঠক করে পরিস্থিতি শান্ত রাখার অনুরোধ জানিয়েছি। ওই বৈঠকে এলাকার আলেম-ওলামারাও ছিলেন।

দিরাই উপজেলা হেফাজতে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মুক্তার হোসেন চৌধুরী বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি দোষ করেন, তাহলে তাকে আইনের আওতায় আনাটা স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু এভাবে হামলা-ভাঙচুর হেফাজতে ইসলাম সমর্থন করে না। যারা হামলা-ভাঙচুর করেছেন তিনি তাদের শাস্তি দাবি করেন।

অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন বলেন, হামলার সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের ‘কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই’। স্থানীয় হেফাজতে ইসলামের নেতারা হামলাকারীদের প্রতিরোধ করেছে, বাধা দিয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দিয়েছে। তাছাড়া দিনে হামলার পর রাতে ফেসবুক লাইভে মাওলানা মামুনুল হক বলেন, কিছু লোক হিন্দুদের বাড়িতে আক্রমণ করেছে। এর দায়দায়িত্ব কোনো আলেম নেবে না এবং নেয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।

এদিকে সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় শাল্লা থানায় গতকাল একটি মামলা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজমুল হক বলেন, মামলায় আসামি করা হয়েছে ৭০০ জনকে। এর মধ্যে ৭০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাকিরা অজ্ঞাত। তদন্তের স্বার্থে এর বেশি জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, মামলার আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (রাত ৮টা) পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

অন্যদিকে সুনামগঞ্জে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার জন্য সরকারের অপশাসনকে দায়ী করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বারবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বললেও তাদের আমলেই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তিনি আরো বলেন, এই ঘটনা অশনি সংকেত। দেশের জনগণ এখন ভয়ঙ্কর দুঃসময়ের মধ্যে দিন পার করছে। ভয়াল পরিবেশের কারণে এদেশে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে পারেনি এবং তাদের নিরাপত্তাও দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

এদিকে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত সবার গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ আয়োজিত সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, সুনামগঞ্জে নিয়োজিত প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের প্রতি আমি ধিক্কার জানাই। দুদিন আগে পরিকল্পনা করে এই হামলা চালানো হয়েছে।

আর সুনামগঞ্জে হামলাকারীদের শাস্তির আওতায় আনার আশ্বাস দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App