×

মুক্তচিন্তা

বাঙালির রাজনৈতিক পরিচয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২১, ১২:৩৭ এএম

বাঙালির একটি নির্দিষ্ট গণ্ডি আছে, নির্দিষ্ট একটি আকাশ আছে, আছে নিজস্ব ভৌগোলিকতা বোধ। তার আছে নিজস্ব একটি রাজনৈতিক পরিচয়, নিজস্ব একটি রাজনৈতিক সংজ্ঞা। বাঙালির সেই নিজস্ব ভঙ্গিকে কলুষিত করতে বহিরাগত শক্তি বারবার ভেতরে ঢুকে পড়েছে, রাজনৈতিক কালো ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ালেও একটা সময় তা বাঙালির নিজস্ব বলয় একসুরে তোড়ের মুখে ভাসিয়ে দিয়েছে। ভস্ম করে দিয়েছে আগুন নিয়ে খেলার সরঞ্জামাদি। প্রমাণ করেছে, বাঙালির স্বপ্ন আর সামাজিক ও রাজনীতির গঠনশীল অঙ্গীকার বিনিদ্র প্রহরীর মতো জাগ্রত। সেখানে দ্বিধা নেই, নেই বিভাজন, নেই বিদ্বেষের আগুন। প্রমাণ হয়েছে বাঙালি শেষ পর্যন্ত ভণ্ড রাজনীতি, অন্ধ রাজনীতি, কালিমাযুক্ত রাজনীতি ধরে বসে থাকে না। বাঙালি ভুল করে, কিন্তু ভুল শুধরে নেয়ারও শক্তি রাখে। বাঙালি তাই আত্মচৈতন্যে বলীয়ান হয়ে বলেÑ ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’। বাঙালির কবিতা, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র, গণমাধ্যম, সংগীত সবসময় তার রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে, পরিপূর্ণ করেছে। তাই তার রাজনীতিও সীমা ভাঙার এক বিস্ময়কর অবয়বে রূপ নিতে পেরেছে। ভাঙন, রক্তক্ষয় সবই এসেছে, কিন্তু শেষ বেলায় জয় হয়েছে বাঙালিরই। সব পরিহাসকে অতিক্রম করে, অতীতের গৌরব আর ঐতিহ্যকে বুকে জড়িয়ে একসময় তার সংযত, সংহত ও প্রতিরোধমুখর চেহারা সুস্পষ্টতা লাভ করেছে। বাঙালি ফিরে পেয়েছে কাক্সিক্ষত স্বস্তি, প্রত্যাশার ঝলমলে রোদ আর হৃদয়ের উষ্ণতা। জোহনারিজম বলে একটি মতবাদ আছে। ‘জোহনারিজম’ অর্থ হলো- একটি সহজ-সরল সত্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মানুষের সামনে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা, যাতে মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং ভুল বার্তা গ্রহণ করে। মানুষকে কীভাবে বোকা বানানো যায়, তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করেন নাথান জোহনার। ছাত্রাবস্থায় তিনি তার সহপাঠীদের সামনে একটি বিজ্ঞান প্রকল্পের উপস্থাপনা করেন। বিষয় ছিলÑ ‘দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কোনো বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করার দাবি’। রাসায়নিকটির নাম হলো ‘ডাইহাইড্রোজেন মনোক্সাইড’। পুরো বক্তৃতায় তিনি সম্পূর্ণ সঠিক বৈজ্ঞানিক যুক্তি সাজিয়ে ব্যাখ্যা করলেন, কেন এই রাসায়নিকের ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। তিনি যুক্তি দিয়ে বললেন, ডাইহাইড্রোজেন মনোক্সাইড- ১. গ্যাসীয় অবস্থায় ভয়ঙ্করভাবে চামড়া পুড়িয়ে দিতে পারে। ২. ধাতুর ক্ষয় ও মরিচা সৃষ্টি করে। ৩. প্রতি বছর অগণিত মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ৪. টিউমার, ফোঁড়া ও এসিড রেইনের মধ্যে রাসায়নিকটি পাওয়া যায়। ৫. অধিক পেটে গেলে বারবার প্রস্রাব ও উদরপীড়া হয়। ৬. রাসায়নিকটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে এবং বেশ কিছুদিন রাসায়নিকটিকে বর্জন করে থাকলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। বক্তৃতা শেষে তিনি উপস্থিত সহপাঠী এবং শ্রোতাদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘এবার বলো, তোমরা কে কে এই রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে কর।’ উত্তরে দেখা গেল, তার ৫০ জন সহপাঠীর মধ্যে ৪৩ জনই হাত তুলে রাসায়নিকটির ব্যবহার বন্ধে মত জানিয়েছে। আপনারা কি ইতোমধ্যে রাসায়নিকটিকে চিনতে পেরেছেন? হ্যাঁ, ওটা মোটেও বিষাক্ত বা সাংঘাতিক কোনো রাসায়নিক পদার্থ নয়। ডাইহাইড্রোজেন মনোক্সাইড হলো পানির রাসায়নিক নাম। এখানে মজার বিষয় হলো, জোহনার কিন্তু একটি কথাও মিথ্যা বলেননি। বরং তার প্রত্যেকটি কথাই ছিল একশ ভাগ খাঁটি বৈজ্ঞানিক সত্য। ১. পানি ফুটে যে বাষ্প বা স্টিম হয়, তা সত্যিই চামড়া পুড়াতে পারে। ২. লোহার মরিচা ও অন্য ধাতুর ক্ষয় পানি আর বাতাসের অক্সিজেন দিয়েই হয়। ৩. বন্যায় প্রতি বছর বহু মানুষ মারা যেতে পারে। ৪. টিউমার, ফোঁড়া ইত্যাদিতে পানি আছে। রক্ত, প্লাজমা, লসিকা ইত্যাদি যে কোনো দেহরসেরই প্রধান উপাদান পানি। এসিড রেইনেও পানি থাকবে। ৫. বেশি পানি খেলে বারবার প্রস্রাব আর পেটে ব্যথাও হবে। ৬. পানির ওপর আমরা সবাই নির্ভরশীল। বেশিদিন পানি ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। তাহলে দেখুন, সহজ এ সত্যিগুলোকেই জোহনার এমনভাবে উপস্থাপন করলেন যে সবার মনে হলো, পানি একটি মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিক। জোহনার শুধু পরীক্ষামূলকভাবেই এ বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, সাধারণ মানুষের সামনে যদি কোনো বিষয়কে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলা হয়, তাহলে ওই সাধারণ মানুষের মনে বিষয়টি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে দেয়। আমাদের দেশে বিদ্যমান এবং বিগত রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ও খবরগুলোর দিকে খুব ভালো করে তাকালে দেখা যাবে, তাতে আছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জোহনারিজম। খুব সাধারণ একটি উদাহরণ দিয়ে আজকের দিনের জোহনারিজম চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। ধরা যাক, কোনো একদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা হলো ১০ জন। পরের দিন হলো ৫ জন। এখন এ পরিসংখ্যানটা একজন সংবাদ পরিবেশক দুভাবে উপস্থাপন করতে পারে- ১. গতকাল ১০ জনের মৃত্যুর পর আজো সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২. মাত্র একদিনের মধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। উপরে উল্লেখিত দুটি সংবাদই কিন্তু একশ ভাগ সত্য। ভিন্নতা শুধু পরিবেশনের ভঙ্গিতে। কিন্তু দুটি সংবাদ মানুষের মনে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। আজকের পৃথিবীতে এই জোহনারিজমের সব রকম প্রয়োগ চলছে সংবাদমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্য দিয়ে। জোহনারিজমের শিকার হচ্ছে ধর্ম ও রাজনীতির ব্যাখ্যাও। মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। এগুলো সবই হচ্ছে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার তাগিদে। পূর্ণ সত্য, অর্ধ সত্য কিংবা অসত্যকে এমন মোড়কে পরিবেশন করা হচ্ছে যে, ঐতিহ্যগতভাবে সরল মানুষের বেশিরভাগই সেগুলোকে সত্যি বলে ধরে নিচ্ছে এবং সে অনুযায়ী নিজের মতামত তৈরি করে ফেলছে। পচন ধরেছে রাজনৈতিক বিশ্বাসে। পচন একবার ধরে গেলে তা বাড়তে থাকে। একমাত্র অস্ত্রোপচার করে অর্থাৎ পচন ধরা অংশটি পুরোপুরি বাদ দিয়ে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতা দখলের পাগলামি আর লোভ সীমাহীন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তাদের ব্যবহারে এসেছে নির্লজ্জ আচরণ। ধর্ম এখন শুধু মসজিদ-মন্দির-গির্জা আর মানুষের হৃদয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই, চলে এসেছে একেবারে রাজনীতিতে। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডও। রাজনীতি পরিণত হয়েছে যেন টি-টুয়েন্টি ম্যাচ কিংবা ১০০ মিটারের স্প্রিন্ট। রাতারাতিই হাতে চাচ্ছে ফলাফল। ফলে রাজনীতিতে শুরু হচ্ছে গভীর শূন্যতা। আর রাজনীতির এহেন বিশৃঙ্খলতার হাত গলে জন্ম নিচ্ছে জোহনারিজম। ঘন ঘন বদলাচ্ছে রাজনীতির রং। রাজনীতিতে ভর করছে ক্ষমতা, গুরুত্ব আর প্রতিপত্তির খেলা। মানুষ এখন অন্ধের মধ্যে ঝাপসা খুঁজছে, যাকে বলে ‘চুজিং দ্য লেসার ইভল’। একদল মেতে আছে ক্ষমতা-লোভ নিয়ে, আর একদল অলক্ষ্যে ব্যবহার করে যাচ্ছে জোহনারিজমের বিষক্রিয়া। ভরসা একটিই। জোহনারিজম দিয়ে বাঙালিকে দীর্ঘসময় বুঁদ করে রাখা যাবে না, বাঙালি জাতির অখণ্ড সত্তাকে চিরতরে শ্রেণি কিংবা ধর্মীয় ভেদরেখায় আটকে রাখা যাবে না। যারা বিভাজন চায়, তারা এ জাতিকে ঠিক চিনতে পারেনি। তারা জাতিকে মানুষ ভাবেনি, বাঙালি ভাবেনি- ভেবেছে নিছক একটি সাম্প্রদায়িক জীব। কিন্তু গ্রহণশীলতা আর গ্রহণযোগ্যতার চিরায়ত ভাবাবেগে বাঙালি উদার-অন্তহীন বিস্তৃতি নিয়ে একদিন উদ্ভাসিত হবে। বাঙালি একটি অখণ্ড জাতি। শ্রেণি আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা, সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্রতা আর আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ একদিন ঘটবেই। সেদিন তার কাজে দিগন্ত থাকবে না, কালের মাত্রা থাকবে না, সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্রতার নির্বোধ বহিঃপ্রকাশ থাকবে না। বাঙালির এ আকাশকে, তার ভৌগোলিকতা বোধকে, সত্তার বিশিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় ও সংজ্ঞাকে যারা বিভাজিত-কলুষিত করতে চাইছে, তাদের সব জোহনারিজমকে চ্যালেঞ্জ করে একদিন বাঙালি চিৎকার করে বলবে- আমরা বাংলায় কথা বলি, আমরা বাংলায় গান গাই।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App