একজন কালিচরণের আত্মবয়ান
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২১, ১২:২৪ এএম
সনোজ কুণ্ডু
কালিচরণের আস্তানা জুড়ে শুধুই অন্ধকার। অন্ধকার নিয়েই তার বসবাস। রাস্তাঘাটে পাগলাটে স্বভাবটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও ঘরে বেশ শান্ত। তবে বগবগানি চলে একটানা। মাথার ওপর ছিন্ন ভিন্ন ছোনের ছাউনিটা লাঠি দিয়ে ফাঁক করে দেয়। মুহূর্তেই একফালি চাঁদ দৃষ্টি রাখে তার জীর্ণ ঘরে। সেই আলোতেই বঙ্গবন্ধুর ছবিখানা ঝলমলিয়ে ওঠে। বুকের সাথে মিশিয়ে বলতে থাকেÑ
‘ইস্ শালাগো বাজানের দ্যাশ। জিডা খুশি করবি। শেখসাব কি মইরা গ্যাছে নাকি? এই দ্যাশেই আছে।’
নজর আলী আয়েশী ভঙ্গিমায় কালিচরণের আস্তানায় উঁকি দেয়। দে’শলাইর কাঠিতে সিগারেট ধরায়। দ্বিতীয় দমের ধোঁয়া কালিচরণের মুখের ওপর ছাড়ে। দাঁতে দাঁত রেখে একাত্তরের পরাজয়ের খায়েশ মেটায়Ñ
‘এই মুক্তিযোদ্ধার বাচ্চা, শেখসাব কি তোর বাজান? তোর বাজান আমি। নজর আলী। মনে কইরা দ্যাহেক, সেই যুদ্ধির রাইতের কথা। তোর বউরে বস্ত্রহীন কইরা ইজ্জত কাইড়া নিছিলাম, সেদিন আমারে বাপ ডাকছিলি। আহারে সেই ছিন ভুলবার পারি না!’
কথাগুলো শেষ না হতে চোখ বন্ধ রেখে আবার সিগারেটে সুখ টান দেয়।
বঙ্গবন্ধুর ছবিটাকে কালিচরণ মালা পরিয়ে রেখেছে। নজর আলীর চোখ পড়তেই ভেঙে যাওয়া খান খান বুক আরেক দফা হোঁচট খায়। জ্বলন্ত সিগারেট কালিচরণের বুকের ওপর ছুড়ে মারে। চ্যালারা বঙ্গবন্ধুর ছবিটাকে আগুন ধরিয়ে তার লোমশ বুকে নিক্ষেপ করে।
বিকট চিৎকারে লাফিয়ে ওঠে কালিচরণ। আগুনমূর্তি ধারণ করে সে। এমন ভয়াল রূপ জীবনে তারা দেখেনি। অর্ধেক পুড়ে যাওয়া ছবিটা নিজের বুকে ঘঁষে আগুন নেভায়। লাঠি হাতে নজর আলীর পিছু নেয়।
কালিচরণ যেন একাত্তরের মাঠে।
তার মনে যুদ্ধের তোলপাড়। সে এখন সাহসী বীর। উত্তপ্ত স্বাধীনতা! কে তাকে পাগল বলবে? মাঠ-ঘাট পেরিয়ে হন্যে হয়ে সে ছুটে চলে। একসময় মুখ থুবড়েও পড়েÑ আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে একটা শব্দই দু’বার উচ্চারণ করেÑ
‘জয় বাংলা’!
কালিচরণের ওই বুকফাটা আর্তনাদ আকাশে-বাতাসে এমনকি সবার হৃদয়ে পৌঁছে যায়। এভাবে তাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি।
তবে অসহায় চিৎকারে সারা গ্রামে শোক নেমে আসেÑ বঙ্গবন্ধুর ছবির আধপোড়া অংশ বুকে চেপে বাড়ি বাড়ি ঘুরে আর্তনাদ প্রকাশ করে। সমস্ত গ্রামবাসীর কাছে সে বিচার চায়।
কালিচরণের রাত্রিভাঙা চিৎকারে মাসুদের বুক ফালা ফালা হয়ে যায়। মাথার ভেতর প্রতিশোধের নেশায় অস্থির হয়ে ওঠে। দেশ স্বাধীনের এত বছরেও নিশ্চিন্তপুর যেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি। মাসুদের নেতৃত্বে একদল যুবক রাতের বেলা গ্রামের নিরীহ পরিবারগুরোকে নিরাপত্তা দিয়ে রাখে।
তালতলা পথ ধরে নজর আলীরা হাঁটছে। কালিচরণের বুকে আগুন ধরিয়ে সে বেশ ফুর ফুরে মেজাজেই আছে। হঠাৎ মাসুদের মুখোমুখি হওয়ায় বেশ বিচলিত। মাসুদের কণ্ঠ রাগে টগবগ করছে।
‘আচ্ছা বলুন তো, কালিচরণ কাকার ওপর আপনার এতো ক্ষোভ কেনো?’
‘ধুর বোকা, ক্ষোভ কও ক্যান? পাগলের সাথে এট্টু তামাশা করি। কি সোন্দর আমাগো ভয় দেহায়Ñ ওই যে শ্যাখসাব আইছে। আহারে! ওই ডাইলক খালি শোনবার ইচ্ছে করে।’
‘একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে তামাশা করতে আপনার লজ্জা করে না?’
‘আরে রাহ মিয়া, অতো লাফাও ক্যান? মুক্তিযোদ্ধাগো তুমরা দেব্তার আসনে বসাও ক্ষতি নাইÑ তয় এই গিরামের ব্যাবাক মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু ধোয়া তুলসি পাতা ছিল না। যুদ্ধির সময় তুমাগো ওই হাতেম আলী আমার দলের লোক ছিলোÑ পরে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিছে। ওই সালাইতো রাইতে দরজা ভাইঙ্গা সীতানাথের সুন্দরী বউয়ের ইজ্জত নষ্ট করছে। আমার নাম ভাঙ্গাইয়া ভ্যাগাগো বাড়ি লুট করছে ওই হাতেম আলী।’
‘চুপ করুন আপনি। দু-একজনের অপরাধের জন্য আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের অপবাদ দিতে পারেন না। দেশের জন্যি যারা জীবন পর্যন্ত দিলো তাদের নামে.... ছি! ছি!’
নজর আলী রাতের নীরবতা চৌচির করে হা হা শব্দে হাসতে থাকে। সে হাসির সাথে তাল মেলায় ছিরু, গেদু মুন্সীরা। আমিনুল গেদু মুন্সীকে ধমক দিয়ে হাসি থামায়। কিন্তু নজর আলীর হাসি কেউ থামাতে পারে না। মাসুদের চোখে টর্চ মেরে বলতে বলতে চলে যায়Ñ
‘বড় নেতা হইছে। এই নজর আলী জীবনে বহু নেতা দ্যাখছে। কাইলকার ছাওয়াল, আমারে ইতিহাস শেখায়!’
নজর আলীর তাচ্ছিল্যের হাসিটা মাসুদের রাতের ঘুম হারাম করে দেয়। প্রতিশোধের নেশায় সে অস্থির হয়ে ওঠে। তখনি
অলোক আঙিনায় পা রাখে। মাসুদকে নিয়ে যায় ঘটনাস্থলে। উপস্থিত হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যেরÑ
দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে পরিমল সাহা।
ওদের দেখে ভ্যান থেকে নেমে আসে তার স্ত্রী বন্দনা। পরিমল নামে না। নামতে চায়ও না। গাড়ির শ্লথ গতির মতোই অশ্রু বিসর্জন দেয় নিচু মাথায়। বুকে তার আজন্মের ক্ষোভ। চোখে জল। স্মৃতিতে মায়া। অন্তরে মাটির অস্তিত্ব; জন্মস্থানের জ্বলন্ত স্মৃতি নিয়ে সে চলে যাচ্ছে।
পরিমল নিশ্চিন্তপুর প্রাইমারি স্কুলে অংক শেখায়। জীবন অংক মেলাতে পারেনি বলেই হিসাবে বেঁধেছে গড়মিল। তাইতো চলে যাচ্ছে আপন মাটি ছেড়ে-অন্য মাটির টানে। মাসুদের মনে সহস্র প্রশ্নপাখি ডানা ঝাপটায়Ñ
‘বৌদি তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’
বন্দনা বোবা কান্নায় ফেটে পড়ে। শাড়ির আঁচল দিয়ে অশ্রু রোধ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়Ñ
‘ভারতে।’
‘নিজের দেশ ছেড়ে ভারতে।’
‘তার আগে বলো এ দেশ কাদের?’
‘কেনো আমাদের।’
‘ঠিক বলেছো, আসলেই তোমাদের!’
‘কেনো বৌদি, দেশটা কি তোমার নয়? দাদাতো দেশের জন্যই....।
‘আমি তো তাই জানতাম মাসুদ। কিন্তু সব ভুল, সব মিথ্যেÑ’
কান্নার ঢেউ বন্দনার কণ্ঠকে বোবা করে দেয়। কিছুই বলতে পারে না। অবশ্য মাসুদ পরিমলদার সব সুখ-দুঃখের সাথী। জানে ওই পরিবারের শুরু ও শেষ।
পরিমল দেশ স্বাধীন করে পঙ্গু হয়েও বীরের বেশে বাড়ি ফিরলো। সে কী উল্লাস! আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে! দেশের যুদ্ধ শেষ হলেও অবতীর্ণ হতে হয় নিয়তির মুখোমুখি যুদ্ধে। একদিকে পঙ্গুত্বের বোঝা, অন্যদিকে বেকারত্ব। কেউ খবর নিলো না।
‘আমি মুক্তিযোদ্ধাÑ’
এই গর্ব ধীরে ধীরে পুরস্কারের বদলে তিরস্কার এনে দেয়। এই অহংকার ক্ষুধা দমিয়ে রাখতে পারে না। চিকিৎসার অভাবে দশ বছরের নাদুস-নুদুস ছেলে রাম বন্দনার কোলে ছটফট করে মরলো, কেউ ফিরে দেখলো না। দুঃখের ওজন নিঃশ্বাসের সাথে বাড়তে থাকে। যুদ্ধ করে দেশ টিকিয়ে রাখলেও নিজের ভিটে-মাটি রক্ষা করতে পারলো না। নজর আলী জাল দলিল করে সব দখল নিয়ে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেয়। এখানেই শেষ নয়Ñ
নিজ যোগ্যতার বলে জুটিয়ে নিয়েছিল হাই স্কুলের চাকরিÑ শেষ পর্যন্ত তাও হারাতে হলো। স্কুল ফান্ডের টাকা আত্মসাতের ওজুহাতে পরিমলকে বরখাস্ত করা হলো। ওদের ক্ষমতা যে অসীম। ওই নজর আলীরা শুধু স্কুল সভাপতি কেনোÑ দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সভাপতির আসন অলংকৃত হয়ে আজকাল মাল্য ভূষিত হয়।
মাসুদের হৃদয় দিগন্তে স্মৃতিরা তোলপাড় শুরু করে। ভেসে ওঠে পরিমল’দার আরো দুঃখের ইতিহাসÑ কিন্তু পরিমল আর দুঃখ পেতে রাজি নয়। জীবনের শেষ সময়টুকু সুখের গাঙ-স্রোতে নিজেকে ভাসাতে চায়। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায় স্বাধীন চেতনায়।
মাসুদ ভ্যানে বসা পরিমলের কাছে যায়। এতদিনের ভালোবাসার রশি দিয়ে তাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেÑ
‘আমাদের সাধনাকে নষ্ট করে দিও না পরি’দা। আগামীকাল ‘অনাথ আশ্রম’ উদ্বোধনে তুমি যে সভাপতি!’
‘জীবনের শেষ কিনারায় এসে এই সম্মানটুকুও আমার কপালে জুটলো না মাসুদ। তুমি বাড়ি ফিরে যাও!’
সত্তায় গেঁথে নেয়া স্বাধীনতার স্লোগানকে ধারণ করেই তারা বিদায়ের পা বাড়ায়Ñ মাসুদ হৃদয় থেকে অনুভব করে বাঙালির শব্দপতন।
বন্দনা বৌদির পায়ের কাছে ধপাস বসে পড়ে মাসুদ।
‘দেশ ছেড়ে তোমরা যেও না বৌদি! দাদাকে তুমি বোঝাও। এ দেশ পরিমলদাদের। এ দেশ মুক্তিযোদ্ধাদের। ইতিহাস সাক্ষী!’
এবার পরিমলের ক্ষোভ জড়িত কণ্ঠÑ
‘মাসুদরে, বাংলার মানুষকে হয়তো আমরা ঠকিয়েছি। একাত্তরে এ দেশ স্বাধীন হলেও আমরা কি স্বাধীনতা পেয়েছি? তোমরা হিসেব মিলিয়ে নিও একদিন। অন্তত তোমাদের জানা বড় প্রয়োজন। স্বাধীন বলে যারা চিৎকার করে; তারাও শোষণের শৃঙ্খলে বন্দি! এ মাটিতেই আরেকটি একাত্তরের বড় প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? সকল অনিয়মের কোমল বালিশে যে বাঙালি কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমে বিভোরÑ তাদের ঘুম ভাঙাতে হবে তোমাদেরই।
বদলাতে হবে জাতিসত্তার নগ্নরূপ!
দুঃখ একটাই, যদি সত্যিই আগামীতে আরেকটি একাত্তরের প্রয়োজন হয়Ñ সে যুদ্ধের তারিখ ঘোষণা করার কেউ রইলো না! আর কারো বিপ্লবী কবিতায় ভস্মীভূত হবে না শোষণের লৌহ প্রাচীর। অভাগা জাতিকে দেখাবে না মুক্তির পথÑ সে তারিখ ঘোষণা করতে হবে তোমাদেরই। ওড়াতে হবে বিজয় কেতন। মনে রেখো, সে যুদ্ধে মুখোমুখি হতে হবে শত-সহস্র মীর জাফরদের। বাঙালির সাথে বাঙালিরÑ
‘কিন্তু যুদ্ধের মাঠে যে নেতৃত্ব চাইÑ’
বাদল পেছন থেকে তেজদীপ্ত কণ্ঠে কথাটা বলে পরিমলের পথ আগলে দাঁড়ায়। কিছুতেই তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে দেবে না। পরিমল বাদলের পিঠে হাত রাখেÑ
‘বাদল তুমি এখানে?’
‘হ্যাঁ পরিমল দা, যুদ্ধের মাঠে একজন সাহসী নেতা চাইÑতোমাকেই সে নেতৃত্ব দিতে হবে!’
‘আমি দেবো নেতৃত্ব?’
‘হ্যাঁ দাদা, তুমিই দেবে সে নেতৃত্ব। তুমিই যে আমাদের নেতা।’
‘নারে বাদল, আমার সময় যে ফুরিয়ে গেছে, এখন তোমাদের পালা। আমাকে তুমি যেতে দাও।’
‘যদি সত্যি চলে যেতে চাও, তাহলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে তোমাকে যেতে হবে।’
‘এ তুমি কি বলছো বাদল?’
‘হ্যাঁ, মিথ্যে কিছু বলিনি। এবার তুমি ভেবে দেখো।’
পরিমলের বুকে চেপে থাকা দীর্ঘশ্বাসের দমটা যেন ফাঁত করে বেরিয়ে আসে। বাদলকে বুকে টেনে নেয়। মাসুদের ঠোঁটেও মিটমিটে হাসি। বন্দনা বৌদির হাত থেকে ব্যাগটা একরকম ছিনিয়ে নেয় অলোক। বাদল কান্না মুছে শোনাতে থাকে মনের কথাÑ
‘দেশটা আমরা নতুন করে সাজাতে চাই দাদা। তোমরা না থাকলে আমাদের কে নেতৃত্ব দেবে? কে সাহস জোগাবে?’
‘আমাকে নতুন ভালোবাসার সুতোয় গেঁথো না বাদল। আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা।’
‘না পরিমল দা, যেতে দেবো না। আমি জানি নজর চাচার ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভে তুমি চলে যেতে চাচ্ছো। কথা দিলাম, আজ থেকে তুমি পাবে যোগ্য সম্মানÑ সব কিছু ফিরিয়ে দেবো তোমাকে। আবার মাথা উঁচু করে চলবে তুমি; তোমার দেশেইÑ’
পরিমল কান্নায় অস্থির হয়ে ওঠে। বন্দনার হাত চেপে ধরেÑ নতুন কিছু পাওয়ার আনন্দে, হয়তো নতুন কোনো সৃষ্টি অথবা শক্তিতে।
‘এ মাটি ছেড়ে আমি যেতে পারি না বন্দনা!’
পরিমলদাকে ওরা শূন্যে তুলে ধরে। অলোক বন্দনা বৌদির দু’পা স্পর্শ করে পরম শ্রদ্ধায়Ñ ভালোবাসায়।
পরিমলের সমস্ত চলার পথে যেন জ্যোৎস্নার রূপ উছ্লে পড়ে।