×

মুক্তচিন্তা

যুদ্ধের ছাই-ভস্ম থেকে সমৃদ্ধির পথে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২১, ১২:৩৪ এএম

যুদ্ধের ছাই-ভস্ম থেকে সমৃদ্ধির পথে

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানে বন্দি। তাই তার দেশবাসীর কাছে স্বাধীনতা তখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্য ও ভারত হয়ে পা রাখেন সদ্য স্বাধীন হওয়া তাঁর আজন্ম-লালিত স্বপ্নের স্বদেশে। দেশে ফেরার দিনই রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একটি লোককেও আর না খেয়ে মরতে দেয়া হবে না। সকল রকমের ঘুষ লেনদেন বন্ধ করতে হবে।’ তরুণ বয়স থেকে তিনি শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের হয়ে লড়াই করেছেন। আর এই লড়াইয়ের ফসল হিসেবে স্বাধীন দেশ পাওয়ার পরই তাই শোষিতের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। আলাদা গুরুত্ব দিয়েছেন সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর। কারণ তিনি জানতেন সুশাসন না থাকলে মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। স্বাধীন দেশের দায়িত্বভার নিয়েই বঙ্গবন্ধু তাঁর সারা জীবনের বৈষম্য-বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল-ভাবনাকে অর্থনৈতিক কৌশলে প্রতিফলন ঘটাতে ভুল করেননি। তাঁর অর্থনৈতিক ভাবনাগুলোর যথার্থ প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই তাঁরই নেতৃত্বে প্রণিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এবং বিভিন্ন ভাষণে। স্বাধীন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য যেমন অর্থনৈতিক কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল ঠিক তেমটিই তিনি গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই কৌশল বাইরে থেকে ধার করা কোনো ভাবনা থেকে উত্থিত ছিল না। এ ছিল তাঁর অভিজ্ঞতাজাত মাটি ও মানুষের রূপকল্প। ১৯৭২ সালের ৭ জুন একটি ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বিশে^র কাছ থেকে সমাজতন্ত্র ধার করতে চাই না। বাংলার মাটিতে এই সমাজতন্ত্র হবে বাংলাদেশের মানুষের। এই সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মানুষের যেখানে কোনো শোষণ এবং সম্পদের বৈষম্য থাকবে না। ধনীকে আমি আর ধনী হতে দিব না। কৃষকরা, শ্রমিকরা এবং জ্ঞানীরা হবে এই সমাজতন্ত্রের সুবিধাভোগী।’ আর্থ-সামাজিক মুক্তির যে আকাক্সক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তা পূরণের পথেই দ্রুত ধাবিত হয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু। কিন্তু সামনে ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধ-পরবর্তী ছাই-ভস্মর মধ্যে একেবারে শূন্য থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ভাবতে অবাক লাগে যে, বঙ্গবন্ধু যখন দেশের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন, সেই ১৯৭২ সালের শুরুতে অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৬.৩ বিলিয়ন ডলার (যা বছর শেষে ৮ বিলিয়নে ঠেকেছিল)। মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৩ ডলার। রিজার্ভ ছিল শূন্য। জিডিপির তুলনায় বিনিয়োগের অনুপাত নয় শতাংশ। শুধু তাই নয়, আমাদের নিজস্ব উদ্যোক্তা শ্রেণি বলতে গেলে ছিলই না। অন্যদিকে উপর্যুপরি আঘাত হানছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আন্তর্জাতিক রাজনীতিও বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল না। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য ওঠা-নামা, অন্যদিকে খাদ্য সহায়তা নিয়ে পরাশক্তিগুলোর রাজনীতি এ সবের ফলে বাংলাদেশ সত্যিই ভীষণ নাজুক অবস্থায় ছিল। ‘শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলা’য় রূপান্তরের লক্ষ্যে তিনি শুরু করেছিলেন এক অনন্য অভিযাত্রা। একদিকে কোটিখানিক শরণার্থীর পুনর্বাসন, দেশের ভেতরে লাখ লাখ ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া পরিবারের জীবন-জীবিকার সুযোগ করে দেয়া এবং অন্যদিকে নতুন দেশের জন্য সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছিলেন। তাঁর স্বপ্নের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার রূপরেখার ভিত্তিভূমি স্থাপন করে দেয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। তাঁর অর্থনৈতিক দর্শনের সন্ধান মেলে এই অসাধারণ দলিলে। তাতে স্থান পেয়েছে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা। সংবিধানের উদারনৈতিক, আধুনিক এবং জনহিতৈষী ‘ভিশন’-এর আলোকেই বঙ্গবন্ধু পরিকল্পিত উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। সেই উদ্যোগের রূপরেখা খুঁজে পাই আমরা প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। ঐ দলিলের মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন যে, সুসমন্বিত নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য অগ্রাধিকার ঠিক করা অপরিহার্য। সরকারকে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্যই এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগণের পূর্ণ অঙ্গীকার তিনি দেশ-গঠনের জন্য প্রত্যাশা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণ যে সাহস ও প্রাণশক্তি দেখিয়েছেন সেভাবেই তারা দেশ গড়ার কাজেও আত্মনিয়োগ করবেন- এমনটিই ছিল তাঁর বিশ্বাস। তাৎক্ষণিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ভেবেছেন দীর্ঘমেয়াদি বিষয়গুলো নিয়েও। কারণ উন্নয়নের সুফলগুলোকে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন স্বনির্ভর দেশ গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যাওয়ার একটি ধারাবাহিকতা তৈরি করার জন্য। একই সঙ্গে ছোট অর্থনীতির দেশের জন্য মানবসম্পদই যে সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে সেটিও স্পষ্ট ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির কাছে। তাই কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী শিক্ষিত তরুণদের প্রস্তুত করতে যারা পরবর্তীতে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরিকে ভূমিকা রাখবে। স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের অবস্থার উন্নতির জন্য কৃষকের নিজস্ব জমির ব্যবস্থা, কৃষকের মাঝে খাসজমি বিতরণ, কৃষির উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য ভর্তুকি মূল্যে কৃষককে সার ও কীটনাশক, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য দেয়া, পচনশীল ফসল সংরক্ষণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং আধুনিক চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষককে প্রশিক্ষণদানÑ এ সবকিছুরই সূচনা করে গেছেন তিনি। সদ্য স্বাধীন দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে তাৎক্ষণিক আমদানি এবং কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। উচ্চতর কৃষি গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৭৩ সালের মধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করেন। পাকিস্তানি শাসনকালের ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি ও তাদের সব ঋণ সুদসহ মাফ করে দেন। কৃষি খাতের উন্নয়নকে বঙ্গবন্ধু অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এ কারণে যে, একদিকে কৃষি এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান দেবে। অন্যদিকে কৃষি থেকেই আসবে বর্ধিষ্ণু শিল্প খাতের কাঁচামাল। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই তিনি শিল্পকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আনতে বাধ্য হয়েছিলেন। বৃহৎ শিল্পগুলোকে তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিলেন। কারণ এটাই ছিল তখন একমাত্র পথ। কারণ পাকিস্তানি উদ্যোক্তারা তাদের শিল্প কারখানা ফেলে চলে গিয়েছিলেন আর ওই সময়টায় দেশে উদ্যোক্তা নেতৃত্বের শূন্যতা বিরাজ করছিল। পাশাপাশি তাঁর সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যও শিল্প খাত রাষ্ট্রায়ত্ত করাটা জরুরি ছিল। শিল্পায়নই সম্ভবত তাঁর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছিল। তাই ‘স্টেইট-লেড গ্রোথ অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর’ই ওই বাস্তবতায় সবচেয়ে কার্যকর কৌশল ছিল। তাই খুবই সুচিন্তিতভাবে পরিকল্পনা করে তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু করেছিলেন। কৃষি ও শিল্পের পুনর্গঠন, উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য নিরসনই ছিল তাঁর সে সময়ের অর্থনৈতিক মূল কৌশল। এর পাশাপাশি তাঁর লক্ষ্য ছিল ব্যাপক ঘাটতি অর্থনীতি সত্ত্বেও বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে স্বদেশি শিল্প উৎপাদন বাড়ানোর ওপর তাই তিনি খুব জোর দিয়েছিলেন। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কাক্সিক্ষত গতি আনতে যে কৃষির পাশাপাশি শিল্পকেও দ্রুত ও কার্যকরভাবে বিকশিত করতে হবে সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ছিল সজাগ দৃষ্টি। প্রথম পর্যায়ে বৃহৎ শিল্প পরিচালনার জন্য উদ্যোক্তা শ্রেণির অনুপস্থিতির কারণে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প খাতের বিকাশের পথ বেছে নেন। তিনি শুরুতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে ব্যক্তি খাতের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করার পক্ষপাতি ছিলেন। তাই ১৯৭৪-৭৫-এ এসে দেখতে পাই তিনি ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের সীমা ২৫ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকায় উন্নিত করছেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প ব্যক্তি খাতে হস্তান্তর করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেটি সম্ভবত দুর্নীতি প্রতিরোধ। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন এবং সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাখার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় সুশাসনের অভাব। তাই তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা ও লেখায় স্বাধীন দেশে দুর্নীতি নিয়ে তাঁর হতাশা এবং এই দুর্নীতি প্রতিরোধে সর্বশক্তি প্রয়োগের প্রত্যয় ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধু চিরকালই জনগণকে নিজের সবচেয়ে বড় শক্তি মনে করে এসেছেন। তাই দুর্নীতি-বিরোধী অভিযানের মাধ্যমে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ সফল করার জন্য জনগণের কাছেই আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন। বাংলার গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষ যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে তবে বাংলাদেশ টিকে যাবে এবং ক্রমান্বয়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে- এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত ছিলেন। তাই বলেছিলেন- ‘গ্রামে গ্রামে ফিরে যান। যেয়ে বলবেন দুর্র্নীতিবাজদের খতম করতে হবে। ক্ষেতে-খামারে, কল-কারখানায় প্রোডাকশন বাড়াতে হবে।... আপনারা প্রাণ দিয়ে কাজ করুন। ইনশাল্লাহ বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে।’ দেশের স্বার্থে এমন আপসহীন এবং দেশের মানুষের ওপর এতটা আস্থাশীল ছিলেন বলেই বাংলাদেশের যারা শত্রু তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারের বহুসংখ্যক সদস্যসহ হত্যা করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সশরীরে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে না থাকলেও তাঁর চিন্তা, কর্ম ও দর্শন শক্তি জুগিয়েছে এদেশের মানুষের মনে। তাই বহু সংগ্রাম আর ত্যাগের পর দেশ আবার ফিরেছে বঙ্গবন্ধুর দেখিয়ে যাওয়া পথে, তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে।

ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App