×

জাতীয়

হাসিনা-মোদি বৈঠক: বাণিজ্য প্রসারে অগ্রাধিকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২১, ০৯:৩৮ এএম

হাসিনা-মোদি বৈঠক: বাণিজ্য প্রসারে অগ্রাধিকার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাণিজ্যবিষয়ক আলোচনাই বেশি গুরুত্ব পাবে। তবে আলোচনায় যুক্ত হতে পারে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন এবং সীমান্ত হত্যার মতো ইস্যুও। একই সঙ্গে করোনা মহামারি ঠেকাতে ভ্যাকসিন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব জন্মশতবার্ষিকীর বিষয়টিও দুই রাষ্ট্রনেতার আলোচনায় ঠাঁই পাবে বলে আভাস পাওয়া গেছে। তবে তার আগে আজ মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে পানি নিয়ে দুদেশের পানিসম্পদ সচিব পর্যায়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে আগামী ২৬-২৭ মার্চ বাংলাদেশ সফর করবেন। তিনি মূলত মুজিববর্ষ উদযাপন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের যৌথ উদযাপন উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই সফর করবেন। সফরের দ্বিতীয় দিন ২৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একান্ত বৈঠক হবে। মোদির ঢাকা সফরে ভারতের সঙ্গে তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে জানিয়ে তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ এখনো আশাবাদী বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিন আলোচনা চলছে। পানি ইস্যু ছাড়াও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটা হচ্ছে বাণিজ্য। আমাদের সচিব পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের বড় ইস্যু ইচ্ছে বর্ডার কিলিং, সেটা আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ক্রিটিক্যাল সব বিষয় আমরা আলোচনা করেছি। তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনার বিষয় মোটামুটি ঠিক হয়েছে। ওইগুলো যাতে বলবৎ থাকে, প্রয়োগে যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য হয়তো প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরতে পারেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলেছেন, শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস কিংবা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূত্রে ব্যবসার সম্প্রসারণ উপলক্ষ নয়; নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারণার সুবিধার্থে এবারের ঢাকা সফরকে ব্যবহার করতে চান। পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশে বিপুলসংখ্যক মতুয়া সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করে। উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়ার মতো জায়গাগুলোতে মতুয়াদের ভোট বড় ফ্যাক্টর। এ কারণেই মতুয়া ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা হরিচাঁদ ঠাকুরের বাড়িতে যেতে এত আগ্রহী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে গেলে মতুয়া ভোটারদের বিশেষ বার্তা দিতে পারবেন বলে হয়তো মনে করছেন তিনি।

অন্য একটি সূত্র দাবি করেছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে মোদি সংযুক্তি ও ব্যবসা সম্প্রসারণের বিষয়টিকেই গুরুত্ব দেবেন। এর মধ্যে রয়েছে যন্ত্রাংশ, ওষুধ, পর্যটন, শিক্ষা, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ভারী শিল্প ও নিত্যপণ্যের জিনিস বাংলাদেশে রপ্তানির বিষয়ে কথা বলবেন মোদি। বাংলাদেশও কিছু পণ্য ভারতে রপ্তানি করতে চায়। সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। পাশাপাশি ভিসানীতি যাতে আরো সহজ করা যায় সে বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।

বৈঠকে বিশ্বে যে কূটনীতির বলয় তৈরি হয়েছে সে বিষয়েও মোদি-হাসিনার মধ্যে কথা হতে পারে। সূত্র জানিয়েছে, ভারত চাইছে দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিতে। সে ক্ষেত্রে শান্তি দরকার। এজন্য কদিন আগে কোয়াড বৈঠকে বাইডেনের সঙ্গে মোদি সরকারের যে আলোচনা হয়েছে সেটির সারাংশও আসন্ন বৈঠকে টেনে আনা হতে পারে। সীমান্ত হত্যা ইস্যুতে সরাসরি আলোচনা না করে দারিদ্র্যতা, হিংসা ও অনুপ্রবেশ যাতে না হয় সেসব বিষয় আলোচনা করে জনসম্পদকে কাজে লাগানোর রূপরেখা বের করা হতে পারে। কারণ ভারত মনে করে জনসম্পদকে কাজে লাগানো হলে নানা অপরাধ কমে আসবে। আর অপরাধ কমলে সীমান্তে হত্যাও কমে যাবে। এছাড়া দুই দেশেই যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে সরকারি কর্মক্ষেত্রের ওপর ভরসা করা ঠিক হবে না। এজন্য বিকল্প কর্মসংস্থান দরকার। বিকল্প কর্মসংস্থান জোগাড় করতে হলে শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে। আর এটি বাণিজ্যের মাধ্যমে সহজেই করা সম্ভব বলে আলোচনায় এ বিষয়টিও উঠতে পারে। রোহিঙ্গা নিয়ে দুই সরকারই চাপে আছে। বাংলাদেশ আর কতদিন রোহিঙ্গাদের জায়গা দেবে। স্পর্শকাতর এই ইস্যুটি সমাধানের আগে মিয়ানমারে শান্তি ফেরানো দরকার। সবমিলিয়ে রোহিঙ্গা পর্বটিও আলোচনায় স্থান পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেয়ার আগে নরেন্দ্র মোদি যাবেন মতুয়া সম্প্রদায়ের পবিত্র তীর্থস্থান গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি ও সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী মন্দিরে। তিনি টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। তবে এদিন তিনি ঢাকা থেকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে প্রথমে যাবেন সাতক্ষীরা যশোরেশ্বরী মন্দিরে। এটা অনেক পুরনো মন্দির, প্রতাপাদিত্য কিংবা লক্ষণ সেনের সময়ের। সাতক্ষীরা থেকে হেলিকপ্টারে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে যাবেন মোদি, সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানাবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী মোদি গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি যাবেন। সেখান থেকে সে দিনই ঢাকায় এসে বৈঠক সেরে তিনি দিল্লি ফিরে যাবেন।

এত কম সময়ে বাংলাদেশ সফরে এসে রাজধানী ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত এলাকায় মন্দির দর্শন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে এমন প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী কালী মন্দির সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থস্থান। এই ধর্মস্থানটি শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিত। আর মতুয়া মতবাদের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মস্থান হলো গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার ওড়াকান্দি। ওই গ্রামের মন্দিরটি মতুয়া স¤প্রদায়ের কাছে পরিচিত সর্বোচ্চ মর্যাদার তীর্থস্থান হিসেবে।

ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী এর আগে কখনো বাংলাদেশ সফরে গিয়ে ওড়াকান্দি যাননি। ফলে নরেন্দ্র মোদি যদি সত্যিই সেখানে যান, তা হলে মতুয়াদের কাছে তিনি ইতিবাচক একটি বার্তা পৌঁছে দিতে পারবেন। যা পশ্চিমবঙ্গ ভোটের আগে তাৎপর্যপূর্ণ। রাজ্যটির ৬৫ থেকে ৭০টি আসনে মতুয়া ভোট জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি করে দেয় বলে ধারণা করা হয়। সেই জায়গায় পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক একদিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির ওড়াকান্দি যাওয়াটা বিজেপির জন্য রাজনৈতিক সুফল বয়ে আনতে পারে।

সম্প্রতি এই ইস্যুতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন, মোদি যে দুই মন্দির দর্শনে যাবেন সেখানকার অনুসারী অনেক লোক ভারতে থাকেন। এরফলে ওখানে গেলে হয়তো তিনি সুবিধা পাবেন।

বাংলাদেশের মতুয়া মহামিশনের সংঘাতিপতি ও মতুয়াচার্য পদ্মনাভ ঠাকুর জানান, প্রধানমন্ত্রী মোদির সফর সামনে রেখে দেশটির ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারা এরই মধ্যে ওড়াকান্দি ঘুরে গেছেন। পদ্মনাভ ঠাকুর আরো বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি আসার পর নাটমন্দিরে ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলবেন। এরপর হরিমন্দিরে পূজা দেবেন। এসব কর্মসূচি শেষে তিনি মতুয়া প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।

ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে মতুয়া স¤প্রদায়ের অনুসারীর সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রায় তিন কোটির বসবাস পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সরকারের আমলে মতুয়াদের কাছে টানার পদক্ষেপ চলেছে জানিয়ে মতুয়াচার্য পদ্মনাভ ঠাকুর বলেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনিও মতুয়াদের কাছে টানার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আমাদের জন্য কিছু করেছেন। তারপর তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় এসে ঠাকুর নগরের ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। কিছু উন্নয়ন করেছেন। মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনকে তিনি সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

নরেন্দ্র মোদির আগমনে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি নিজেদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার কথাও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতে চাইছেন ওড়াকান্দির মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। মতুয়াচার্য পদ্মনাভ বলেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনে সরকারি ছুটি রয়েছে। তাই অবতার হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনে বাংলাদেশে ঐচ্ছিক ছুটি প্রচলন করেছে সরকার। আমরা দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণার প্রধান দাবি জানাচ্ছি।

মতুয়া অনুসারী সঞ্জয় বলেন, বাংলাদেশে বিশ্ব এজতেমার পর শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে সব থেকে বেশি জনসমাগম হয়ে থাকে। সে কারণে ওড়াকান্দিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও মর্যাদার আসনে বসানোর দাবি মতুয়াদের রয়েছে। নরেন্দ্র মোদির আগমনের মধ্যে দিয়ে এটি আরো প্রসারিত হবে। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা চেয়ারম্যান সুব্রত ঠাকুর বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে মতুয়াদের মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। এতে মতুয়াদের এগিয়ে চলা আরো গতিশীল হবে।

ওড়াকান্দির হরি মন্দিরের সেবাইত হরি গোঁসাই আবার বলেন, ২৭ মার্চ মোদি আসছেন। তিনি এখানে পূজা দেবেন। আমি তাকে পুজোয় সহযোগিতা করব। এখানে পূজা দিলে হরিচাঁদ ঠাকুর মোদির মনোস্কামনা পূর্ণ করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তখন সব মতুয়া ভক্ত ও বিশ্বের কল্যাণ কামনায় বিশেষ প্রার্থনা করা হবে।

পানি নিয়ে দিল্লিতে বৈঠক আজ : ২৭ মার্চ হাসিনা-মোদি বৈঠকে পানি নিয়ে আলোচনা হবে। এজন্য মোদির সফরের আগেই বহুল আলোচিত বিষয়টি সমাধানে বৈঠকে বসছেন ভারত-বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। আজ মঙ্গলবার দিল্লিতে বৈঠকে বসবেন তারা। বৈঠকে অংশ নেয়ার জন্য বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারের নেতৃত্বে এরই মধ্যে দিল্লি সফরে গেছেন ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন দেশটির জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব পঙ্কজ কুমার। ওই বৈঠকে, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, দুধকুমার ও ধরলা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরার সাব্রুম শহরের জন্য পানি নেয়ার বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। এমনকি, সুরমা নদী থেকে পানি নেয়ার বিষয়ে সম্ভাব্য সমঝোতা স্মারক নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App