×

জাতীয়

ডিপ ফ্রিজই যেন সমাধি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২১, ০৮:৪০ এএম

ডিপ ফ্রিজই যেন সমাধি!

আইনি জটিলতা, ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তি, জন্মভূমি নিতে না চাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মৃত্যুর পর বছরের পর বছর মর্গের হিমঘরেই পড়ে তাদের লাশ।

ঢামেক মর্গে কয়েক বছর ধরে পড়ে আছে চার জনের লাশ ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তিতে ৫ বছরেও শেষকৃত্য হয়নি ব্যবসায়ীর ৩ বিদেশির লাশ নিয়ে আছে নানা জটিলতা

‘জম্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীর হায়রে জীবন নদে?’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার লাইন দুটির মতোই চিরসত্য মানুষের জীবন। একবার জন্ম নিলে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। নিয়তির এ লিখন খণ্ডানো অসম্ভব জেনেই মৃত্যুর অপেক্ষায় চলতে থাকে জীবন সংগ্রাম। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে সবারই চাওয়া থাকে মৃত্যুর পর নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী দাফন/সৎকার যেন অন্তত হয়। প্রায় সবার বেলায় এ নিয়ম পালন করা হলেও হতভাগ্য কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে ব্যতিক্রম। আইনি জটিলতা, ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তি, জন্মভূমি নিতে না চাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মৃত্যুর পর বছরের পর বছর মর্গের হিমঘরেই পড়ে তাদের লাশ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে কয়েক বছর ধরে পড়ে আছে তেমনই ৪টি লাশ। এগুলো কবে হস্তান্তরিত হবে বা আর কতদিন মর্গে পড়ে থাকবে সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে জানেনা কেউ। দীর্ঘদিনেও লাশগুলোর কোনো সুরাহা না হওয়ায় অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হিমঘরের ওই ডিপ ফ্রিজেই যেন হয়ে গেছে তাদের সমাধি!

দুই স্ত্রীর মামলায় ৫ বছর হিমঘরে ব্যবসায়ীর লাশ : ব্যবসায়ী খোকন চৌধুরী ওরফে খোকন নন্দী। নামের মতোই রহস্যঘেরা ছিল তার জীবন। দুই স্ত্রীর মধ্যে ১ জন হিন্দু, অপরজন মুসলিম ধর্মাবলম্বী। একই সঙ্গে দুই ধর্মের নিয়ম মেনে চালিয়ে গেছেন সংসার। যার রেশ শুরু হয়েছে মৃত্যুর পর। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বে তার লাশ ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পড়ে আছে ঢামেক মর্গের হিমঘরে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৪ জুন দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আক্তার ওরফে বাবলির বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে খোকন চৌধুরীকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ২৬ জুন ৭৮ বছর বয়সি খোকন মারা যান। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে স্বামীর মরদেহ দাফনের উদ্যোগ নেন বাবলি। এতে বাধা দেয় খোকনের প্রথম স্ত্রী মীরা নন্দী এবং দুই সন্তান বাবলু নন্দী ও চন্দনা নন্দী। সনাতন রীতি অনুযায়ী সৎকারের জন্য মরদেহ নিয়ে যেতে চান তারা। এই প্রেক্ষাপটে ঘটনাস্থলে যায় রমনা থানার পুলিশ। তারাও বিষয়টির সমাধান করতে না পেরে দেওয়ানি আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এরপর আদালতে মামলা হয়।

২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার সহকারী জজ আদালত (দেওয়ানি মামলা নম্বর ২৫২/১৪, ঢাকা) বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় ও তদারকিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মরচুয়ারিতে ব্যবসায়ী খোকনের মরদেহটি সংরক্ষণের আদেশ দেয়। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে বারডেম কর্তৃপক্ষ ব্যাগে ভরে মরদেহটি ঢামেকের মর্গে দিয়ে যায়। এরপর থেকে লাশটি সেখানেই পড়ে আছে।

এদিকে, ধর্ম নিয়ে দুই স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ চললেও এই দীর্ঘ সময়ে খোকনের মরদেহের খোঁজ নিতে আসেননি দাবিদার কেউ। জানা গেছে, খোকনের এই ধর্মের বিষয়টি সুরাহা হওয়ার পেছনে রয়েছে বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় তিনতলা মার্কেটসহ শত কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তির মালিক ছিলেন খোকন। তবে, ব্যক্তিগত জীবনে রহস্যঘেরা খোকন হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্ম মেনে দুই পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলায় এ মালিকানা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা বিভ্রান্তি।

খোকনের স্ত্রী বাবলি জানান, পল্টনে এক চটপটির দোকানে পরিচয়ের পর ১৯৮৪ সালের ২ জুলাই খোকনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। আর বিয়ের আগে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেভিট করে খোকন নন্দী ধর্মান্তরিত হন। নাম রাখেন খোকন চৌধুরী। তাদের বিয়ের কাবিননামা ও এফিডেভিট আছে। আদালতে সব নথিপত্র উপস্থাপন করেছেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি খোকনের পরিবারের সবাই জানতেন। কিন্তু প্রথম স্ত্রী সম্পত্তির লোভে লাশ দাফন করতে দিচ্ছেন না। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অনেক চেষ্টা করেও খোকনের প্রথম স্ত্রী মীরা নন্দীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

২০ মাসেও লাশ নেয়নি মার্কিন দূতাবাস : মার্কিন নাগরিক রবার্ট মাইরন বার্কেটের লাশ ২০১৮ সালের ২৫ মে থেকে ঢামেক মর্গে পড়ে থাকলেও দেশটির দূতাবাস লাশ নেয়ার আগ্রহ দেখায়নি। জানা গেছে, ২০০৫ সালে একটি এনজিওর প্রতিনিধি হয়ে বাংলাদেশে এসে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন বার্কেট। অসুস্থ এক শিশুকে চিকিৎসা দিতে উত্তরা কমিউনিটি হাসপাতালে গিয়ে পরিচিত হন রাজধানীর দক্ষিণখানের বাসিন্দা মাজেদা বেগমের সঙ্গে। ২০০৭ সালে তারা বিয়ে করেন এবং দক্ষিণখানের চালাবন্দ মাটির মসজিদ এলাকার ৭৩৯/১ নম্বর বাড়িতে সংসার পাতেন। আমেরিকায় রবার্ট বার্কেটের পরিবার থাকলেও সেখানে তিনি আর ফিরে যাননি। ২০১৮ সালের ২৫ মে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান বার্কেট। এরপর থেকে তার লাশ ঢামেকেই পড়ে আছে।

রবার্ট মাইরন বার্কেটের স্ত্রী মাজেদা বেগম জানান, স্বামীর লাশ সৎকারের জন্য ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসে যোগাযোগ করেছেন। তারা বলেছে, আমেরিকায় বসবাসরত বার্কেটের পরিবার থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না এলে লাশ দেয়া হবে না। বার্কেটের মৃত্যুর পর থেকে আমেরিকান দূতাবাসে একাধিকবার যোগাযোগ করে যাচ্ছেন মাজেদা বেগম। কিন্তু সাড়া না পাওয়ায় তার লাশ সৎকারও করা যাচ্ছে না।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসে ঠিকানা ঢামেক মর্গ : ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢামেক মর্গে পড়ে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক থিইসিয়া সিকেওয়েস্ট ওরফে তিশা জামানের লাশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার দেবিপুর গ্রামের হাসানুজ্জামান রিপন কাজের সন্ধানে বেশ কয়েক বছর আগে পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকান তরুণী থিইসিয়া সিকেওয়েস্টের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

একপর্যায়ে তারা বিয়ে করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে থিইসিয়া নিজের নাম রাখেন তিশা জামান। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি বাংলাদেশে আসেন তিশা। একমাত্র ছেলের বউ ভিনদেশি হওয়ায় মেনে নিতে পারছিলেন না হাসানুজ্জামানের বাবা-মা। তাই কিছুদিন যেতে না যেতেই সংসারে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। স্বামীকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে যেতে চান তিশা। কিন্তু হাসানুজ্জামান আর দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতে রাজি হননি। ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিশা কীটনাশক পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে আর বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান তিশা। সেই থেকে তার লাশ ঢামেক মর্গের হিমাগারে পড়ে আছে।

হাসানুজ্জামানের পরিবারের দাবি, তিশা কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করেন। তবে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে চৌদ্দগ্রাম থানায় মামলা এবং হাসানুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। এ মামলায় দুই মাসের মাথায় চার্জশিট দেয়া হয়। পুলিশ বলছে, বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাস না থাকায় তিশার লাশের দাফন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতে দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাস রয়েছে। সেখানে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া পাননি। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। আদালতের নির্দেশ পেলে এ বিষয়ে সমাধানে আসা যাবে।

ভারতীয় মানিকন্ডার লাশ পাঠানোর অগ্রগতি অজানা : ২০১৭ সালের অক্টোবরে দিনাজপুরের বিরল থানার এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে গ্রেপ্তার হন ভারতীয় নাগরিক মানিক-া। তার বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে পাঠানো হয় কারাগারে। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে ২০২০ সালের ২১ জুলাই তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু রাতের বেলা ওই হাসপাতাল কোনো রোগী ভর্তি না করায় পরদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাধ্যমে মানিক-াকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ২২ জুলাই সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর নেয়া হয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ৬০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেখানেই ২৪ জুলাই মারা যান ভারতের মাদ্রাজ প্রদেশের শুরুনিশুমনির ছেলে মানিক-া। এরপর থেকে ঢামেক মর্গে পড়ে আছে তার লাশ।

মানিকন্ডার লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা কারা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রালয়কে জানিয়েছি। এখন মন্ত্রণালয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

ঢামেক মর্গ ইনচার্জ সেকেন্দার আলী ভোরের কাগজকে বলেন, মর্গের ৫টি ফ্রিজের মধ্যে ২টি ফ্রিজ নষ্ট। বাকি ৩টি ফ্রিজে ১২টি লাশ রাখা যায়। এরমধ্যে ৪টি লাশ দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। পুলিশ কবে এগুলো নিবে সে বিষয়ে আমরা জানি না। লাশগুলোর বিষয়ে কেউ খোঁজ নিতেও আসেনা। আপাতত তেমন বড় কোনো সমস্যা দেখা না দিলেও বড় কোনো দুর্ঘটনায় ফ্রিজ সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ ভোরের কাগজকে বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের দায়িত্ব লাশ সংরক্ষণ করা এবং যখন পুলিশ লাশ চাইবে তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া। এর বাইরে আদালতকে অবজ্ঞা করে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। যতটুকু শুনেছি আইনি জটিলতায় লাশগুলো পড়ে আছে। যদিও দীর্ঘদিন লাশ এভাবে পড়ে থাকলে কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি দৈনন্দিন কাজেও কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আদালত যে আদেশ দেবেন, আমরা তাই পালন করব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App